🍀 রামায়ণে ইন্দ্র অহল্যা কাহিনীঃ প্রকৃত সত্যের অন্বেষণ ৷ 🍀

• ইন্দ্র অহল্যা উপাখ্যান, রামায়ণের এক অতি রহস্যময় অধ্যায়। এই অংশটাকে নিয়ে একদিকে যেমন আছে কিছু জল্পনা কল্পনা  তেমনি আছে কিছু অপপ্রচার, একই সাথে কিছু বিভ্রান্তি।

তথাকথিত শাস্ত্রজ্ঞ পরিচয়ে বিভ্রান্তি মহাজোটের সদস্যবৃন্দ যারা ঢালাওভাবে প্রচার করে বেড়ান যে রামায়ণ মহাভারত সম্পূর্ণভাবে প্রক্ষিপ্ততামুক্ত, তারা এই প্রসঙ্গ উঠলে কেন জানিনা এই ঘটনার স্বকল্পিত অমৃতসম(?) তত্ত্ব কাউকে জানাতে চাননা, তাই আমার মত শাস্ত্র সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞকেই বিষয়টির উপর আলোকপাত করতে হলো।

প্রথমত এখানে ব্যাপারটি কি সেটা নিয়েই একটু সংক্ষেপে জেনে নেয়া দরকার। কেন এই অংশ আলোচিত সেটাও জানা দরকার। তারপর খুঁজতে হবে এখানে অসঙ্গতি কি এরপর একটা সত্যের সন্ধান পরিশেষে দেখতে হবে কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় কিনা।

এখানে আমি একটা ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিতে চাই আমি কোন শাস্ত্রজ্ঞ বা মীমাংসক নই তাই আমার ভুল ত্রুটিগুলোকে শুধরে দিলে খুশি হব। আমি শুধু আমার পর্যবেক্ষণকেই তুলে ধরেছি মাত্র।

আমি আলোচনার জন্য গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর থেকে প্রকাশিত বাংলা রামায়ণের সংস্করন ব্যাবহার করব। কারন এতে প্রক্ষিপ্ত ও অপ্রক্ষিপ্ত সকল অধ্যায়+ শ্লোককেই মোটামুটিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর এর অনুবাদের মানও বেশ ভালো। কিন্তু এখানে পদার্থ না থাকায় কিছুক্ষেত্রে বিশিষ্ট গবেষক ও অনুবাদক দেশিরাজু হনুমান্থা রাওয়ের অনুদিত  অনলাইন রামায়ণ থেকেও পদার্থ উল্লেখ করেছি।

চলুন মূল আলোচনায় যাওয়া যাক-

ইন্দ্র অহল্যা কাহিনী পাওয়া যায় বাল্মীকি রামায়ণের দুই জায়গায়-

১)আদিকাণ্ডে

২) উত্তরকাণ্ডে

√আদিকাণ্ডের ৪৮-৫১ তম অধ্যায়ে

√উত্তরকাণ্ডের ৩০ তম অধ্যায়ে

প্রসঙ্গত, এখানে দুটো কাণ্ডে ঘটনা সম্পূর্নভাবে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গিয়েছে। আদিকাণ্ডে যেখানে অহল্যা ও ইন্দ্র সেচ্ছায় পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েছে সেখানে উত্তরকাণ্ডে বলা হয়েছে যে, ইন্দ্র অহল্যাকে ধর্ষণ করেছে। অর্থাৎ এখানে স্পষ্টই দুইস্থানে পরষ্পরবিরুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে। তাই প্রথমেই আমাদের এদের থেকে একটাকে গ্রহণ করতে হবে।

আদিকাণ্ডের কাহিনী কতকটা এরকম- 

মহর্ষি গৌতম ও তার পত্নী অহল্যা মিথিলার উপকণ্ঠে এক তপোবনে বাস করতেন, একদিন সেখানে শচীপতি ইন্দ্র, গৌতমমুনির অনুপস্থিতিতে গৌতম মুনির বেশ ধারন করে যান এবং অহল্যার সাথে শারীরিক মিলন প্রত্যাশা করেন। যদিও অহল্যা তাকে চিনতে পারেন কিন্তু তাও তিনি ইন্দ্রের সাথে মিলনে প্রবৃত্ত হন, এবং তারা দুজনেই সন্তৃপ্ত হন। এরপর যখন ইন্দ্র অহল্যাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন গৌতম মুনির হাতে ধরা পরে যান। তখন গৌতম মুনি তাদের দুজনকে অভিশাপ দেন।

মুনির অভিশাপে ইন্দ্র তার অণ্ডকোষ হারান, রূপক বাদ দিয়ে বললে পুরুষত্ব হারান। আর অহল্যাকে অভিশাপ দেন, সে সকল প্রাণীর অদৃশ্য হয়ে (বর্ষসহস্রাণি বহূণি) অর্থাৎ বহু সহস্র বছর অনাহারে শুধুমাত্র বায়ুভক্ষণ করে ভস্মশয্যাগ্রহণপূর্বক প্রায়শ্চিত্তরুপ তপস্যা করবে। যখন রাম এখানে আসবে তখনই সে যদি তার আতিথ্য সৎকার করে তবেই সে শুদ্ধ হবে আর গৌতম মুনিও তখন তার কাছে ফিরে আসবে। এই বলে গৌতম মুনি চলে যান। পরবর্তীতে রাম এসে তাকে উদ্ধার করেন ও গৌতম মুনিও ফিরে আসেন।

অন্যদিকে উত্তরকাণ্ডের ঘটনাটিও এরকমই কিন্তু সেখানে বাড়তি বলা হচ্ছে অহল্যার সম্মতি ব্যাতিরেকে ইন্দ্র থাকে ধর্ষণ করেন। বাকি সব ঘটনা একই রকম।

উত্তরকাণ্ডের অংশ সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ এরূপ-

প্রথমত প্রায় সব গবেষক ও চিন্তাশীল মহলেরই মত যে, উত্তরকাণ্ড পুরোটাই প্রক্ষিপ্ত। এমনকি মূল রামায়ণ থেকেই সেটা প্রমান করা যায়, যাইহোক সে বিষয়ে অন্যদিন আলোচনা করা যাবে।

