শ্রী হনুমানজ্বী কি আদো কোনো পশু ছিলেন নাকি মনুষ্য ❓
মানুষ ইতিহাসে বন্দি, এবং ইতিহাস মানুষে।
— জেমস বাল্ডুইন এর উক্তি থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি আমাদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণার জন্য ইতিহাস কতটুকু প্রয়োজনীয়। সনাতনীদের ইতিহাস খুবই বর্ণিল এবং গৌরবের। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ইতিহাসও বহু বিতর্ক ও অভিযোগের সম্মুখীন হতে হয় যা ইতিহাসকে করে তোলে সংশয়ী।
তেমনি একটি ইতিহাস আমাদের গর্বের ও গৌরবের রামায়ণ। যা শুধু এক অনবদ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থই নয় বরং তার রয়েছে ন্যায়, নৈতিকতা ও কর্তব্যের এক আদর্শ। সে মহান গ্রন্থের একটি সুপ্রসিদ্ধ চরিত্র শ্রী হনুমানজ্বী। কিন্তু সে ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে রয়েছে কিছু সংশয়, বিতর্ক। যা দ্বারা অসৎ উদ্দেশ্যের মানুষরা রামায়ণকে করতে চায় কাল্পনিক এবং আমাদের আদর্শের ভিত্তিকে করতে চায় ভঙ্গুর।
তবে চলুন আজকে সে রহস্যকে দূর করে সত্যকে তুলে ধরার প্রয়াস করি সকলের নিকট।
নমস্কার সকল অমৃতের সন্তানগণ। বৈদিক অমৃত জ্ঞান প্রচারে নিয়োজিত VEDA পেজ এ আপনাদের স্বাগতম।
শ্রী হনুমানজ্বী কি মনুষ্য ছিলেন নাকি পশু?
আমরা কিছু প্রশ্ন-সমাধানের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি যে শ্রী হনুমান বানর (monkey) ছিল নাকি মনুষ্য!
যোগরূঢ় অর্থে "বানর" শব্দ দ্বারা 'বন মধ্যে উৎপন্ন হওয়া অন্ন ভোজনকারী' বুঝায় । যেমন পর্বত অর্থাৎ গিরিমধ্যে অবস্থানকারী এবং সেখানকার অন্ন গ্রহনকারী কে "গিরিজন" বলে। তেমনই বন মধ্যে উৎপন্ন হওয়া অন্ন ভোজনকারী ও অবস্থানকারীকে 'বানর' বলা হয়।
কিন্তু প্রচলিত সমাজে বানরশ্রেণী (monkey) মনুষ্যের ন্যায় কথা বলতে পারেনা, এটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ। এটি সাধারণ হইতে বিজ্ঞানমনস্ক ব্যাক্তিরাও মানেন যে, বানর (monkey) মনুষ্যের ন্যায় কথা বলতে পারে না এবং পারতোও না।
কিন্তু আমরা রামায়ণে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ পাই যে, শ্রী হনুমান জ্বী ছিলেন বিদ্বান ও জ্ঞানী।
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ম্ ঋচ্যমূক পর্বতে শ্রী হনুমানের সহিত প্রথম সাক্ষাৎকারে কথন করে, ভ্রাতা লক্ষ্মণকে বলেছেন -
নানৃগ্বেবেদবিনীতস্য নাযজুর্বেদধারিণঃ।
নাসামবেদবিদুষঃ শক্যমেবম্ প্রভাষিতুম্।।”
-------বাল্মীকি রামায়ণ-৪/৩/২৮
