ত্রিবিধ দুঃখ


নমস্কার সকল অমৃতের সন্তানগণ। 🙏🚩

📜✍️ মনুষ্য এ জগৎে বিবিধ সুখ ও দুঃখ ভোগ করে থাকে। কিছু দুঃখ তাহার কর্মফল হিসেবে সে ভোগ করে থাকে এবং কিছু দুঃখ প্রকৃতি থেকে পেয়ে থাকে আবার কিছু দুঃখ অপর মনুষ্য কর্তৃক প্রদত্ত হয়। সাংখ্য দর্শন অনুসারে– "কুত্রাপি কোঽপি সুখী ন" -সাংখ্য ৬।৭ অর্থাৎ, কোথাও কেউই সুখী নয় । জগৎ মাঝে কেউ পূর্ণ সুখী নয় বলে, আমরা পূর্ণ সুখ অর্থাৎ মোক্ষ অর্জনের লক্ষ্যে শাস্ত্রোক্ত কর্ম করে থাকি। 

কিন্তু সেই দুঃখ সমূহ কি কি যা আমাদের এই মনুষ্য জন্মে ভোগ করতে হয় ?

সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে, 

❝অথ ত্রিবিধদুঃখাত্যন্তনিবৃত্তিরত্যন্ত পুরুষার্থঃ।❞ -[]সাংখ্য ১।১[]- 

অর্থাৎ, তিন প্রকার দুঃখ থেকে অত্যন্ত নিবৃত্তিই হলো অত্যন্ত পুরুষার্থ (মোক্ষ) ।

সাংখ্য দর্শনে যে ত্রিবিধ দুঃখ হতে নিবৃত্তির উল্লেখ রয়েছে তা সনাতন শাস্ত্র অনুসারে হলো,

➡️ আধ্যাত্মিক দুঃখ– নিজের মনে হিংসা , বিদ্বেষ , অহংকার প্রভৃতি থেকে যে দুঃখ উৎপন্ন হয় ।
➡️ আধিভৌতিক দুঃখ– আশ পাশের মানুষ , জীব-জন্তু প্রভৃতি থেকে যে দুঃখ প্রাপ্ত হয় ৷ 
➡️আধিদৌবিক দুঃখ– ঝড় , বন্যা , খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বস্তু থেকে যে দুঃখ প্রাপ্ত হয় ।

যোগ দর্শন অনুসারে আরো তিন প্রকারের দুঃখের উল্লেখ পাওয়া যায়, 

❝পরিণামতাপসংস্কারদুঃখৈর্গুণবৃত্তিবিরোধাচ্চ দুঃখমেব সর্বং বিবেকিনঃ।❞ -[]যোগ ২।১৫[]- 

অর্থাৎ, পরিণাম , তাপ , সংস্কার এই তিন প্রকার দুঃখ এবং ত্রিগুণের বৃত্তির বিরোধের কারণে বিবেকীর কাছে সবগুলোই হলো দুঃখ । 

➡️ পরিণাম দুঃখ:– আপাতত দৃষ্টিতে যেসব কর্ম সুখের মনে হয়, কিন্তু দিন শেষে দুঃখময় পরিণাম প্রদান করে, সেগুলোকে পরিণাম দুঃখ বলা হয় ৷ 
➡️ তাপ দুঃখ:– মনুষ্যের সুখ সাময়িক ৷ এই অস্থায়ী সুখকেই মানুষ আকড়ে ধরে রাখতে চায় । ফলস্বরুপ,  মানবের মনের মধ্যে সুখ হারানোর ভয় সর্বদা বিদ্যমান৷ উক্ত ভয় থেকে যে দুঃখের উৎপত্তি তাই তাপ দুঃখ ৷ অপরের সুখ দেখে যে ঈর্ষার ভাব তৈরি হয় এবং তার কারণে মনে যে দুঃখ প্রাপ্ত হয় , সেটিও তাপ দুঃখ ৷ 
➡️ সংস্কার দুঃখ:– সুখের সামন্যতম অনুভূতিও মানুষের মনে চিরদিন সঞ্চিত থাকে ৷ যা পরবর্তী দুঃখের সময় অতীতের সুখের স্মৃতি হয়ে বারংবার মানুষকে দুঃখ দেয় ৷ এই স্মৃতিই হলো সংস্কার দুঃখ ৷

এরুপ দুঃখ সমূহ থেকে মুক্তির উপায় কি তাহলে? 