দ্বিতীয়ত কেউ প্রক্ষিপ্ত না মানলেও এই বর্ণনাটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না কারণ যদি ইন্দ্র এমনভাবে ধর্ষণই করেন তাহলে শাস্তি শুধু ইন্দ্রের পাওয়ার কথা অহল্যার নয় যেহেতু অহল্যা স্বেচ্ছায় কিছু করেননি। যদিও পরে এখানে বলা হয়েছে অহল্যা তার অনিচ্ছার কথা জানালে তখন গৌতম মুনি রামের দ্বারা উদ্ধারের প্রসঙ্গ টানেন। 

কিন্তু এখানে কথা হলো গৌতম মুনির মতো প্রগাঢ় বিদ্বান নিশ্চিতভাবে কখনোই পুরো ঘটনা সম্পর্কে উপযুক্ত বিচার ছাড়া সিদ্ধান্তে আসবেন না। তাই না জেনেও কাউকে এতবড় শাস্তির প্রসঙ্গটাও অসমীচীন যেখানে অহল্যা সম্পূর্ণ নির্দোষ।

এই দুই সিদ্ধান্তের বিচারে এই উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত ঘটনা সম্পূর্ন বাতিল ধরে শুধু আদিকাণ্ডে বর্ণিত অংশকে নিয়েই আগানো যাক।

আদিকাণ্ডে প্রক্ষিপ্ত শ্লোক বা অধ্যায় আছে কি নেই সে বিচার আজকে থাক। আজকে বরং যুক্তিতর্ক দ্বারা বিচার করি বাস্তবতা কী।

তার আগে ছোট করে বলে নেই এই ঘটনাটা এত আলোচিত কেন!

আমরা যদি বৈদিক ধারণাকে দূরে রেখে শুধুমাত্র পৌরাণিক তত্ত্বেই স্থির থাকি তাতেও এটা সিদ্ধান্ত যে, দেবতাদের যিনি রাজা হন তাকে ইন্দ্র বলা হয় আর এই কাহিনীর সাথে জড়িত ইন্দ্র হলো শচীপতি সহস্রলোচন ইন্দ্র। বৈদিক সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিদ্বানরা হলো দেব অন্যদিকে অহল্যা হলো গৌতম মুনির পত্নী যিনি নিজেও গৌতম মুনির সাথে বহুবছর তপস্যা করেছেন। সেই হিসেবে এদের মতো কোন চরিত্র যদি কোন অনৈতিক কাজে জড়ান আবার তাও যদি কোন প্রসিদ্ধ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস গ্রন্থে থাকে তাহলে প্রাচীন আর্য বিদ্বানদের উপরেই আঙুল ওঠে। আবার তা একই সাথে আধুনিক পাঠকের চোখেও দৃষ্টিকটু হয়। 

এখানে প্রশ্ন থাকে, ভারতীয় ইতিহাস গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য এই যে তাতে একই সাথে ইতিহাস বর্ণনার পাশাপাশি ধর্ম, অর্থ, কাম মোক্ষপ্রদায়ী চার ধরনের উপদেশ লিপিবদ্ধ থাকে।

যদি এখানে ইতিহাসের প্রসঙ্গ নাও থাকে তাও বিবেচ্য যে এখানে কোন উপদেশ আছে কিনা আর যদি তাও না থাকে তাহলে বিবেচ্য এই ঘটনা উল্লেখ করার কারণ কী?

আমার পর্যবেক্ষণ মোতাবেক এটা কোনভাবেই ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত নয়, তার প্রমাণ আমি করব। এখানে উপদেশঘটিত কোন কারণে এর বর্ণনা হয়েছে বললেও যে যুক্তিগুলো ওঠে তাও ততটা জোরাল নয় এর বিরুদ্ধের অভিযোগের সাপেক্ষে। তাহলে এর উল্লেখের কারণ কী সেটার আলোচনা হবে একেবারে শেষ অংশে।

প্রথমেই দেখে নেই ইন্দ্র অহল্যা কাহিনী আদিকাণ্ডের কোন কোন অংশে পাচ্ছি-

 আদিকাণ্ডের ৪৮ তম অধ্যায়ের ১১-৩৩ শ্লোক, ৪৯ তম অধ্যায়ের পুরোটাই এবং ৫০ তম অধ্যায়ের ২৪তম শ্লোক এবং  ৫১ এর ৩-১১ এই অংশগুলোতে আমরা অহল্যা ইন্দ্রের প্রসঙ্গ পাই।

এবার দেখা যাক কাহিনীতে বর্ণনার অসঙ্গতি কি আছে-

প্রথমেই স্পষ্ট করে নেয়া প্রয়োজন রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকি নিজেও একজন তপস্বী এবং তিনি রামচন্দ্রের সমসাময়িক। রাম লঙ্কাবিজয়ের পর যখন অযোধ্যায় রাজত্ব করছেন তখন নারদের কাছে শোনা বর্ণনা ও নিজের অনুসন্ধানে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাই রামায়ণে কাব্যাকারে উপস্থাপন করেছেন-একথা রামায়ণেই আছে। (অবশ্য প্রচলিত রামায়ণে আরো অনেক কিছু পাওয়া যায়) তাই এখানে কোনভাবেই তিনি এমন কিছু নিশ্চয়ই লিখবেন না যা বৈদিক নীতি বিরুদ্ধ এবং খাপছাড়া ধরনের বর্ণনায় পরিপূর্ণ ও অসত্য।

♣এখানে আমরা যদি ৫১ তম অধ্যায়ের ২ নং শ্লোকটি পড়ি সেখানে আমরা দেখি, মহর্ষি গৌতমের জেষ্ঠ্য পুত্র হিসেবে শতানন্দ মুনিকে। নিশ্চিতভাবেই তার আরো পুত্র থাকবে নাহলে শ্লোকে "জ্যেষ্ঠ" শব্দ মহর্ষি বাল্মীকি অকারণে প্রয়োগ করবেন না। যদিও রামায়ণে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। আবার শতানন্দ মুনিকে আমরা দেখি মহান তপস্বী(মহাতপাঃ) হিসেবে। বেশ অনেক বছরের তপস্যা কেউ না করলে নিশ্চয়ই তাঁকে মহাতপাঃ বলে সন্মোধন করা হবে না। 

আবার ৫০তম শ্লোকে দেখি এই শতানন্দ মুনি নিজেই আবার রাজা জনকের কুলপুরোহিত। এখানেও নিশ্চিতভাবে কোন বাচ্চা বা অল্পবয়স্কা যুবককে কেউ কুলপুরোহিত হিসেবে নিশ্চয়ই নিয়োগ দেবে না। তাহলে এখানে আমরা যে বর্ণনা পাই তাতে শতানন্দ মুনিকে মোটামুটি বয়স্ক বলেই মনে হয়। এই পয়েন্টটা একটু মাথায় রাখবেন!