অনুবাদ : ইনি উচ্চকোটির বিদ্বান্ ব্যক্তি, কেননা ঋগ্বেদ অধ্যয়নে অনভিজ্ঞ, যজুর্বেদের জ্ঞানহীন এবং সামবেদের বোধ শূণ্য ব্যক্তি এরূপ পরিষ্কৃত কথন করতে পারবেন না।
নূনং ব্যাকরণং কৃত্স্নমনেন বহুধা শ্রুতম্।
বহু ব্যাহরতানেন ন কিঞ্চিদপশব্দিতম্।।
-------বাল্মীকি রামায়ণ-৪/৩/২৯
অনুবাদ : নিশ্চয়ই তিনি ব্যাকরণ শাস্ত্র অনেকবার অধ্যয়ন করেছেন, কারন এই যে - এতক্ষণ যাবৎ কথনের মধ্যে তিনি কোন ত্রুটিই করেননি।
উপরিউক্ত শ্লোক থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, শ্রী হনুমান এর বাচন ভঙ্গি এতই পরিমার্জিত ছিল যা স্বয়ং শ্রীরামকে মুগ্ধ করেছিলেন। এবং তিনি বলেছিলেন,
সংস্কারকমসম্পন্নামদুতামৰিলম্বিতাম্।
উচ্চারয়তি কল্যাণীং বাচং হৃদয়হারিণীম্॥
-------বাল্মীকি রামায়ণ-৪/৩/৩২
অনুবাদ : তাঁহার বাণী ব্যাকরণ দ্বারা সংস্কারিত, ক্রম সম্পন্ন তথা না তো খুবই ধীরে বলেছে আর নাতো খুব শীঘ্র বলেছে। তাঁহার বাণী (বাক্য) হৃদয়কে হর্ষিত করার মতো এবং খুবই মধুর।
স্বয়ম্ হনুমানজী অশোক বাটিকা মধ্যে সীতাকে নিজ পরিচয় দেবার পূর্বে চিন্তা করলেন যে-
যদি বাচম্ প্রদাস্যামি দ্বিজাতিরিব সংস্কৃতাম্।
রাবণম্ মন্যমানা মাম্ সীতা ভীতা ভবিষ্যতি।।
---------(বাল্মীকি রামায়ণ -৫/৩০/১৮)
অনুবাদ : যদি আমি দ্বিজাতির (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) ন্যায় পরিমার্জিত সংস্কৃত ভাষা প্রয়োগ করি তাহলে আমাকে রাবণ ভেবে, সীতা ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে যাবে।
তাহলে আমরা এখানে সত্যি জানতে পারি যে শ্রী হনুমান জ্বী অবশ্যই মনুষ্য ও বিদ্বান ছিলেন। কিন্তু শুধুই কি তিনি এমন সুযোগ্য, বিদ্বান ছিলেন? না! শুধু তিনি নন বরং সে সমাজে সুগ্রীব, অঙ্গদ ও তারা সহ অনেক বানরই বৈদিক বিদ্বান্ ছিলেন। অঙ্গদ সম্পর্কে হনুমানজী বলেছেন -
বুদ্ধ্যা হ্যষ্টাঙ্গয়া যুক্তম্ চতুর্বলসমন্বিতম্।
চতুর্দশ গুণম্ মেনে হনুমান্ বালিনঃ সুতম্।।
---------(বাল্মীকি রামায়ণ -৪/৫৪/২)
অনুবাদ : বালীপুত্র অঙ্গদ অষ্টাঙ্গ বুদ্ধিসম্পন্ন, চার প্রকার বলযুক্ত এবং রাজনীতির চৌদ্দ প্রকার গুণে সমলঙ্কৃত।
তাহলে এত গুণ সম্পন্ন ব্যক্তিরা কি কখনো পশু হতে পারে?
➡️ বানরদের কি মানুষের মতো আলাদা আলাদা নাম থাকে?
☞আমরা সকলেই জানি যে, মানুষের ন্যায় বানরদের আলাদা আলাদা নাম থাকেনা। কিন্তু রামায়ণে উল্লেখিত বানরদের আলাদা আলাদা নাম ছিল, যেমন -
ক. সুগ্রীব (বাল্মীকি রামায়ণ -৪/২/১)
খ. হনুমান (বাল্মীকি রামায়ণ -৪/২/১৩)
গ. বালী (বাল্মীকি রামায়ণ -৪/২/১৪)
ঘ.অঙ্গদ (বাল্মীকি রামায়ণ -৪/৫৪/১)
ঙ.তারা (বাল্মীকি রামায়ণ -৪/১৫/৬)........
বানর কি রাজা, রাজকুমার, মন্ত্রী হতে পারে?
