ঈশ্বর - দেবতা - ভগবান


ঈশ্বর - দেবতা - ভগবান 

➡️ ঈশ্বর: 
ধর্ম যা প্রাণী মাত্রই সুখ ও সমৃদ্ধির কামনা করার অনুপ্রেরণা প্রদান করে। ধর্ম মানবকে পশু থেকে ভিন্ন পরিচয় প্রদান করে। ধর্ম অর্থাৎ সত্য, ন্যায়, কল্যাণ, ক্ষমা, সাম্য, জ্ঞান, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি। যদি আমরা এসকল আদর্শকে ধারণ করি তবেই আমরা ধার্মিক। ধর্মের অন্যতম প্রধান বা মৌলিক সত্য হলো ঈশ্বর। কারণ ঈশ্বর ব্যতীত এ জগৎ সৃষ্টি, ধ্বংস কিংবা ভারসাম্য অসম্ভব। ঈশ্বরই ধর্মের সৃষ্টিকারী, ঈশ্বরই সকল কারণের মূল কারণ। তবে ঈশ্বর কে? 

(ঈশ ঐশ্বর্য়ে) এই ধাতু থেকে ঈশ্বর শব্দ সিদ্ধ হয়।য় ঈষ্টে সর্বৈশ্বর্য়বান্ বর্ততে স ঈশ্বরঃ।
অর্থাৎ, যাঁর সত্য,বিচারশীল,জ্ঞান এবং অনন্ত ঐশ্বর্য আছে,সেই পরমাত্মার নাম "ঈশ্বর"।

যোগদর্শনে ঈশ্বর সম্পর্কে বলা হয়েছে 
"ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ"  -যোগদর্শন ১/২৪

অর্থাৎ, অবিদ্যাদি পঞ্চ ক্লেশ, শুভ, অশুভ ,মিশ্র কর্ম, বিপাক বা কর্মফল, আশয় বা সুখ-দুঃখ ভোগের সংস্কার; এই সকল হতে সম্বন্ধ রহিত এবং জীব হতে ভিন্ন স্বভাবযুক্ত চেতন সত্তা বিশেষকে 'ঈশ্বর' বলা হয়।

"ঈশ্বরঃ কারণং পুরুষকর্ম্মফলাদর্শনাৎ"।। 
 - ন্যায়দর্শন ৪/১/১৯

অর্থ: জীব কর্ম করলেও কর্মফল তার অধীন নয়। কর্মফল অপর যার অধীন বলে অনুমিত হয়, সেই কারণই ঈশ্বর।

অর্থাৎ আমরা যা কর্মই করি না কেন কর্মফল দাতা একমাত্র তিনি, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই  মহান ঈশ্বর।

মহান ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য সমূহ: 

"ন দ্বিতীয় ন তৃতীয় শ্চতুর্থ নাপ্যুচ্যতে। 
ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তোমো নাপ্যুচ্যতে। 
নাষ্টোমো ন নবমো দশমো নাপ্যুচ্যতে। য এতং দেবমেক বৃতং বেদ"।। -অথর্ববেদ ১৩/৪/২

অর্থাৎ, পরমাত্মা এক,তিনি ছাড়া কেউ দ্বিতীয়,তৃতীয়।চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম,অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলে অভিহিত হয় না।যিনি ঈশ্বর কে এক বলে জানেন তিনিই ঈশ্বর কে প্রাপ্ত হন।

"স পৰ্য্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্ কবিৰ্মনীষ। 
পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোহর্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ" ।।---যজুর্বেদ ৪০/৮

অর্থাৎ, পরমাত্মা সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান, শরীর রহিত, রোগ রহিত, জন্ম রহিত, শুদ্ধ, নিষ্পাপ, সর্বজ্ঞ, অন্তর্যামী, দুষ্টের দমন কর্তা ও অনাদি। তিনি তাহার শাশ্বত জীবের জন্য যথাযথ ফলের বিধান করেন।

"সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্ ৷
অসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ" ৷৷
- শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১৩/১৫

অর্থাৎ, সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক তথাপি তিঁনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত , যদিও তিঁনি সকলের পালক তথাপি তিঁনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত ,তিঁনি জড়া প্রকৃতির গুণের অতীত তথাপি তিঁনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।

