বিবাহের প্রকারভেদ

"বিবাহের প্রকারভেদ"

নমস্কার সকল অমৃতের সন্তানগণ 🔥🚩 

মনুষ্য জন্ম গ্রহণ করে এবং সময়ের পরিক্রমায় সে হয়ে উঠে দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তিত্ব। সেজন্য, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মনুষ্যের রয়েছে কিছু বিবিধ সংস্কার। যা ১৬ সংস্কার নামে সমোধিক পরিচিত। সনাতন ধর্মে ১৬ সংস্কার পাশাপাশি জীবনকে মোক্ষ মার্গে পরিচালিত করার জন্য রয়েছে চতুরাশ্রম। যা একজন মনুষ্যের জীবনকে বিদ্যার্থী থেকে বিদ্বান এবং পরিশেষে আদর্শ মানব হিসেবে গড়ে তুলতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। বিবাহ সংস্কার সেই চতুরাশ্রম এর ২য় আশ্রমের প্রবেশদ্বার। 

বিবাহ সংস্কার মনুষ্যের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে একজন পুরুষ এবং নারীর মাঝে তৈরি হয় এক সেতুবন্ধন। নারী ও পুরুষ উভয়ে ব্রহ্মচর্য পূর্ণ করে গুরুকুল থেকে বেদবিদ্যাসহ বিবিধ জ্ঞান অর্জন করে গৃহে ফিরে আসে। দেশ, সমাজ ও ধর্মের প্রতি নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের নিমিত্তে নিজেকে নিবেদিত করে। বিবাহ সেই নারী পুরুষ উভয়কে এক দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে। 

কিন্তু বিবাহ কত প্রকার এবং কোন বিবাহই সর্বোপরি উত্তম? 

মানবজাতির আদি সংবিধানের প্রণেতা মহর্ষি মনু মনুস্মৃতির ৩য় অধ্যায়ের ২১তম শ্লোকে বলেছেন, 

"ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্ষঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ। 
গান্ধর্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোধমঃ"।। 
- মনুস্মৃতি ৩/২১ 

অর্থাৎ, পদার্থঃ- (ব্রাহ্মঃ) ব্রাহ্ম বিবাহ (দৈবঃ) দৈব বিবাহ (তথা এব আর্ষঃ) আর আর্ষ বিবাহ (প্রাজাপত্যঃ) প্রাজাপত্য বিবাহ (তথা আসুরঃ) আর আসুর বিবাহ (গান্ধর্বঃ) গান্ধর্ব বিবাহ (রাক্ষসঃ চ এব) আর রাক্ষস বিবাহ (পৈশাচঃ চ অষ্টমঃ অধমঃ) আর সব থেকে অধম অষ্টম পৈশাচ বিবাহ। 

অনুবাদঃ- ব্রাহ্ম বিবাহ, দৈব বিবাহ, আর্ষ বিবাহ, প্রাজাপত্য বিবাহ, আসুর বিবাহ, গান্ধর্ব বিবাহ,  রাক্ষস বিবাহ আর সব থেকে অধম অষ্টম পৈশাচ বিবাহ।

📜 বিবাহ আট প্রকার, তবে তাহার মধ্যে সর্বোত্তম ০৪টি বিবাহ। বাকি ০৪টি অধম যা পরিত্যাজ্য অগ্রহণযোগ্য যা পাপযুক্ত নামমাত্র বিবাহ। 

উত্তম বিবাহ যথা:-১)ব্রাহ্ম বিবাহ
  ২) দৈব বিবাহ
  ৩) আর্ষ বিবাহ
  ৪)প্রাজাপত্য বিবাহ 

➡️ ব্রাহ্মবিবাহ: 
"আচ্ছাদ্য চার্চয়িত্বা চ শ্রুতশীলবতে স্বয়ম্ ।
আহূয় দানং কন্যায়া ব্রাহ্মো ধর্মঃ প্রকীর্তিতঃ" ।।
- মনুস্মৃতি ৩/২৭ 
অর্থাৎ, কন্যাকে  বস্ত্রাদিদ্বারা অলঙ্কৃত করিয়া এবং কন্যাও যাকে প্রসন্ন করিয়াছে সেই উত্তম, সুশীল,  বিদ্বান ও কন্যার যোগ্য পুরুষকে আহ্বান করিয়া আদর অভ্যর্থনা সহকারে কন্যাদান করাকে ব্রাহ্মবিবাহ বলে। 

