সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে ৩৩ কোটি দেবতা নাকি ৩৩ প্রকার দেবতার উল্লেখ রয়েছে ?

সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে ৩৩ কোটি দেবতা নাকি ৩৩ প্রকার দেবতার উল্লেখ রয়েছে ? 

নমস্কার সকল অমৃতের সন্তানগণ 🔥🚩 

সনাতন ধর্ম সর্বদা এক ও অদ্বিতীয় পরমাত্মার সর্বশ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে এবং তাহারই উপাসনা করে। তিনি সুমহান, সর্বজ্ঞ, অন্তর্যামী এবং একমাত্র উপাস্য। তবে সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে দেবতা বা দেবী শব্দের উল্লেখ রয়েছে। যা অনেক এর মনে সংশয়ের উদ্ভুত করে থাকে যে, মহান ঈশ্বর যদি এক ও অদ্বিতীয় হয়ে থাকে তাহলে দেবতা বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে। এরুপ সংশয়ের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন কুচক্রীমহল সনাতনীদের  বিভ্রান্ত করার প্রয়াস করে থাকে যে, সনাতন ধর্মে ৩৩ কোটি দেবদেবী রয়েছে এবং একজন মনুষ্যের পক্ষে এত দেবদেবীর উপাসনা করা কিভাবে সম্ভব? তাই এরুপ সংশয় নিবারণে প্রয়োজন সত্যকে জানার। কারণ, সত্য জানার মাধ্যমে অন্ধকার থেকে অমৃতে ফিরে আসা সম্ভব। 

দেবতা: নিরুক্তে দেব শব্দের বিবিধ অর্থ পরিলক্ষিত হয়।

''দেবো দানছা দীপনাথাদ্যোতনায়া দ্যুস্থানো ভবতীতি বা। য়ো দেবঃ সা দেবতা।'' - নিরুক্ত ৭:১৫ 

অর্থাৎ দেবের লক্ষণ হচ্ছে দান। সবার হিতার্থে যে দান করে, সে দেব বা দেবতা। 

দেবতার গুণ হচ্ছে দীপন অর্থাৎ প্রকাশ করা। সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি প্রকাশ করে বলে তাদের দেব বলা হয়। 

দেবতার কর্ম হচ্ছে দ্যোতন অর্থাৎ সত্যোপদেশ করা। যে মনুষ্য সত্য মানেন, সত্য বলেন এবং সত্য উপদেশ প্রদান করেন, তিনিই দেব। দেবের বিশেষত্ব হচ্ছে দ্যুস্থান বা ওপরে স্থিতি লাভ। তাই ব্রহ্মাণ্ডের ওপর স্থিতি লাভ করার জন্য সূর্যকে, সমাজের ওপর স্থিতি লাভ করার জন্য বিদ্বানকে এবং রাষ্ট্রের ওপর স্থিতি লাভ করার জন্য শাসকে দেব বা দেবতা বলা হয়। 

তাহলে দেবতা কয়জন? 
সত্যি কি দেবতা ৩৩ কোটি? 

বৈদিক সংস্কৃতত“কোটি” শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রকার। অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে দেব হচ্ছে তেত্রিশ প্রকার তেত্রিশ কোটি নয়। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী কোটি শব্দের অর্থ সংখ্যাবাচক হলেও সংস্কৃত অভিধানে এর অর্থ ভিন্ন।  তাই তেত্রিশ কোটি জন দেবতার কল্পনা নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। 

পবিত্র বেদ এ স্পষ্ট রুপে বলা হয়েছে, 

“ত্রয়স্ত্রিং শতাস্তুবত ভুতান্য শাম্যন্ প্রজাপতিঃ। পরমেষ্ঠ্যধিপতিরাসীত্‍।।” - যজুর্বেদ ১৪/৩১

অনুবাদঃ যাঁহার প্রভাবে গতিশীল প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রজার পালক, সর্বব্যপক ,অন্তরীক্ষে ব্যপ্ত, তাঁহার মহাভূতের তেত্রিশ প্রকার গুনের স্তুতি কর।

য়স্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা নিধিং রক্ষন্তি সর্বদা। 
নিধিং তমদ্য কো বেদ য়ং দেবা অভিরক্ষ।।
 - অথর্ববেদ ১০/৭/২৩ 