রাজা, রাজকুমার, মন্ত্রী এইসকল যে কেবল মানুষ হয় /হয়েছিল সেটা সকলেই জানে এবং বানরের দ্বারা রাজা,মন্ত্রী আদি হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
কিন্তু রামায়ণে উল্লেখিত বানরদের, রাজা-রাজকুমার-মন্ত্রী হিসেবে বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন -
ক. 'বালী' ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের রাজা।
খ. 'অঙ্গদ' ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের রাজকুমার।(বাল্মীকি রামায়ণ -৪/১৫/১৫)
গ. 'সুগ্রীব'ও ছিল কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের রাজা।
তাহলে এখানে সে সংশয় নিবারণ হওয়া উচিত যে সে সমাজে সকলে মনুষ্য ছিলেন।
তবে একটি সংশয় নিবারণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যা নিবারণ না করলে এই আলোচনা পূর্ণতা পাবে না।
সংশয়: শ্রী হনুমানের লেজ
জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতী রামায়ণ ভাষ্যের টিপ্পনীতে লিখেছেন - 'লাঙ্গুল' ছিল বানরজাতির রাষ্ট্রীয় চিহ্ন, ইহাকে তাঁহারা খুবই শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন তথা ইহার অপমানকে জাতীয় অপমান মনে করতেন। কিন্তু সে লেজ যে বানরজাতির জন্য আভূষণ স্বরুপ ছিলো রাবণের কথায় স্পষ্ট হয়।
রাবণের সহিত শ্রী হনুমান যখন কথা বলছিল তখন এক পর্যায়ে রাবণ বলেছেন -
কপিনাং কিল লাঙ্গুলমিষ্টং ভবতি ভূষণম্।।
-------(বাল্মীকি রামায়ণ -৫/৫৩/৩)
অর্থাৎ বানর জাতি লোকের জন্য তাদের 'লাঙ্গুল' খুবই প্রিয় এবং উত্তম আভূষণ।
এবং আমরা সকলে জানি আভূষণ কখনোই শরীরের অঙ্গ নয়। রাবণ ইহাকেই জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছিলেন-(বা০ রা০-৫/৫৩/৪)। লাঙ্গুল বানরের লেজ সদৃশই ছিল, যা হনুমান ধারণ করেছিলেন।
উক্ত বিষয়ে ডা. শান্তিকুমার নানুরাম ব্যাস মত প্রকাশ করে বলেন,
বানরদের সংস্কৃতিকে মহান এবং সমুন্নত অঙ্কিত করা হয়েছে। সুগ্রীবের রাজ্যাভিষেক তথা বালীর অন্ত্যেষ্টি দুইই বৈদিক বিধিতে সম্পন্ন করা হয়েছে। সুগ্রীব, হনুমান তথা অঙ্গদের যে প্রভাবশালী চিত্রণ কবি [বাল্মীকি মুনি] করেছেন তা তাঁদের মহান সংস্কৃতির সূচক। বানরদের সম্পত্তি-বৈভব, বসনাভরণ, শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম-কর্ম তথা সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের বর্ণন হতে স্বাভাবিক নিষ্কর্ষ ইহাই হয় যে, রামায়ণকার রামের সহযোগীদের বস্তুত বানর (monkey) মানতেন না।
বানর জাতির নাম ১০৮০ বার উল্লেখ রয়েছে বাল্মিকী রামায়ণে এবং পর্যায়ক্রমে বনগোচর, বনকোবিদ, বনচারী, বনৌকস শব্দ সমূহ রয়েছে। তাহলে এটা স্পষ্ট যে বানর শব্দ monkey এর সূচক নয় বরং বনবাসীর দ্যোতক বিশেষ। এছাড়াও, বানর জাতির জন্য হরি শব্দ ৫৪০ বার, প্লবগ শব্দ ২৪০ বার, কপি শব্দ ৪২০ বার উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু এত প্রমাণ উপস্থাপন এর পরেও বানরদের মনুষ্য মান্য করতে বাধা এই লেজ। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তা আভূষণ স্বরুপ, কোনো শারীরিক অঙ্গ নয়। সেজন্যই শ্রী হনুমানের লেজ এ আগুন লাগানোর পরেও তাহার শারীরিক কষ্ট অনুভব হয়নি।
তবে মনুষ্য হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের বানর হিসেবে পরিচয় দানের উদ্দেশ্য কি?