এবার আমরা যদি ৪৮/১৬ শ্লোকটা দেখি সেখানে আমরা পাই গৌতম ও অহল্যা বহুবছর ধরে মিথিলার উপকণ্ঠে সেই আশ্রমে তপস্যা করছেন।

এরপর যদি অভিশাপের প্রসঙ্গ আসে তাহলে দেখা যায় অহল্যাকে গৌতম মুনি (বর্ষসহস্রাণি বহূণি) অর্থাৎ বহু সহস্র বছর ধরে তপস্যা দ্বারা প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে বলে অভিশাপ দেন। 

এখানে যদি ধরেও নেই, এতবছর ধরে অহল্যা ও গৌতম জীবিত ছিলেন তাহলে প্রশ্ন হয়, রামচন্দ্রের সমসাময়িক তাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র হয় কিভাবে?

♣আবার খেয়াল করুন, এখানে গৌতম মুনি বহু সহস্র বছর আগেই বলে দিলেন যে রামচন্দ্র আসবেন, এখানেও প্রশ্ন ওঠে রাম যদি একজন ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে থাকেন তাহলে তার কথা নিশ্চিত ভাবে তার আগের কেউ জানবেন না।

রামসেতুর সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর আমরা নিশ্চিতভাবে রামকে ঐতিহাসিক বলতে পারি। তাহলে সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও কাহিনিটি অপ্রাসঙ্গিক। এক্ষেত্রে বলা যায় পরবর্তীতে কেউ এই কাহিনী গৌতম মুনিকে উপলক্ষ করে বাল্মীকি মুনিকে দিয়ে বলিয়েছেন।

♣আবার, ৪৯/১-৪ শ্লোকগুলোতেও আমরা দেখি যে, এখানে দেবতাদের অপমান করা হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে অন্যের তপস্যার বিঘ্ন ঘটানো নাকি দেবতাদের কাজ। এখন বিদ্বানদের যদি দেবতা বলা হয় তাহলে মুনি ঋষিদের তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানো কি কোনভাবে দেবকার্য হতে পারে? আশা করি উত্তরটা হবে, "না"।

♣আরেকটা মজার ব্যাপার আছে, আমরা বাল্মীকি রামায়ণের আদিকাণ্ডে ১ও ৩ নং অধ্যায়ে পুরো রামায়ণের একটা টেবিল অফ কনটেক্সট পেয়ে যাই, আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেখানে অনেক ছোটখাটো ঘটনার বর্ণনা থাকলেও এই প্রসঙ্গ কোথাও নেই।

তাহলে এই অসঙ্গতিগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে এখানে ইন্দ্র অহল্যা কাহিনী বাল্মীকি রচিত হতে পারে না। 

তাহলে এবার চলুন যাচাই করি মূল ঘটনাটা কি এবং এখানে এই অংশকে বাদ দিলে কাহিনীর ধারা কিভাবে বজায় থাকবে?

মূল ব্যাপারটি হলো এখানে মিথিলায় যাওয়ার পথে "হয়ত" শুধুমাত্র গৌতম ও অহল্যার তপোবনের উল্লেখ বাল্মীকি মুনি করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে অন্য কেউ এই পৌরাণিক গাথাটির রচনা করেন, অন্য কোন সূত্র ধরে অথবা হতে পারে এরকম কোন উল্লেখই সেখানে ছিল না। মিথিলার নিকটে মুনির আশ্রম আছে এ কথা জেনে  পরবর্তীতে কেউ এই কাহিনী উল্লেখ করেছেন পরবর্তীতে শতানন্দ মুনির উল্লেখ দেখে। তবে আরেকটা ব্যাপার পরবর্তীতে আমরা রামায়ণে গৌতমপুত্র শতানন্দের কথা পেলেও তার মায়ের নাম হিসেবে অহল্যা পাইনা।

দুটো সম্ভাবনার যেকোনটা ঘটতে পারে কারন দুটো প্রেক্ষাপটের কোনটিতেই কাহিনী আটকে থাকবে না।

এই সূত্র প্রসঙ্গে মহর্ষি দয়ানন্দ শাস্ত্রোক্ত প্রমাণ সহকারে একটি মন্তব্য দিয়েছেন যা নিন্মরূপ-

মহর্ষি লিখছেন-

পূরাণকর্তারা উপরোক্ত(ইন্দ্র অহল্যা) কথার অনর্থ করিয়া লিখিয়াছেন, পরন্তু সত্যগ্রন্থে এরূপ কথা লিখিত নাই। আমি এস্থানে শতপথ ব্রাহ্মণ হইতে প্রকৃত ইন্দ্ৰ অহল্যা ব্যাপার কীরূপ, তাহা বর্ণন করিতেছি যথা :

🚩ইন্দ্রাগচ্ছেতি। গৌরাবস্কন্দিন্নহল্যায়ৈ জারেতি। তদ্যান্যেবাস্য চরণানি তৈরেবৈনমেতৎ প্রমুমোদয়িষতি।।১।। শতঃকাং০৩। অ০ ৩। ব্রা০ ৪ কং০ ১৮৷৷

🚩রেতঃ সোমঃ।।২।। শ০ কাং০ ৩। অ০৩, ব্রা০২। কং০১।।

🚩 সূর্য্যরশ্মিশ্চন্দ্রমা গন্ধর্ব (যজু০১৮।৪০) ইত্যপি নিগমো ভবতি ৷ সোऽপি গৌরুচ্যতে।।৪।। নিরু০ অ০ ২ খং০ ৬।

🚩জার আ ভগম্ জারঃ ইব ভগম্ । আদিত্যোऽত্রজার উচ্যতে, রাত্রের্জরযিতা।৫।।নিরু০ অ০ ৩ খং০ ১৬।