ঈশ্বর বহু নামে সুশোভিত। তবে পরমাত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ নাম ও৩ম্। 

"ও৩ম্ খং ব্রহ্ম" -যজুর্বেদ৪০/১৭

অর্থাৎ ('ও৩ম্') আদি নাম সার্থক। যেমন-ও৩ম্ খম্ ", আকাশযিব ব্যাপকত্বাৎ খম্,সৰ্ব্বেভ্যো বৃহত্বা ব্রহ্ম।' রক্ষা করেন বলিয়া ‘ও৩ম্ আকাশের ন্যায় ব্যাপক বলিয়া ‘খম্' এবং সর্বপেক্ষা বৃহৎ বলিয়া 'ব্রহ্ম' ঈশ্বরের নাম ॥

"তজ্জপস্তদর্থভাবনাম্" -যোগদর্শন ১/২৮ 

অর্থাৎ, ও৩ম্ শব্দের জপ এবং  ও৩ম্ নামের নামী ঈশ্বরের ভাবনা অর্থাৎ তার রক্ষণাদি গুণের চিন্তন করা উচিত।

তাই মনুষ্য মাত্রই সকলের উচিত পরমাত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ নাম ও৩ম্ জপ করা। এবং জীব তাহার শরীর ত্যাগের সময়ও ও৩ম্ স্মরণ করা উচিত। 

"সদা তে নাম স্বযশো বিবক্মি" -ঋগ্বেদ ৭/২২/৫

অর্থাৎ, হে পরমেশ্বর! আমরা সর্বদা তোমার পবিত্র  নাম 'ও৩ম্' স্মরণ করি।

"ও৩ম্ ইতি একাক্ষরম্ ব্রহ্ম ব্যাহরন্ মাম্ অনুস্মরন্ ।
য়ঃ প্রযাতি ত্যজন্ দেহম্ সঃ যাতি পরামাম্ গতিম্"।।
- গীতা-৮/১৩

অর্থাৎ, যে পুরুষ 'ও৩ম্' নামক ব্রহ্ম অক্ষর কে স্মরণ করতে করতে দেহ ত্যাগ দ্বারা প্রয়াণ করে সে পুরুষ পরম গতি কে প্রাপ্ত হয়।।

"বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্। 
ওতম্ ক্রতো স্মর ক্লিবে স্মর কৃতং স্মর"।। 
 - যজুর্বেদ ৪০/১৫

অর্থাৎ, হে কর্মশীল জীব! শরীর ত্যাগের সময় পরমাত্মার নাম "ও৩ম্" স্মরণ করো।আধ্যাত্মিক প্রাণ, আধিদৈবিক প্রাণ এবং পুনরায় সেই প্রাণস্বরূপ পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হও। তৎপর এই ভৌতিক শরীর ভস্মে পরিণত হউক।

ভাবার্থঃ- অন্ত্যেষ্টি সংস্কারই শেষ সংস্কার। ইহার পর শরীরের জন্য অন্য কোন সংস্কারই অবশিষ্ট থাকে না । ইহার নাম নরমেধ, পুরুষমেধ, নর যাগ ও পুরুষ যাগ । শ্মশান ভূমিতে জ্বলন্ত চিতায় সমিধা, সুগন্ধি, রোগনাশক ও বুদ্ধিবর্ধক ওষধি এবং ঘৃত আহুতি দ্বারা মৃত শরীরকে ভস্মীভূত করাই অন্ত্যেষ্টি সংস্কার। জীব তাহার কৃত কর্মের ফল নিজেই ভোগ করে। বংশধরদের কোন কার্যই তাহাকে সাহায্য করিতে পারে না।

