সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️




সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️

📌 সনাতন ধর্ম সত্য ও দিব্য। ধর্মশাস্ত্রে মানব কল্যাণের জন্য বহুবিধ ক্রিয়াকর্ম এবং কর্তব্যের বিধান রয়েছে। যা একজন মনুষ্যকে অন্ধকার থেকে অমৃতে এবং সদা ধর্মে অটল রাখতে সক্ষমতা প্রদান করে। সেজন্য, সনাতন শাস্ত্রে অযৌক্তিক, অসত্য কিংবা অন্যায্য কোনো বাক্য ও নির্দেশনা নেই। 

📌 তবে আমাদের অজ্ঞতা এবং শাস্ত্রবিমুখতার কারণে সমাজে ধীরে ধীরে গেড়ে বসে কতিপয় কুসংস্কার, কুপ্রথা। যা আমাদের অজ্ঞানতা কিংবা সংশয় হতে সৃষ্ট। তবে সে কুসংস্কার দূরীকরণে সনাতনের প্রাণপুরুষেরা প্রতিবারই এগিয়ে আসেন। যেরূপ সতীদাহপ্রথা নির্মূলে এগিয়ে আসেন রাজা রামমোহন রায়, বিধবাবিবাহ চালু করণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নারী বেদ অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী, হিন্দু জাগরণে স্বামী বিবেকানন্দ। বহু কুসংস্কার দূরীকরণ হয়েছে, তবুও কিছু সংশয় এখনো বিদ্যমান৷ যার প্রভাব আমাদের সনাতনী ভ্রাতা-ভগিনীদের উপর বিদ্যমান। যদিও আধুনিক প্রগতিশীলতা এবং শাস্ত্র চর্চার ফলে সকলে সচেতন হচ্ছে। কিন্তু কতিপয় সনাতন বিদ্বেষী সনাতনীদের অজ্ঞানতা সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে প্রতিনিয়ত। এরুপই এক মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা হলো "সনাতন ধর্মে গোমূত্র পানের উল্লেখ"। 

◼️সাম্প্রতিক সময়ে, বহু অজ্ঞানী সোশ্যাল মিডিয়ায় সনাতনীদের গোমূত্র সম্পর্কিত বিবিধ কুৎসাজনক মন্তব্য করে থাকে। বিভিন্ন বক্তৃতা কিংবা আড্ডায় এরুপ কটাক্ষের প্রবণতা লক্ষণীয়। সে সংশয় নিবারণে এবং কটাক্ষের প্রবণতা রোধে আমাদের জানা আবশ্যক "সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️

◼️ সনাতন ধর্ম শাস্ত্রের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদে এরুপ কোনো বিধানের উল্লেখ নেই। এছাড়াও উপনিষদ কিংবা অন্যান্য শাস্ত্রেও একজন মনুষ্যকে গোমূত্র কিংবা গোবর গ্রহণের উল্লেখ নেই। তবে কেন এই কটাক্ষ? যার কোনো শাস্ত্রীয় প্রমাণ সে অপপ্রচারকারীরা দেখাতে সক্ষম নয়। 

তবে গোমূত্র পানের উল্লেখ পাওয়া যায় মনুসংহিতায়। কিন্তু কেন ⁉️ 

◼️ সনাতন ধর্মে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের অন্যতম সপ্তমর্যাদা। কোনো মনুষ্য এই সপ্তমর্যাদার লঙ্ঘন করা উচিত নয়। সে সপ্ত মর্যাদার অন্যতম মদ্যপান। কোনো মনুষ্য যদি মদ্যপান করে, তবে সে নিশ্চিত ভাবে অধোগতি প্রাপ্ত হয়। মনুসংহিতা ১১/৯৪,৯৬,৯৭ শ্লোকে মদ্যপান নিষিদ্ধের উল্লেখ রয়েছে। 

◼️কিন্তু কেউ যদি ধর্মের এই বিধান অমান্য করে মদ্যপান করে তবে তাহার প্রায়শ্চিত্ত কিংবা শাস্তিস্বরূপ গোমূত্র পানের বিধান রয়েছে। মনুস্মৃতির ১১/২১৩ নং শ্লোকে মূলত "সান্তপনকৃচ্ছ্রব্রত - প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ" যা পুণ্যলাভের আশায় নয় বরং পূর্বকৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ করা হয়। 
 