🚩এষ এবেন্দ্রো য এষ তপতি । শ০কাং০১ অ০৬। ব্রা০৪ কং০১৮।

ভাষ্যম্ঃ - ইন্দ্রঃ সূর্য়ো য় এষ তপতি, ভূমিস্থান পদার্থাংশ্চ প্ৰকাশয়তি । অস্যেন্দ্রেতি নাম পরমৈশ্বর্যপ্রাপ্তের্হেতুত্বাৎ । স অহল্যায়া জারোऽস্তি। সা সোমস্য স্ত্রী। তস্য গোতম ইতি নাম। গচ্ছতীতি গৌরতিশয়েন গোরিতি গৌতম শ্চন্দ্ৰঃ ৷ তয়ো স্ত্রীপুরুষবৎ সম্বন্ধোऽস্তি। রাত্রিরহল্যা। কস্মাদ্ ? অহর্দিনং লীয়তেऽস্যাং তস্মাদ্রাত্রি রহল্যোচ্যতে ৷ স চন্দ্রমাঃ সর্বাণি ভূতানি প্রমোদয়তি, স্বস্ত্রিষাऽহল্যয়া সুখয়তি।

অত্র স সূর্য্য ইন্দ্রো, রাত্রেরহল্যায়া গোতমস্য চন্দ্রস্য স্ত্রিয়া জার উচ্যতে । কুতঃ ? অয়ং রাত্রের্জরয়িতা। ‘জুষ বয়োহানা’ বিতি ধাত্বর্থোऽভিপ্রেতোऽস্তি। রাত্রেরায়ুষো বিনাশক ইন্দ্ৰঃ সূৰ্য্য এবেতি মন্তব্যম্। (১-৬)।। 

ভাষ্যার্থঃ (ইন্দ্রোগচ্ছতি ইত্যাদির) তাৎপর্য্য এই যে, ইন্দ্র শব্দে সূৰ্য্য বুঝায়, এবং রাত্রিকে অহল্যা বলা যায়, তথা চন্দ্রমা গৌতম সদৃশ হইয়া থাকেন। এস্থানে রূপকালঙ্কার মতে রাত্রিকে চন্দ্রমার স্ত্রীরূপে বর্ণন করা হইয়াছে। চন্দ্রমা আপনার স্ত্রীর সহিত রাত্রিকালে সকল প্রাণীর আনন্দদায়ক হইয়া থাকে । এই রাত্রিকালের জার, আদিত্য অর্থাৎ সূৰ্য্য হইয়া থাকে, কারণ সূর্যের উদয় হইলেই, রাত্রি অন্তর্ধান হইয়া যায় অর্থাৎ চন্দ্রমাকে ছাড়িয়া দেয়, বিশেষতঃ সূর্য্যকে রাত্রীর জার এইজন্য বলা যায় যে, সূর্য্যের আগমনেই চন্দ্রমার ছাড়িয়া দেয়, সূর্য্যকে রাত্রীর জার এইজন্য বলা যায় যে, সূর্য্যের আগমনেই চন্দ্রমার সহিত রাত্রির শৃঙ্গার ভঙ্গ বা নষ্ট করাইয়া দেয়, এইজন্য রাত্রি চন্দ্র ও সূর্য্য, স্ত্রীপুরুষ ও জারকর্ত্তা রূপে রূপকালঙ্কার দ্বারা বর্ণিত হইয়াছে। যেরূপ স্ত্রীপুরুষ একত্রে থাকে, তদ্রূপ রাত্রি ও চন্দ্রমা একত্রিত হইয়া থাকে । চন্দ্রমাকে গৌতম এইজন্য বলা যায় যে উক্ত চন্দ্রমা অত্যন্ত বেগশালী এবং রাত্রিকে অহল্যা এই কারণে বলা যায় যে ঐ রাত্রিতে দিবস লয় হইয়া যায়, পুনরায় সূর্য্যই রাত্রির নিবৃত্তকারী, এজন্য সূর্য্যকে রাত্রির জার বলা যায়।

এবং সদ্বিদ্যেপদেশার্থালঙ্কারায়াং ভূষণরূপায়াং সচ্ছাস্ত্রেষু প্রণীতায়াং কথায়াং সত্যাং য়া নবীনগ্রন্থেষু পূর্বোক্তা মিথ্যা কথা লিখিতাস্তি, সা কেনচিৎ কদাপি নৈব মন্তব্যা হি, এতাদৃশ্যেऽন্যাশ্চাপি।

অর্থঃ এইরূপ চমৎকার রূপকালঙ্কারকে অল্পবুদ্ধি ও বিদ্যাহীন পুরুষেরা নষ্ট ও শ্রীভ্রষ্ট করাইয়া তাহার অনর্থ প্রকাশ করিয়া, সকল মনুষ্যের হানিকারক ফল প্রসব করাইতেছেন। এজন্য সজ্জনমাত্রেই পুরাণোক্ত মিথ্যা ও অনর্থযুক্ত বাক্য গুলিকে মূলের সহিত যেন ত্যাগ করেন।

তাহলে দেখা গেল শাস্ত্রীয় ভাবে একটি প্রাকৃতিক বর্ণনাকেই অতিরঞ্জিত করে গৌতম পত্নী অহল্যা ও ইন্দ্র চরিত্রকে কলুষিত করা হয়েছে।

অনেকে আবার মহর্ষির ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হবেন না, তারা একটু দেখে নিতে পারেন শ্লোকবার্তিকে আচার্য কুমারিল ভট্টও ঐ ঘটনাকে রূপক বলছে।

 এবার আমরা একটা তুলনামূলক বিচার করে দেখব, এই অংশকে বাদ দিলে উপরোক্ত অধ্যায় গুলো কোন রুপ নেয়-

এখান থেকেই শ্লোকের বর্ণনা শুরু-

পড়ার সময় অধ্যায় ও শ্লোক সংখ্যাগুলো খেয়াল করবেন।

বাল্মীকি রামায়ণ - আদিকাণ্ড 

৪৮ তম অধ্যায় থেকে গৃহীত অংশ-

১) ‘সেখানে বিশ্বামিত্র সুমতির পরস্পর সাক্ষাৎকালে পরস্পর কুশল বিনিময় করে আলাপান্তে সুমতি মুনিবরকে বললেন—

২) “হে মুনিবর ! আপনার সৌভাগ্য বর্ধিত হোক। এই কুমার দুজন দেবতার ন্যায় পরাক্রমশালী, হস্তী ও সিংহের ন্যায় ধীর অথচ অপ্রতিহত গতিসম্পন্ন এবং ব্যাঘ্র ও বৃষের তুল্য বীর।

৩)“পদ্মপত্রের ন্যায় বিশাল নেত্রবিশিষ্ট এবং নবীন যৌবনপ্রাপ্ত অশ্বিনীকুমারদ্বয়সদৃশ রূপবান কুমারদ্বয় তরবারি তূণীর এবং ধনুর্ধারণ করে আছে।

৪) “হে মুনিবর! দেবলোক থেকে স্বেচ্ছায় যেন দুজন দেবতা পৃথিবীতে নেমে এসেছেন ! কেনই বা এঁরা পায়ে হেঁটে এখানে এসেছেন ? কী কারণ! এঁরা কারই বা পুত্র?