পরিশেষে ঈশ্বর অর্থ, সেই সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা যার গুণ, কর্ম ও স্বরূপ একমাত্র সত্য, যিনি চেতন মাত্র বস্তু তথা যিনি এক ও অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপক, অনাদি এবং অনন্ত, অপরাজেয় মৃত্যুুহীন, আদি সত্য গুণ যুক্ত, যিনি স্বভাবত অবিনাশী, জ্ঞানী, আনন্দময়, শুদ্ধ, ন্যায়কারী, দয়ালু এবং জন্মরহিত, যিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দুঃখ, আনন্দ, অজ্ঞতা, নশ্বর কর্ম, কর্মফল, জীবন, মৃত্যু এই সকলের উর্দ্ধে ; জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয় তথা সর্ব জীবের পাপ পুণ্যের যথাযথ ফল দান করা যাহার স্বাভাবিক কর্ম, যাকে বিদ্বানরা বহু নামে স্মরণ করেন, ও৩ম্ যার সর্বশ্রেষ্ঠ নাম — সেই পরমব্রহ্ম, পরমাত্মাই পরমেশ্বর । 

➡️ দেবতা:
ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা লাভের পর দেবতা সম্পর্কে সংশয় নিবারণ প্রয়োজন। দেবতা বলতে কাহাকে বোঝানো হয়? 

দেবতা: নিরুক্তে দেব শব্দের বিবিধ অর্থ পরিলক্ষিত হয়।

''দেবো দানছা দীপনাথাদ্যোতনায়া দ্যুস্থানো ভবতীতি বা। য়ো দেবঃ সা দেবতা।'' - নিরুক্ত ৭:১৫ 

অর্থাৎ দেবের লক্ষণ হচ্ছে দান। সবার হিতার্থে যে দান করে, সে দেব বা দেবতা। 

দেবতার গুণ হচ্ছে দীপন অর্থাৎ প্রকাশ করা। সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি প্রকাশ করে বলে তাদের দেব বলা হয়। 

দেবতার কর্ম হচ্ছে দ্যোতন অর্থাৎ সত্যোপদেশ করা। যে মনুষ্য সত্য মানেন, সত্য বলেন এবং সত্য উপদেশ প্রদান করেন, তিনিই দেব। দেবের বিশেষত্ব হচ্ছে দ্যুস্থান বা ওপরে স্থিতি লাভ। তাই ব্রহ্মাণ্ডের ওপর স্থিতি লাভ করার জন্য সূর্যকে, সমাজের ওপর স্থিতি লাভ করার জন্য বিদ্বানকে এবং রাষ্ট্রের ওপর স্থিতি লাভ করার জন্য শাসকে দেব বা দেবতা বলা হয়। 

তাহলে দেবতা কয়জন? সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে ৩৩ কোটি দেবতা নাকি ৩৩ প্রকার দেবতার উল্লেখ রয়েছে ? 

বৈদিক সংস্কৃতত“কোটি” শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রকার। অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে দেব হচ্ছে তেত্রিশ প্রকার তেত্রিশ কোটি নয়। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী কোটি শব্দের অর্থ সংখ্যাবাচক হলেও সংস্কৃত অভিধানে এর অর্থ ভিন্ন।  তাই তেত্রিশ কোটি জন দেবতার কল্পনা নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। 

পবিত্র বেদ এ স্পষ্ট রুপে বলা হয়েছে, 

“ত্রয়স্ত্রিং শতাস্তুবত ভুতান্য শাম্যন্ প্রজাপতিঃ। পরমেষ্ঠ্যধিপতিরাসীত্‍।।” - যজুর্বেদ ১৪/৩১

অনুবাদঃ যাঁহার প্রভাবে গতিশীল প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রজার পালক, সর্বব্যপক ,অন্তরীক্ষে ব্যপ্ত, তাঁহার মহাভূতের তেত্রিশ প্রকার গুনের স্তুতি কর।

য়স্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা নিধিং রক্ষন্তি সর্বদা। 
নিধিং তমদ্য কো বেদ য়ং দেবা অভিরক্ষ।।
 - অথর্ববেদ ১০/৭/২৩ 

অর্থাৎ, যেই [পরমেশ্বরের] সংসারকে তেত্রিশ দেব সর্বদা রক্ষা করছেন। সেই সংসারকে আজ কে জানতে পারে, হে দেব! তুমি সর্বদা যার রক্ষাকারী হও।

উপরিউক্ত মন্ত্র সমূহ অধ্যয়ন করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে পবিত্র বেদ এ ৩৩ প্রকার দেবতার উল্লেখ রয়েছে, ৩৩ কোটি দেবতার নয়। 

