"গুরুই পথপ্রদর্শক"

"গুরুই পথপ্রদর্শক"

মনুষ্য জন্মমাত্রই সকল জ্ঞান, প্রজ্ঞা কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে নাহ। নিজ হৃদয়ে জাগ্রত সংশয়, প্রশ্ন সে সত্যান্বেষীকে উদ্বেলিত করে তোলে। সেজন্য, সে সত্যান্বেষীর প্রয়োজন একজন পথপ্রদর্শক। যে শিষ্যের অন্তরের মধ্যে লুকায়িত গুণকে উপলব্ধি করতে পারে এবং সঠিক দিশা প্রদান করতে পারে। নচেৎ, এই মনুষ্য জন্মে সে অন্ধকারে পতিত একজন অন্ধের ন্যায় দিকভ্রান্ত হতে পারে। সেজন্য তৈত্তিরীয় উপনিষদে পরমাত্মার নিকট গুরু-শিষ্য উভয়ের প্রার্থনা যে উভয়কে রক্ষা, ব্রহ্মবিদ্যা অর্জনে সক্ষম হতে পারে। 

"ও৩ম্ সহ নাববতু। সহ নৌ ভূনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ।
তেজস্বি নাবধীতমস্তু। মা বিদ্বিষাবহৈ।।"
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

- তৈত্তিরীয় উপনিষদ, শান্তিপাঠ  

অর্থাৎ,  হে পরমেশ্বর! আমাদের গুরু-শিষ্য উভয়কে একসাথে রক্ষা করুন, আমাদের উভয়কে একসাথে ব্রহ্মবিদ্যারূপ ফল ভোগ করান, যেন আমরা উভয়েই একসাথে সামর্থ্য অর্জন করতে পারি। আমাদের উভয়ের অধ্যয়নকৃত বিদ্যা তেজসম্পন্ন অর্থাৎ তাৎপর্যপূর্ণ হোক, আমরা উভয়ে যেন কখনো কারো সাথে দ্বেষ না করি।

কিন্তু প্রশ্ন গুরু কাহাকে বলা হয় ⁉️

যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে বলা হয়েছে,

"স গুরুর্যঃ ক্রিয়াঃ কৃত্বা বেদমস্মৈ প্রযচ্ছতি। উপনীয় দদদ্বেদমাচাৰ্য্যঃ স উদাহৃতঃ।।" যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি - ১/৩৪

অর্থাৎ,  যিনি গর্ভাধান হইতে উপনয়ন পর্যন্ত সকল সংস্কার করিয়া বেদ অধ্যাপন করেন, তিনি গুরু। যিনি কেবল উপনয়ন দিয়া বেদ শিক্ষা দেন, তাঁহাকে আচার্য্য বলে।

গুরুর যোগ্যতা:

"তে পূতাসো বিপশ্চিতঃ সোমাসো দধ্যাশিরঃ ।
সূরাসো ন দর্শতাসো জিগত্নবো ধ্রুবা ঘৃতে ॥"
-সামবেদ ১১০২

অর্থাৎ, যারা পবিত্র,  বিদ্বান, জ্ঞানের ধারণকর্ত্তা ও পরিপক্ব, পরমাত্মাতে আশ্রিত,  সূর্যের  ন্যায় দর্শনীয় অর্থাৎ কান্তিমান অধ্যাত্ম সত্যের মার্গ তথা দৃষ্টি  প্রদানকারী, গতিমান্ ও কর্মণ্য, ধীর এবং বিবেকবান তারাই বিনয় , বিদ্যা,  ধর্ম, আদির প্রেরণা দানকারী বিনয়স্বভাবযুক্ত গুরু হবেন ॥

অর্থাৎ গুরুর বৈশিষ্ট্য হলো -

▫️বিনয়ী ▫️ পবিত্র ▫️ কর্মঠ ▫️বিদ্বান ▫️জ্ঞানের ধারক▫️বিচারবুদ্ধিতে পরিপক্ব ▫️কান্তিমান ▫️ সত্যের পথপ্রদর্শক ▫️ সর্বদা পরমাত্মার শরণাগত▫️ বিবেকবান
▫️সত্যে অটল

গুরু-শিষ্যের মধ্যে সম্পর্ক পরম পবিত্র ও গভীর। জ্ঞান অর্জনের মার্গে গুরু শিষ্যের পথপ্রদর্শক।

"যুজে বাং ব্রহ্ম পূর্ব্যং" - যজুর্বেদ ১১/৫

অর্থাৎ, আমি সনাতন ব্রহ্ম, তোমাদের গুরু-শিষ্য দুজনকেই উপাসনাতে যুক্ত করছি।

গুরু একজন অজ্ঞকেও তার প্রজ্ঞা দ্বারা সঠিক জ্ঞান মার্গে পরিচালিত করতে সক্ষম।

"এতদ্ বৈ ভদ্রমনুশাসনস্যোত স্রুতিং বিন্দত্যংজসীনাম্"
- ঋগ্বেদ ১০.৩২.৭

অর্থাৎ, অজ্ঞ ব্যক্তিও গুরুর দ্বারা অনুশাসিত হয়ে জ্ঞান-প্রকাশক বাণী লাভ করে।

তবে সকল গুরুর পরম শ্রদ্ধেয় গুরু সেই পরমাত্মা। যিনি বিদ্যার ধারক ও জনক। মহর্ষি পতঞ্জলি যোগসূত্রের সমাধিপাদে এই জগতের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকেই গুরু বলেছেন,

"তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞবীজম্।
স পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেন অনবচ্ছেদাৎ।
তস্য বাচকঃ প্রণবঃ।"  - যোগসূত্র : ১.২৫-২৭

অর্থাৎ, ঈশ্বরই নিরতিশয়ত্ব প্রাপ্ত সর্বজ্ঞবীজ।তিনি কালের দ্বারা অবিচ্ছিন্ন পূর্ব পূর্ববর্তী অনাদিকাল থেকেই গুরু। প্রণব বা ওঁকারই তাঁর বাচক।

পরিশেষে আমাদের সকলের জানা উচিত, একজন গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ও তাহার মাহাত্ম্য। গুরু সন্দীপনী জ্ঞানের দ্বারা যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর্যশ্রেষ্ঠ হয়েছিলেন, বিশ্বামিত্র মুনির শিক্ষায় শ্রীরাম হয়েছিলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম, দ্রোণাচার্যের জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জুন হয়েছিলো সর্বশ্রেষ্ঠ বীর, যুধিষ্ঠির হয়েছিলেন ধর্মরাজ। অর্থাৎ, আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক একমাত্র গুরু। সেজন্য, নিজ শিক্ষা গুরুর প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল হওয়া কর্তব্য।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

🔸সনাতন ধর্ম ও নারী 💐

সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️

▪️একাদশী" কি শাস্ত্র সম্মত ❓