৫) “আকাশকে চন্দ্র এবং সূর্য যেমন ভূষিত করে সেইরকম, হৃদ্‌গত ভাব ও আচরণে পরস্পর সদৃশ এই কুমারদ্বয় এই দেশকে অলঙ্কৃত করেছেন।

৬) “শ্রেষ্ঠ অস্ত্রধারী বীর এই নরশ্রেষ্ঠদ্বয় কেন এই দুর্গম পথে এসেছেন, তা আমি যথার্থত শুনতে ইচ্ছা করি।

৭) ‘তাঁর (রাজা সুমতির) সেই কথা (জানবান ইচ্ছা) শুনে মহর্ষি বিশ্বামিত্র, সিদ্ধাশ্রমে তাঁদের বাস এবং রাক্ষসবধের সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথ বললেন (জানালেন)। বিশ্বামিত্রের সেই কথা শুনে রাজা অত্যন্ত বিস্মিত হলেন।

৮) ‘মহাবলশালী এবং সেব্য রাজা দশরথের পুত্রদ্বয়কে অতিথিরূপে পেয়ে রাজা সুমতি বিধিপূর্বক তাঁদের আতিথ্য সৎকার করলেন।

৯) ‘অনন্তর রঘুবংশীয় কুমারদ্বয় সুমতির নিকট উত্তমরূপে সশ্রদ্ধ অভ্যর্থনা প্রাপ্ত হয়ে সেখানে বিশালা নগরীতে একরাত্রি বাস করলেন এবং তারপর মিথিলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

১০) ‘রাজা জনকের সেই কল্যাণময়ী নগরী দর্শন করে মহর্ষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গী মুনিরা সকলে সাধু সাধু বলে সেই নগরীর সশ্রদ্ধ প্রশংসা করলেন। (♻️)

এই অধ্যায়ের বর্ণনা এখানেই সমাপ্ত বলে আমার ধারণা।

এবার মনোযোগ দিয়ে এই অধ্যায়ের নিচে উল্লেখিত অতিরিক্ত শ্লোকগুলো খেয়াল করুন। আমার মতে এই অংশ বাদ যেতেও পারে আবার থেকে যেতেও পারে। দুটোরই কারণও নিচে দেয়া হলো।

১১) ‘সেখানে মিথিলার উপকণ্ঠে উপবনে একটি প্রাচীন নির্জন রমণীয় আশ্রম দেখে রাঘব রামচন্দ্র মুনিবর বিশ্বামিত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন—

১২) ‘এই আশ্রমসদৃশ স্থানটি মুনিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত কেন ? এটি পূর্বে কার আশ্রম ছিল ? ভগবন্ ! আমি এই সকল বিষয় শুনতে ইচ্ছা করি।”

১৩) ‘রাঘব রামচন্দ্রের সেই কথা শুনে বাকপটু মহাতেজস্বী মহর্ষি বিশ্বামিত্র প্রত্যুত্তরে বললেন—

১৪ নং শ্লোক বাদ, কেননা আশ্রমের পরিচয় না দিয়ে নিশ্চয়ই বাল্মিকী অভিশাপের কথা আগেই আনবেন না?

১৫) “হে নরবর রামচন্দ্র ! পূর্বে মহাত্মা গৌতমের স্বর্গসদৃশ এই আশ্রমটি দেবতাদের দ্বারাও সশ্রদ্ধ প্রশংসিত ছিল।

১৬) “হে মহাযশস্বিন রাজপুত্র (রাম) ! পূর্বে এখানে (এই তপোবনে) মহর্ষি গৌতম স্ত্রী অহল্যার সঙ্গে অনেক অনেক বর্ষব্যাপী তপস্যা করেছিলেন।

(♻️) উপরের ১১ থেকে ১৬ এই শ্লোকগুলোর উপরে মন্তব্যঃ

উপরের ১০ নং শ্লোকটি লক্ষ্য করুন- সেখানে বলা হচ্ছে মুনি ঋষিরা মিথিলা নগরীতে প্রবেশ করে সেই নগরীর প্রশংসা করলেন। অর্থাৎ তারা নগরীতে ঢুকে গেছেন এই বর্ণনা মোতাবেক। তাহলে নগরীতে ঢুকে গিয়ে আবার নগরীর উপকণ্ঠে কী হল সেই বর্ণনা আশাটা অপ্রসঙ্গিক নয় কি?  দ্বিতীয়ত দেখুন ৫০ তম অধ্যায়ের ১ নং শ্লোকের বর্ণনা। সেখানে দেখা যাচ্ছে  এরপর তারা উত্তর-পূর্বকোণ অভিমুখে গিয়ে মিথিলারাজ জনকের যজ্ঞশালায় উপস্থিত হলেন।

তাহলে এই শ্লোকগুলো বিবেচনা করে পেলাম সুমতির ওখানে রাত কাটিয়ে তারা মিথিলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এরপর মিথিলায় পৌছে নগরীর শোভা দর্শন করতে করতে নগরীর উত্তর-পূর্বকোণে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হন। তাহলে উপরোক্ত ১১-১৬ নং শ্লোকগুলো মূল বর্ণনায় আসবে না।

এবার পাঠক আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, আচ্ছা আমরা তো উপরে গৌতম মুনির কোন প্রসঙ্গই আনিনি তাহলে কেন এখানে এমন একটা কাহিনী কোন সূত্র ছাড়াই আসবে?