➡️ দৈববিবাহ:
"যজ্ঞে তু বিততে সম্যগৃত্বিজে কর্ম কুর্বতে ।
অলঙ্কৃত্য সুতাদানং দৈবং ধর্মং প্রচক্ষতে"।।
- মনুস্মৃতি ৩/২৮

অর্থাৎ, বিরাট যজ্ঞে বড় বড় বিদ্বানকে বরণ করিয়া তাহাকে ঋত্বিক কর্মে নিযুক্ত কোন বিদ্বানকে বস্ত্রালঙ্কারাদি দ্বারা সুশোভিতা কন্যা দান করিলে তাহা হয় দৈব বিবাহ। 

➡️ আর্ষবিবাহ:
"একং গোমিথুনং দ্বে বা বরাদাদায় ধর্মতঃ ।
কন্যাপ্রদানং বিধিবদার্ষো ধর্মঃ স উচ্যতে'।। 
- মনুস্মৃতি ৩/২৯

অর্থাৎ, বরের নিকট হইতে একজোড়া বা দুইজোড়া গাভী ও বলদ লইয়া তাহাকে ধর্ম পূর্বক কন্যা দান করার নাম আর্ষবিবাহ। (মনুস্মৃতি-৩/২৯)

➡️ প্রাজাপত্য:
"সহোভৌ চরতাং ধর্মং ইতি বাচানুভাষ্য চ ।
কন্যাপ্রদানং অভ্যর্চ্য প্রাজাপত্যো বিধিঃ স্মৃতঃ" ।। 
- মনুস্মৃতি ৩/৩০

অর্থাৎ, যজ্ঞশালায় যথাবিধি যজ্ঞ করিয়া সকলের সম্মুখে–"তোমরা উভয়ে মিলিয়া যথাবিধি গৃহাশ্রম কর্ম করিতে থাক" এইরূপ বলার পর উভয়ে সানন্দে পাণিগ্রহণ হওয়াকে প্রাজাপত্যবিবাহ বলে। 

📜 পরবর্তী ০৪টি বিবাহকে অধম বিবাহ বলা হয়েছে। যা নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য।

  (৫)আসুর বিবাহ 
        (৬)গান্ধর্ব বিবাহ
        (৭)রাক্ষস বিবাহ
      (৮)পৈশাচ বিবাহ 

তবে উপরিউক্ত ০৪টি অধম বিবাহের মধ্যে সবচেয়ে অধম পৈশাচ বিবাহ। 

➡️আসুর বিবাহ:
"জ্ঞাতিভ্যো দ্রবিণং দত্ত্বা কন্যায়ৈ চৈব শক্তিতঃ ।
কন্যাপ্রদানং স্বাচ্ছন্দ্যাদাসুরো ধর্ম উচ্যতে" ।। 
- মনুস্মৃতি ৩/৩১

অর্থাৎ, বরের জ্ঞাতিবর্গকে ও কন্যাকে যথাশক্তি ধন দিয়ে হোমাদি বিধিদ্বারা কন্যাদান করাকে আসুরবিবাহ বলে

➡️গান্ধর্ব বিবাহ:
"ইচ্ছয়ান্যোন্যসংয়োগঃ কন্যায়াশ্চ বরস্য চ ।
গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুন্যঃ কামসম্ভবঃ" ।। 
- মনুস্মৃতি ৩/৩২

অর্থাৎ, বর ও কন্যার ইচ্ছানুসারে উভয়ের যে সংযোগ হয় এবং কামাসক্ত হয়ে উভয়ে মনে মনে স্বীকার করে নেয় যে, তারা উভয়ে স্ত্রী- পুরুষ—এরূপ বিবাহকে গান্ধর্ববিবাহ বলে। 

➡️রাক্ষস বিবাহ:
"হত্বা ছিত্ত্বা চ ভিত্ত্বা চ ক্রোশন্তীং রুদন্তীং গৃহাৎ ।
প্রসহ্য কন্যাহরণং রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে" ।।
- মনুস্মৃতি ৩/৩৩

অর্থাৎ, হনন ও ছেদন অর্থাৎ কন্যাপক্ষীয় বাধাদানকারীদিগকে বিদীর্ণ করে বিলাপকারিণী, রোরুদ্যমানা, কম্পিতকলেবরা ও ভীতিপরায়ণা কন্যাকে বলাৎকারে হরণ করে বিবাহ করাকে রাক্ষস বিবাহ বলে।