এরুপ সংশয়ের নিবারণে গবেষক ক্ষীতিমোহন দাস, এম এ ভারতবর্ষের জাতিভেদ গ্রন্থের ১০৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন,
নানা দেশে অতি প্রাচীন কাল হইতে এক বিশেষ চিহ্ন বা লাঞ্ছন দ্বারা পরিচয় দেওয়ার রীতি দেখা যায়। এই চিহ্ন সাধারণত কোন জীব-জন্তুর হয় নয়তোবা বৃক্ষ-লতা এবং পুষ্পের হয়। যে বস্তু চিহ্ন বা লাঞ্ছন রূপে ব্যাবহার হয়, সেই বস্তু সেই জাতির প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট শ্রদ্ধা ও সম্মানের বস্তু। ইংরেজিতে ইহাকে টোটেম (Totem) বলা হয়। ছোটকালে রামায়ণে- বানর এবং ভাল্লুককে মনুষ্যোচিত ব্যাবহার করতে দেখে, বড় কৌতূহল হতো। বড় হয়ে বুঝতে পারলাম এখনো নিজেকে বানর এবং ভাল্লুকের বংশধর পরিচয় দেয় এমন লোক এদেশে আছে। আরো পরে বুঝতে পারলাম এইসব টোটেমরই ব্যাপার।
--------- ভারতবর্ষমে জাতিভেদ /পৃষ্ঠা-১০৫
প্রকাশকাল : ১৯৪০
মাতা সীতার সাথে শ্রী হনুমান দেখা হওয়ার পরে মাতা জিজ্ঞেস করেছিলেন,
সুরাণাম্ অসুরাণাম্ চ নাগ গন্ধর্ব রক্ষসাম্ |
যক্ষাণাম্ কিম্নরাণাম্ চ কা ত্বম্ ভবসি শোভনে ||
----------বাল্মীকি রামায়ণ-৫/৩৩/৫
অর্থাৎ হে শোভনে! সুর, অসুর, নাগ, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রাক্ষস,কিন্নরের মধ্যে আপনি কোন কুলের।
এখন যদি শ্রী হনুমান পশু হতেন তাহলে কি তাহার এই সকল কুল বংশের পরিচয় মাতা সীতা জানতে ইচ্ছে প্রকাশ করতেন?
প্রশ্ন আপনাদের নিকট রইল?
তাছাড়াও মহাভারতেও বিভিন্ন জাতির নাম উল্লেখ পাওয়া যায় । যারা মনুষ্য কিন্তু জাতির নাম কোন পশু-পাখি আদির নামে। মহাভারত/ভীষ্মপর্ব/নবম অধ্যায়ের ৫৬-৬৫ শ্লোকে - কুকুর, কাক..... ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য নামের উল্লেখ রয়েছে।
মহর্ষি গৌতম প্রণীত নায়দর্শন-২/২/৭১ সূত্রের ভাষ্যে, স্বামী দর্শনানন্দ সরস্বতী একটি প্রশ্নোত্তর লিখেছেন জাতি বিষয়ে। যথা-
প্রশ্ন- জাতি কত প্রকার?
উত্তর : জাতি দুই প্রকার। ১.সামান্য ২.বিশেষ। যেমন মনুষ্য জাতি সামান্য, এর মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়াদি বা শ্বেত-কৃষ্ণাদি, বা দেশভেদ অথবা আচার ভেদের জন্য অবান্তর জাতি তৈরি হয়।
এখানে সে বিশেষ জাতি এর কথায় উল্লেখ করা হয়েছে। তাই শ্রী হনুমান জ্বী অবশ্যই বানর নামক জাতি তথা মনুষ্য ছিলেন।
হে মিত্র প্রমুখ! আমরা আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে তাহা অধ্যয়ন প্রয়োজন। আমরা শাস্ত্র বিমুখ হওয়াতে আমাদের গৌরবের ইতিহাস নিয়েও কুচক্রীমহল বিভিন্ন তথ্য দ্বারা সনাতন ইতিহাসকে প্রমাণ করতে চায় কাল্পনিক তাই আসুন নিজ শাস্ত্র অধ্যয়ন করি, ইতিহাসকে জানি এবং সকল প্রকার মিথ্যা অভিযোগ এর প্রতিকার করি।
VEDA পেজ এর সাথে থাকুন। বেদ অমৃত জ্ঞান সকলের নিকট পৌঁছে দিন।
জয় শ্রীরাম।
মন্তব্যসমূহ