এর উত্তর হলো সূত্র এখানে নেই কিন্তু অন্য একস্থানে আছে। ৫১ তম অধ্যায়ের ২ নং শ্লোক দেখুন সেখানে শতানন্দমুনির পরিচয় দেয়া হচ্ছে মহর্ষি গৌতমের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে। আবার মিথিলার কাছেই গৌতম মুনির আশ্রম ছিল বলে লোকমুখে প্রচারিত ছিল/আছে।

 এখন কোন একজন হয়ত উপরে উল্লেখিত শতপথ ব্রাহ্মণের কাহিনীটা শুনে অনুধাবন না করতে পেরে/ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এখানে এই গৌতম মুনির সাথে অহল্যা আর ইন্দ্রকে জুড়ে দিয়ে পুরো গল্পটা বানান। সেখান থেকেই প্রচার হয় এই ইন্দ্র অহল্যা কাহিনী এবং গৌতমের পত্নীর নাম অহল্যা। যেখানে এর মূল উৎস শতপথে আছে নিতান্তই একটা প্রাকৃতিক বর্ণনা হিসেবে। আমার মতে শতপথের এই কাহিনীই যথার্থ।

দ্বিতীয় আরেকটা ঘটনা হতে পারে- আলোচনার জন্য এই ঘটনার আমি নাম দিলাম "মুনিকল্পনা"।

গৌতম ঋষির পত্নীর নাম অহল্যা কিনা তার আর কোন প্রমাণ রামায়ণে আর নেই। আছে স্কন্দপুরাণের মহেশ্বর কাণ্ড ও মহাভারতে, দ্বিতীয় একটা প্রাকৃতিক বর্ণনা হিসেবে শতপথ ব্রাহ্মণে। কিন্তু এগুলো বাদ দেয়ার কারন হলো- শতপথে বর্ণিত প্রাকৃতিক বর্ণনা কাকতালীয়ভাবে বাস্তবের মিলে যাওয়াটা অসম্ভবই বটে। তাও রেখে দিলাম কারো বাস্তবিক মনে হলে গ্রহণ করবেন। কারন এই অংশ থাকা বা বাদ যাওয়ায় ঘটনায় প্রভাব পড়বে না।

কিন্তু যদি ধরেও নেই তার স্ত্রীর নাম অহল্যাই তাহলে এই অধ্যায়ে ১১-১৬ এই শ্লোকগুলো যুক্ত হবে বর্ণনায়!

কিন্তু খেয়াল করুন এই অংশটা আনলে কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যদিও রামায়ণের আরো অনেক স্থানে এরকম অমীমাংসিত অংশ আছে।একে তো নগরীতে ঢোকার পর এখানে আবার উপকণ্ঠে কি হচ্ছে তার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যা অসম্ভব, দ্বিতীয়ত,  প্রাচীন শতপথে একটা প্রাকৃতিক বর্ণনায় গৌতম ও তার পত্নী হিসেবে অহল্যাকে কল্পনা করা হয়েছে তাহলে পরবর্তীতেও  একইরকম ভাবে হুবুহু স্বামী স্ত্রী হওয়াটা নিছক কাকতালীয় আমার দৃষ্টিতে। 

তবে যদি এই শ্লোকগুলো গ্রহণযোগ্য হয় তবে ধারণা করা যায়, গৌতম অহল্যা (আদোও তার নাম অহল্যা কিনা তা নিশ্চিত নই, এই নাম লোকপ্রসিদ্ধিও হতে পারে শতপথের ঐ রূপক  কাহিনী অনুসারে) দুজনে এখানে হয়ত ছিলেন, তাদের দেহত্যাগের পর শতানন্দ মুনিও মিথিলার রাজপ্রাসাদে থাকছেন তাই আশ্রম খালি পরে ছিল। তাই রাম এই প্রশ্নটা করেছিলেন যে কেন এই আশ্রম খালি। এখানেও ইন্দ্রের প্রসঙ্গ আসাটাই অবান্তর।

তাহলে এখানে দুটো সিদ্ধান্ত হতে পারে -

১) গৌতম মুনির আশ্রমের কথা বাল্মীকির রামায়ণে ছিল না বরং পরে কেউ এনেছে

২) হয়ত আশ্রমের কথা ছিল কিন্তু কাহিনীটা অসম্পূর্ণ দেখে কেউ শতপথের ঐ সুত্রটা দিয়ে এই গল্পটা ফেদেছে।

এরপরের,

৪৯ অধ্যায় সম্পূর্ণই বাদ।

এরপর,

৫০ অধ্যায়ের গৃহীত অংশ-

১) ‘অতঃপর মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে পুরোভাগে নিয়ে শ্রীরামচন্দ্র লক্ষ্মণের সঙ্গে মহর্ষি গৌতমের আশ্রম থেকে উত্তর-পূর্বকোণ অভিমুখে গিয়ে মিথিলারাজ জনকের যজ্ঞশালায় উপস্থিত হলেন।

এই শ্লোকটা নিয়ে আমি দুটো অনুবাদ দেই, একটা আমার গৃহীত অংশে, আরেকটা হলো মুনিকল্পিত অংশের জন্য।

প্রথমেই আমার গৃহীত অংশ!

এখানে, "মহর্ষি গৌতমের আশ্রম থেকে" এই অংশটুকুকে গীতাপ্রেসের অনুবাদে আমার অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। কারন যদি উপরে গৌতম মুনির প্রসঙ্গ থাকে তাহলেই এই অংশ কাহিনীর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যাবহার করা যায় অন্যথায় নয়। মূলে এই অংশের উল্লেখ পাইনি, এই কারণে নিচে আরেকটা পদার্থ+অনুবাদ দিলাম, একটু দেখে জানাবেন।

1. tataH = then; raamaH saumitriNaa saha = Rama, along with Soumitri; vishvaamitram puraskR^itya = keeping Vishvamitra afore; praak uttaraam gatvaa = going to north east [direction] ; [janakasya] yaj~navaaTam upaagamat = neared [Janaka's] Vedic-ritual hall.