শাস্ত্রে উল্লেখিত ৩৩ প্রকার দেবতা সমূহ: 

“অষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশদিত্যান্ত একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপতিশ্চ ত্রয়ত্রিংশাবিত্তি" [বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৯/২]

অর্থাৎ অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এই কয়জন মিলে একত্রিশ এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি মিলে তেত্রিশ দেব। 

অষ্ট বসু:- 

"অগ্নিশ্চ পৃথিবী চ বায়ুশ্চান্তরিক্ষং চাদিত্যশ্চ দ্যোশ্চ চন্দ্ৰমাশ্চ নক্ষত্রাণি চৈতে বসব"
- বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৯/৩

অর্থাৎ, অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দ্যৌ, চন্দ্র, নক্ষত্রপুঞ্জ এই অষ্ট বসু। কারণ মহাবিশ্বের সকল পদার্থ এদের মধ্যেই নিহিত আছে। সেই জন্য এদের নাম বসু। 

একাদশ রুদ্র:-

 "দশেমে পুরুষে প্রাণা আত্মৈকাদশস্তে:"

 - বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৯/৪

অর্থাৎ, পঞ্চ প্রাণ এবং পঞ্চ উপপ্রাণ এই দশ এবং জীবাত্মা মিলে একাদশ রুদ্র। এই এগারো দেহান্তকালে রোদন করায়, বলে এদের রুদ্র বলা হয়।  

পঞ্চপ্রাণ:- প্ৰাণ, উদান, সমান, ব্যান, অপান।
উপপ্রাণ:- নাগ, কুৰ্ম, কৃকল, দেব, ধনঞ্জয় এবং জীবাত্মা।  

দ্বাদশ আদিত্য:- 

"দ্বাদশ বৈ মাসাঃ" - বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৯/৫ 

অর্থাৎ, সম্বৎসরে যে বারো মাস রয়েছে, তারাই আদিত্য। কারণ এই সমস্তকে আদান করে যান। যেহেতু এই সমস্তকে আদান করে যান, অতএব তারা আদিত্য। 

দ্বাদশ আদিত্য হচ্ছে:- বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবন, ভাদ্রপদ, আশ্বিন, কার্তিক, মার্গশীর্ষ, পৌষ, মাঘ এবং ফাল্গুন,চৈত্র। 

ইন্দ্র ও প্রজাপতি:-

 "স্তনয়িত্বরেবেন্দ্রো" - বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/১/৬ 

অর্থাৎ, বিদ্যুৎ হচ্ছে ইন্দ্র। কারণ তা ঐশ্বর্যের সাধন। বিদ্যুৎ হতে গতি শক্তি, আলোক প্রকাশ, সমৃদ্ধি এবং সুখের সাধন প্রাপ্তি হয়।

"যজ্ঞঃ প্রজাপতিরিতি" - বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩।১৬ অর্থাৎ, যজ্ঞ হচ্ছে প্রজাপতি। কারণ এর দ্বারা বর্ষা হয়, প্রাণিদের সুখ মেলে। 

উপরন্তু বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝতে সক্ষম যে, সনাতন ধর্ম এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বর এর কথা বলা হয়েছে। দেবতা অর্থ কোনো আকৃতি ধারণকারী কেউ নন বরং দেবতা অর্থ সবার হিতার্থে যে দান করে, সে দেব বা দেবতা। এবং দেবতার গুণ হচ্ছে দীপন অর্থাৎ প্রকাশ করা। সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি প্রকাশ করে বলে তাদের দেব বলা হয়।

➡️ ভগবান:
ঈশ্বর ও দেবতা শব্দের বিশ্লেষণ এর থেকে ইহার নিগুঢ় অর্থ আমাদের নিকট উপলব্ধ হয়। কিন্তু সনাতন শাস্ত্র সমূহে ভগবান শব্দের প্রয়োগ লক্ষণীয়। "ভগ" অর্থাৎ ঐশ্বর্য রয়েছে, ডাকে "ভগবার" বলা হয়। ঈশ্বরের গুণবাচক নাম ভগবানঃ- (ভজ সেবায়াম) এই ধাতু থেকে "ভগ" সিদ্ধ হয়, এর সাথে "মতুপ্" প্রত্যয় যোগে "ভগবান" শব্দটি সিদ্ধ হয়। তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যযুক্ত অথবা ভজনের যোগ্য, এইজন্য পরমেশ্বরের একটি গুণবাচক নাম হচ্ছে "ভগবান"। তবে কি কি গুণাগুণ এর কারণে ভগবান হিসেবে সম্বোধিত করা হয়? 