অর্থাৎ, যেই [পরমেশ্বরের] সংসারকে তেত্রিশ দেব সর্বদা রক্ষা করছেন। সেই সংসারকে আজ কে জানতে পারে, হে দেব! তুমি সর্বদা যার রক্ষাকারী হও।

উপরিউক্ত মন্ত্র সমূহ অধ্যয়ন করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে পবিত্র বেদ এ ৩৩ প্রকার দেবতার উল্লেখ রয়েছে, ৩৩ কোটি দেবতার নয়। 

শাস্ত্রে উল্লেখিত ৩৩ প্রকার দেবতা সমূহ: 

“অষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশদিত্যান্ত একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপতিশ্চ ত্রয়ত্রিংশাবিত্তি" [বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৯/২]

অর্থাৎ অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এই কয়জন মিলে একত্রিশ এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি মিলে তেত্রিশ দেব। 

অষ্ট বসু:- 

"অগ্নিশ্চ পৃথিবী চ বায়ুশ্চান্তরিক্ষং চাদিত্যশ্চ দ্যোশ্চ চন্দ্ৰমাশ্চ নক্ষত্রাণি চৈতে বসব"
- বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৯/৩

অর্থাৎ, অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, ভূলোক, চন্দ্র, নক্ষত্রপুঞ্জ এই অষ্ট বসু। কারণ মহাবিশ্বের সকল পদার্থ এদের মধ্যেই নিহিত আছে। সেই জন্য এদের নাম বসু। 

একাদশ রুদ্র:-

 "দশেমে পুরুষে প্রাণা আত্মৈকাদশস্তে:"

 - বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৯/৪

অর্থাৎ, পঞ্চ প্রাণ এবং পঞ্চ উপপ্রাণ এই দশ এবং জীবাত্মা মিলে একাদশ রুদ্র। এই এগারো দেহান্তকালে রোদন করায়, বলে এদের রুদ্র বলা হয়।  

পঞ্চপ্রাণ:- প্ৰাণ, উদান, সমান, ব্যান, অপান।
উপপ্রাণ:- নাগ, কুৰ্ম, কৃকল, দেব, ধনঞ্জয় এবং জীবাত্মা।  

দ্বাদশ আদিত্য:- 

"দ্বাদশ বৈ মাসাঃ" - বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৯/৫ 

অর্থাৎ, সম্বৎসরে যে বারো মাস রয়েছে, তারাই আদিত্য। কারণ এই সমস্তকে আদান করে যান। যেহেতু এই সমস্তকে আদান করে যান, অতএব তারা আদিত্য। 

দ্বাদশ আদিত্য হচ্ছে:- বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবন, ভাদ্রপদ, আশ্বিন, কার্তিক, মার্গশীর্ষ, পৌষ, মাঘ এবং ফাল্গুন,চৈত্র। 

ইন্দ্র ও প্রজাপতি:-

 "স্তনয়িত্বরেবেন্দ্রো" - বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/১/৬ 

অর্থাৎ, বিদ্যুৎ হচ্ছে ইন্দ্র। কারণ তা ঐশ্বর্যের সাধন। বিদ্যুৎ হতে গতি শক্তি, আলোক প্রকাশ, সমৃদ্ধি এবং সুখের সাধন প্রাপ্তি হয়।

"যজ্ঞঃ প্রজাপতিরিতি" - বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩।১৬] অর্থাৎ, যজ্ঞ হচ্ছে প্রজাপতি। কারণ এর দ্বারা বর্ষা হয়, প্রাণিদের সুখ মেলে। 

উপরন্তু বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝতে সক্ষম যে, সনাতন ধর্ম এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বর এর কথা বলা হয়েছে। দেবতা অর্থ কোনো আকৃতি ধারণকারী কেউ নন বরং দেবতা অর্থ সবার হিতার্থে যে দান করে, সে দেব বা দেবতা। এবং দেবতার গুণ হচ্ছে দীপন অর্থাৎ প্রকাশ করা। সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি প্রকাশ করে বলে তাদের দেব বলা হয়।

হে অমৃতের সন্তানগণ! আসুন শাস্ত্র অধ্যয়ন করি ও সত্যকে জেনে তাহার প্রচার করি।

🌱 VEDA

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