Rama then travelled along with Lakshmana towards northeast direction keeping Vishvamitra afore and neared the hall of Vedic ritual of Janaka in Mithila kingdom. [1-50-1]

এই হিসেবে "মহর্ষি গৌতমের আশ্রম থেকে" অংশটুকু  গীতাপ্রেসের অনুবাদক পূর্বের কাহিনীর সাথে(যা আমার দৃষ্টিতে মূলে নেই) মেলবন্ধন তৈরির জন্য রেখেছেন।

দ্বিতীয় মুনিকল্পিত অংশের জন্য দেখা যায়- এই অনুবাদ ঠিক আছে কারণ উপরে অল্প হলেও কাহিনীতে গৌতম-অহল্যার কথা আছে। কেউ মুনিকল্পিত অংশ রাখলে এটা বিবেচনায় রাখবেন।

এরপর,

২-৪) ‘তখন লক্ষ্মণের সঙ্গে একসঙ্গে শ্রীরামচন্দ্র মুনিশ্রেষ্ঠ | বিশ্বামিত্রকে বললেন –“হে মহাত্মন্ ! মহাত্মা জনকের যজ্ঞের সমারোহ প্রশংসনীয়। এখানে নানাদিগ্‌ দেশবাসী  বেদ-অধ্যয়নশীল ব্রাহ্মণদের সমাগম এবং শতশত পূৰ্ণ ঋষিদের বাসস্থান দেখা যাচ্ছে। অতএব হে ব্রহ্মন্ ! এমন  কোনও স্থান নির্দিষ্ট করুন যেখানে আমরাও অবস্থান করতে পারি।”

৫) ‘শ্রীরামচন্দ্রের কথা শুনে মহামুনি বিশ্বামিত্র, জলের সুবিধা আছে এমন নির্জনস্থানে বাসের ব্যবস্থা করলেন।

৬-৭) ‘মহর্ষি বিশ্বামিত্র এসেছেন শুনে, অনিন্দ্যচরিত্র নৃপশ্রেষ্ঠ জনক মহাত্মা ঋত্বিকগণের কুলপুরোহিত শতানন্দকে পুরোভাগে নিয়ে সত্বর সবিনয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং ধর্মানুসারে তাঁকে ধর্মীয় অর্ঘ্য প্রদান করলেন।

৮-৯) “তিনি (বিশ্বামিত্র) মহাত্মা জনকের আতিথ্য প্রতিগ্রহণ করে রাজার কুশলবার্তা এবং যজ্ঞের নির্বিঘ্নতা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। অতঃপর উপাধ্যায়সহ পুরোহিত ও মুনিদেরও কুশল জিজ্ঞাসা করে সেই ঋষিদের সঙ্গে সানন্দে মিলিত হলেন।

১০) ‘তখন রাজা জনক কৃতাঞ্জলি হয়ে মুনিশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্রকে বললেন –“ভগবন্! আপনি মুনিপুঙ্গবদের (শ্রেষ্ঠ মুনিদের) সঙ্গে আসন গ্রহণ করুন।”

১১-১২) ‘রাজা জনকের প্রার্থনানুসারে মহামুনি বিশ্বামিত্র  উপবেশন করলেন। অতঃপর কুলপুরোহিত, যজ্ঞের ঋত্বিকগণ এবং মন্ত্রিগণসহ রাজাও চতুর্দিকে পরিবেষ্টন করে যথোচিত আসন গ্রহণ করলেন।

১৩-১৪) ‘মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে সেখানে উপস্থিত দেখে রাজা জনক বললেন—“দেবগণ আজ আমার যজ্ঞের আয়োজন সফল করেছেন। আজ মহাত্মার দর্শনে আমি যজ্ঞফল প্রাপ্ত হয়েছি। হে ব্ৰহ্মন্ ! মুনিগণসহ মুনিশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র  আমার যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হওয়ায় আমি ধন্য এবং অনুগৃহীত।

১৫) “হে ব্ৰহ্মর্ষে ! মনীষিগণ বলেছেন, আমার দীক্ষার জন্য নির্ধারিত সময়ের আর বারোদিন অবশিষ্ট আছে। হে কুশিকনন্দন ! তারপরই আপনি যজ্ঞের ভাগগ্রহণকারী দেবগণকে দেখতে পাবেন।”

১৬) ‘মুনিবরকে এই কথা বলে সংযতচিত্ত রাজা জনক আনন্দোজ্জ্বলমুখে কৃতাঞ্জলি হয়ে আবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন-

১৭-২১) “হে ঋষে ! আপনার তপস্যা শুভময় হোক ! হে মুনিবর! দেবতুল্য পরাক্রমশালী, হস্তীর ন্যায় দৃঢ় অথচ ধীর গতিসম্পন্ন, কিন্তু ব্যাঘ্র ও বৃষ তুল্য বীর, শ্রেষ্ঠ অস্ত্রসকল এবং খড়গ তূণীর ও ধনুর্ধারী বীর, এরা কারা ? নবযৌবনপ্রাপ্ত এবং পদ্মপত্রের ন্যায় বিশাল নয়নদ্বয়যুক্ত, এরা রূপে অশ্বিনীকুমারদ্বয় তুল্য ; এদের দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে দুজন দেবতা যেন স্বেচ্ছায় মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছেন। চন্দ্র-সূর্য যেমন আকাশের সৌন্দর্য বিধান করে, এরা দুজন তদ্রূপ আমার এই দেশের সৌন্দর্য বিধান করেছে। কাকপক্ষধর (সুন্দর জুল্পিধারী) বীর, পরস্পর হৃদয়ের ভাবপ্রকাশে-তুল্যরূপ এই কুমারদ্বয় কার পুত্র ? কেনই বা পদব্রজে এরা এখানে এসেছে ? এই সকল তথ্য আমি পুরাপুরি শুনতে ইচ্ছা করি।”

২২) ‘মহাত্মা জনকের সেই অনুরোধ শুনে, মহাত্মা ঋষি বিশ্বামিত্র বললেন– “এরা দুজন দশরথের পুত্র।”

এইখানে কিছু কথা আছে। ভালো করে মূল শ্লোক ও পদার্থ খেয়াল করুন-

২৩) সিদ্ধাশ্রমনিবাসঞ্চ রাক্ষসানাং বধং তথা।

তত্ৰাগমনমব্যগ্রং বিশালায়াশ্চ দৰ্শনম্॥

siddhaashramanivaasam ca = stopover in Accomplishment Hermitage, also; tathaa = like that; raakSasaanaam vadham = elimination of demons; avyagram tatra aagamanam = to coming there indefatigably - travelling with him; vishaalaayaaH darshanam ca = beholding City of Vishaala, also;