সেজন্য বিষ্ণুপুরাণ বলা হয়েছে, 

"জ্ঞানশক্তিবলৈশ্বর্যবীর্যতেজাংস্যশোষতঃ।
ভগবচ্ছব্দবাচ্যানি বিনা হেয়ৈর্গুণাদিভিঃ"।।
 -বিষ্ণুপুরাণ ৬/৫/৭৯

অর্থাৎ, যিনি পরম ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য--এই ষড়ৈশ্বর্য গুনযুক্ত তিনিই "ভগবান" পদবাচ্য।

ভাবার্থঃ- যেভাবে কোন ব্যক্তি জ্ঞান ধারণ করলে তাঁকে বলা হয় জ্ঞানবান, কোন ব্যক্তি বল ধারণ করলে, তাকে বলা হয় বলবান। অনুরূপভাবে, যে কোনো ব্যক্তি যদি উক্ত ষড়ৈশ্বর্য বা "ভগ" -কে সম্পূর্ণরুপে ধারণ করেন, তিনিই "ভগবান" পদবাচ্য।

"ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রীয়ঃ । 
জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষণ্ণং ভগ ইতীঙ্গনা"।।
-বিষ্ণু পুরাণ ৬/৫/৭৪

অনুবাদঃ- ঐশ্বর্য্য, বীর্য্য, যশ,শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি গুণকে(ষড়ৈশ্বর্য) একত্রে বলা হয় "ভগ" ।

ষড়ৈশ্বর্য কে বিশ্লেষণ করলে: 

১। ঐশ্বর্য = সত্যভাষণাদি শ্রেষ্ঠ গুণাবলী।
২। বীর্য্য = ব্রহ্মতেজ অর্থাৎ ব্রহ্মচর্যের যথাযথ পালন দ্বারা লব্ধ তেজ বা বল।
৩। যশ = ধার্মিক ও বিদ্বানদের নিকট প্রশংসিত হওয়া।
৪। শ্রী = অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য অর্থাৎ চারিত্রিক শুদ্ধতা বা পবিত্রতা।
৫। জ্ঞান = বেদাদি সত্য শাস্ত্রের অধ্যয়ন ও গুরুকৃপায় লব্ধ বিদ্যা, যা দ্বারা সত্য-অসত্য, ধর্ম-অধর্ম, নিত্য-অনিত্য ইত্যাদির ভেদ নির্ণয় করা যায়।
৬। বৈরাগ্য = স্ত্রী, পুত্র, ধন, মান ইত্যাদি বিষয়ের অর্থাৎ জাগতিক সুখের প্রতি মোহ বা আকর্ষণ না থাকা।

বৈদিক শাস্ত্রের বাক্যে, জ্ঞানৈশ্বর্যবান ঋষিদের ভগবান বলে সম্বোধন করতে দেখা যায়। অর্থাৎ মনুষ্যদের মধ্যে যাদের নিম্নোক্ত গুণসমূহ রয়েছে তাদের ভগবান বলে সম্বোধন করা হয়। 

উদাহরণস্বরূপ, প্রশ্ন উপনিষদে পিপ্পলাদ ঋষিকে "ভগবান্" বলা হয়েছে। মনুসংহিতার শুরুতেই (১। ১, ২ শ্লোকে) রাজর্ষি মনুকে অন্যান্য ঋষিগণ "ভগবান্ মনু" বলে সম্বোধন করেছেন। আবার বিষ্ণুপুরাণে মৈত্রেয়, ঋষি "পরাশর" কে ভগবান ডেকেছেন। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র ষড়ৈশ্বর্য যুক্ত ছিলেন তাই তাঁদের কে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বলে সম্বোধন করি।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