দুঃখ আমাদের সময় সঙ্গী। একের পর অপর দুঃখ প্রতিনিয়ত এসে চলছে। তাই শুধু বর্তমান সময়ের দুঃখ নয় বরং ভবিষ্যতে আগত দুঃখ থেকেও চাই মুক্তি। সেজন্য যোগ দর্শনে বলা হয়েছে, 

"হেয়ং দুঃখং অনাগতম্।" -[]যোগ ২।১৬[]-
 অর্থাৎ, অনাগত দুঃখও পরিত্যাজ্য ।

কার্যকারণ তত্ত্ব অনুসারে প্রতিটি কার্যের পেছনে রয়েছে একটি কারণ। সেজন্য বৈশেষিক দর্শনে বলা হয়েছে, 

"কারণাভাবাৎ কার্যাভাবঃ।" -[]বৈশেষিক ১।২।১[]- 
অর্থাৎ কারণ বিনা কার্য সম্ভব নয় । 

তাই যদি কার্যকে বিনাশ করতে হয় তাহলে কারণ নামক জড়কে বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। সে কারণ সম্পর্কে ন্যায় দর্শনে বলা হয়েছে, 

"দুঃখজন্মপ্রবৃত্তিদোষমিথ্যাজ্ঞানানাম্ উত্তরোত্তরাপায়ে তদনন্তরাপায়াদপবর্গঃ।" -[]ন্যায় ১।১।২[]- 

অর্থাৎ, দুঃখ , জন্ম , প্রবৃত্তি , দোষ , মিথ্যাজ্ঞান এসবের ক্রমান্বয়ে বিনাশে পূর্বগুলোর বিনাশ ঘটে এবং অপবর্গ লাভ হয় ।

দুঃখ , জন্ম , প্রবৃত্তি , দোষ , মিথ্যাজ্ঞান এখানে প্রতিটি কারণ একে অপরের সাথে কার্য-কারণ সম্পর্কিত। তাই দুঃখের কারণ হলো জন্ম , জন্মের কারণ প্রবৃত্তি , প্রবৃত্তির কারণ দোষ এবং দোষের কারণ মিথ্যাজ্ঞান ৷ তাই যদি মিথ্যাজ্ঞানকে নাশ করা হয় তবেই এর কার্য দোষের নাশ হবে ৷ দোষের নাশ হলে এর কার্য প্রবৃত্তির নাশ হবে ৷ প্রবৃত্তির নাশ হলে এর কার্য জন্মের নাশ হবে৷ জন্মের নাশ হলে এর কার্য দুঃখের নাশ হবে । আর দুঃখের নাশ মানেই মোক্ষ বা মুক্তি । 

📜✍️ পরিশেষে ইহা বোধগম্য যে মানবের দুঃখের কারণ হলো তার জন্ম । জন্ম লাভ করলে দুঃখ পেতেই হবে ৷ সেজন্য জন্ম-মৃত্যুর চক্র ভঙ্গ করার মাধ্যমেই একমাত্র দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । এরুপ জন্মান্তরের চক্র থেকে মুক্তিকে যোগ দর্শন বলে সমাধি , ন্যায় দর্শন বলে অপবর্গ , সাংখ্য দর্শন বলে অত্যন্ত পুরুষার্থ এবং বেদান্ত দর্শন বলে মোক্ষ ৷ তাই আমাদের উচিত কঠিন পথকে গ্রহণ করে শাস্ত্র অনুসারে কর্ম করে মোক্ষ প্রাপ্তি করা। 

VEDA

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