অর্থাৎ -

‘অতঃপর মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাম-লক্ষ্মণের সিদ্ধাশ্রমে বাস, রাক্ষস নিধন, ধীরে সুস্থে বিশালানগরীতে আগমন এবং ঐ নগরী দর্শন, 

এরপরে ২৪ নং এর এই একটা লাইন-

মহাধনুষি জিজ্ঞাসাং কৰ্তৃমাগমন তথা৷৷

এবং মহান ধনুকটির বিষয়ে জানবার জন্য মিথিলায় আগমন—এই সকল বিষয় জানালেন।

অর্থাৎ ২৩ ও ২৪ এর শেষ লাইন এক করলে হয়-

সিদ্ধাশ্রমনিবাসঞ্চ রাক্ষসানাং বধং তথা।

তত্ৰাগমনমব্যগ্রং বিশালায়াশ্চ দৰ্শনম্।

মহাধনুষি জিজ্ঞাসাং কৰ্তৃমাগমন তথা৷৷

অর্থাৎ,  অতঃপর মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাম-লক্ষ্মণের সিদ্ধাশ্রমে বাস, রাক্ষস নিধন, ধীরে সুস্থে বিশালানগরীতে আগমন এবং ঐ নগরী দর্শন, এবং মহান ধনুকটির বিষয়ে জানবার জন্য মিথিলায় আগমন—এই সকল বিষয় জানালেন।

🚩এখানে আমার মতে ২৩ এর দুইলাইন ও ২৪ এর শেষ লাইন মিলেই একটা শ্লোক। অর্থাৎ অহল্যাকে দর্শন ও গৌতম মুনির আগমন সংক্রান্ত, "অহল্যাদর্শনঞ্চৈব গৌতমেন সমাগমম্" এই লাইন বাদ যাবে।

এখন তিন লাইনে শ্লোক হয় কিনা এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আমরা দেখতে পারি এই অধ্যায়ের ১৮ নং শ্লোকটিকে সেখানে তিন লাইনেই শ্লোক বলা হচ্ছে।

শ্লোকটি হলো-

গজতুল্যগতী বীরৌ শার্দূলবৃষভোপমৌ।

পদ্মপত্রবিশালাক্ষৌ খড়্গাতৃণীধনুর্ধরৌ।

অশ্বিনাবিব রূপেণ সমুপস্থিতযৌবনৌ৷৷ ১৮

এরপর,

২৫) ‘মহাতেজস্বী মহর্ষি বিশ্বামিত্র মহাত্মা জনককে এইসব বিষয় অবগত করে বিরত হলেন।’

এখানে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি। এরপর,

৫১তম অধ্যায় থেকে গৃহীত অংশ-

১) ‘প্রজ্ঞাবান বিশ্বামিত্রের সেই কথা শুনে মহাতেজস্বী, মহান তপস্বী শতানন্দ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন।

২) মহর্ষি গৌতমের জ্যেষ্ঠ পুত্র শতানন্দ তপস্যাহেতু সমুজ্জ্বলপ্রভ (তপস্যাহেতু উজ্জ্বল প্রভাযুক্ত)। তিনি রামচন্দ্রকে দেখামাত্রই অত্যন্ত বিস্ময়ান্বিত হলেন।

বিঃদ্রঃ এই শ্লোকে মহর্ষি গৌতমের নাম ও তার পূত্র হিসেবে শতানন্দ মুনির উল্লেখ আছে। আবার মিথিলার কাছেই গৌতমের আশ্রম ছিল বলে প্রসিদ্ধ আছে। হয়ত এটাকে উপজীব্য করেই কেউ শতপথ ব্রাহ্মণের কাহিনীকে এখানে মিশিয়ে দিয়েছে। এই শ্লোকের উপরে ভিত্তি করেই উপরে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম।

এরপর মাঝের শ্লোকগুলো পরবর্তীতে সংযোজিত কারন অহল্যার কাহিনীই বাদ। এরপর-

১২) ‘ধীমান (প্রজ্ঞাবান) বিশ্বামিত্রের সেই কথা শুনে মহাতেজস্বী শতানন্দ রামকে বললেন—

১৩) “হে নরশ্রেষ্ঠ ! তোমাকে স্বাগত জানাই। আমার সৌভাগ্যবশত তুমি অপরাজেয় মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে পুরোভাগে (সম্মুখে) নিয়ে এখানে এসেছ।

১৪)“মহাতেজস্বী বিশ্বামিত্র তপস্যার প্রভাবে অচিন্তনীয় কর্মসকল সাধন করেছেন। অপরিমিত তপ প্রভায় সমুজ্জ্বল এই ব্রহ্মর্ষি ! এঁকে আমি জগতের পরম আশ্রয় বলে মনে করি।

১৫) “রাম ! এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে অধিকতর ধন্য কেউ নেই, যেহেতু যিনি মহতী তপস্যা করেছেন, সেই কুশিকনন্দন বিশ্বামিত্র তোমার রক্ষক।

১৬) “এই ধর্মাত্মা বহুকাল যাবৎ শত্রুজয়ী রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী, ধর্মজ্ঞ ও বিদ্বান নৃপতি।

১৭) “কুশ নামে রাজা ছিলেন প্রজাপতির পুত্র। কুশের পুত্র ছিলেন বলবান ও ধার্মিক কুশনাভ।

এরপর থেকে বাকি অংশ-

এবার পুরো কাহিনীর উপর একটা মন্তব্য করা যাক!

যদি মূল রামায়ণে এই অংশ নাই থাকে তবে পরবর্তীতে এটা যোগ করার কারণ কী?

এই ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত হলো, বৈদিক যুগের শেষের দিকে ইন্দ্র নামটি পরমেশ্বরের এক নাম থেকে প্রধান দেবতাজ্ঞানে চলে এসেছিল। পৌরাণিক যুগে ইন্দ্রকে সরিয়ে দিয়ে বিষ্ণুকে সেই স্থান দেয়ার একটা প্রয়াস দেখা যায় বিশেষত বৈষ্ণবধারার গ্রন্থগুলোতে। আবার রাম জনসমাজে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কোন একজন হয়ত এখানে শতপথের ঐ সূত্রকে কপোলকল্পিত বিশ্লেষণ করে শ্রীরামের মহিমা বৃদ্ধিতে ব্যাবহার করেছে। এতে একদিকে ইন্দ্রের দুর্নাম করাও হলো আর শ্রীরামের মহ?