➡️ পৈশাচ বিবাহ:
"সুপ্তাং মত্তাং প্রমত্তাং বা রহো যত্রোপগচ্ছতি ।
স পাপিষ্ঠো বিবাহানাং পৈশাচশ্চাষ্টমোঽধমঃ" ।। 
- মনুস্মৃতি ৩/৩৪

অর্থাৎ, নিদ্রিতা, উন্মাদগ্রস্তা বা মদ্যপানে উন্মত্তা কন্যাকে একান্তে পেয়ে তাকে দূষিত করা—তা সব বিবাহের মধ্যে নীচ হইতেও নীচ, মহানীচ, দুষ্ট, অতিদুষ্ট পৈশাচবিবাহ ।

কিন্তু কেন ব্রাহ্ম বিবাহ, দৈব বিবাহ, আর্ষ বিবাহ, প্রাজাপত্য বিবাহকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে ⁉️ 

মহর্ষি মনু সে সংশয় নিবারণে উত্তর দিয়েছেন, 

"ব্রাহ্মাদিষু বিবাহেষু চতুর্ষ্বেবানুপূর্বশঃ ।
ব্রহ্মবর্চস্বিনঃ পুত্রা জায়ন্তে শিষ্টসম্মতাঃ"॥
-মনুস্মৃতি ৩/৩৯ 

অর্থাৎ, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য ও প্রাজাপত্য- এই ৪ (চার) প্রকারের বিবাহে পরস্পর পাণিগ্রহণে আবদ্ধ স্ত্রী-পুরুষ থেকে যে সব সন্তান উৎপন্ন হয়, তাহারা বেদাদি বিদ্যায় তেজস্বী, আপ্ত পুরুষের মতানুকূল ও অত্যুত্তম হয় ।  

"রূপসত্ত্বগুণোপেতা ধনবন্তো যশস্বিনঃ ।
পর্যাপ্তভোগা ধর্মিষ্ঠা জীবন্তি চ শতং সমাঃ" ॥
- মনুস্মৃতি ৩/৪০ 

অর্থাৎ, সেই সব পুত্র বা কন্যা সুন্দর রূপ, বল ও পরাক্রমযুক্ত, শুদ্ধবুদ্ধি, উত্তম গুণ ও বহুধনযুক্ত; পুণ্য কীৰ্ত্তিমান, পূর্ণভোগের ভোক্তা ও অতিশয় ধর্মাত্মা হয়ে ১০০ (শত) বৰ্ষ পৰ্য্যন্ত জীবিত থাকে ।

পরবর্তী ০৪টি বিবাহ আসুর বিবাহ, গান্ধর্ব বিবাহ, রাক্ষস বিবাহ, পৈশাচ বিবাহ অধম বিবাহ বলা হয়েছে কারণ, 

"ইতরেষু তু শিষ্টেষু নৃশংসানৃতবাদিনঃ ।
জায়ন্তে দুর্বিবাহেষু ব্রহ্মধর্মদ্বিষঃ সুতাঃ" ॥

"অনিন্দিতৈঃ স্ত্রীবিবাহৈরনিন্দ্যা ভবতি প্রজা ।
নিন্দিতৈর্নিন্দিতা নৄণাং তস্মান্নিন্দ্যান্বিবর্জয়েৎ" ॥
- মনুস্মৃতি ৩।৪১-৪২

অর্থাৎ,  এই চার প্রকার বিবাহ বাদে অবশিষ্ট— আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ এই ৪ (চারি) প্রকারের দুষ্ট বিবাহে উৎপন্ন সন্তান নিন্দিত কর্মের কর্তা মিথ্যাবাদী, বৈদিক ধর্মের বিদ্বেষী ও নীচ স্বভাবযুক্ত হয় ।  এজন্য যে সব নিন্দিত বিবাহে সন্তান নীচ হয়, তা ত্যাগ করে যে সব উত্তম বিবাহে সন্তান উত্তম হয়, তা-ই করা অত্যুত্তম কাৰ্য । 

হে অমৃতের সন্তানগণ! বৈদিক শাস্ত্রসমূহ আমাদের জীবনের জন্য সর্বোত্তম মার্গ প্রদর্শিত করেছে। আমরা যদি সে সত্য মার্গ অনুসরণ করে জীবন নির্বাহ করি তবে আমাদের জীবন হয়ে উঠবে আরো সুন্দর ও আমরা পৌঁছাতে পারবো সর্বোত্তম লক্ষ্যে অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপ্তি। 

🖋️ VEDA

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