গোমূত্রং গোময়ং ক্ষীরং দধি সর্পিঃ কুশোদকম্ । একবাত্রোপবাসশ্চ কৃচ্ছ্রং সান্তপনং স্মৃতম্ ॥
[মনুস্মৃতি ১১।২১৩]
অনুবাদঃ- গোমূত্র, গোবর, দুধ, দই, ঘি এবং কুশোদক- এগুলি মিশিয়ে একদিন খেয়ে থাকতে হবে[ সেদিন অন্য কিছু খাওয়া চলবে না] এবং পরের দিন উপবাস করতে হবে। স্মৃতিমধ্যে এই ব্রতকেই সান্তপনকৃচ্ছ্র নামে নির্দিষ্ট করা হয়েছে । 

কুল্লুকভট্টের টীকাঃ- গোমূত্রমিতি। গোমূত্রাদি একীকৃত্য একস্মিন্নহনি ভক্ষয়েৎ নান্যৎ কিঞ্চিৎ, অপরদিনে অদ্যাৎপবাস ইত্যেতৎ সান্তপনং কৃচ্ছ্রং স্মৃতম্। যদি তু গোমূত্রাদিষ্ট প্রত্যেকং ষদিনান্যুপভুজ্য সপ্তমে দিনে চোপবাসঃ তদা মহাসান্তপনং ভবতি। তথা চ যাজ্ঞবল্ক্যঃ—“কুশোদকঞ্চ গোক্ষীরং দধি মূত্রং শক্তদঘৃতম্। জাপরেহহ্যুপবসেৎ কৃচ্ছ্রং সান্তপনং চরণ। পৃথক সান্তপানদ্রব্যৈঃ ষড়হঃ সোপবাসিকঃ। সপ্তাহেন তু কৃচ্ছ্রোইয়ং মহাসান্তপনং স্মৃতম্”।

মনুস্মৃতির উপরোক্ত শ্লোকের বিশ্লেষণে স্পষ্ট যে  
 পুণ্যার্থে গোমূত্রপান নয় বরং কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তরূপ এই কর্ম। তবে সে গোমূত্র সরাসরিও নয় বরং পঞ্চগব্য এর মাধ্যমে সে বিধান রয়েছে।  দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, গোময়, গোমূত্র- এই পাঁচ নিয়ে পঞ্চগব্য। কিন্তু এই বিধান এজন্য করা হয়েছে, যেন কেউ ভুলবশত মদ্যপান না করে। কারণ, সপ্ত মর্যাদার উলঙ্ঘন কখনো কাম্য নয়। কিন্তু কেউ যদি শাস্তি কে পূর্ণ্যার্থে হিসেবে উল্লেখ করে প্রোপাগাণ্ডা প্রচার করে তাহার জন্য কি বলার থাকতে পারে?

📌 তবে আমাদের জানা আবশ্যক যে, গোবর-গোমূত্রকে চরকসংহিতায় চিকিৎসার জন্য উল্লেখ রয়েছে। আপনার মনে এরুপ সংশয় সৃষ্টি হতে পারে যে, চিকিৎসার জন্য কেন এই উপাদান এর উল্লেখ রয়েছে? তবে আমাদের গোবর কিংবা গোমূত্রের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। 

গবেষণা অনুসারে গোমূত্র বিষাক্ত নয় বলে বিবেচনা করা হয়। গোমূত্রে 95% জল, 2.5% ইউরিয়া এবং বাকি 2.5% হল বিভিন্ন লবণ, খনিজ, এনজাইম এবং অন্যান্য উপকারী হরমোন। ক্রিয়াটিনিন, অরিয়াম অক্সাইড, কার্বলিক অ্যাসিড, ফেনল, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজ'এর মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ খনিজ এবং এনজাইম গোমূত্রে থাকে।

আয়ুর্বেদ অনুযায়ী, শুধু গোমূত্র, অথবা গোমূত্র ও গোদুগ্ধের মিশ্রণ অথবা গোমূত্র ও ত্রিফলার সংমিশ্রণ দিয়ে কিছু রোগের চিকিৎসা করা যায়, যেমন জ্বর, কলিক ব্যথা, রক্তাল্পতা, কুষ্ঠ, কর্কট রোগ এবং মৃগী।

🔅কর্কট রোগের জন্য: গোমূত্রের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণ আছে, তাই কর্কট রোগের কার্যকর চিকিৎসা করা যায়। এর ফলে ডিএনএ'র ক্ষতি হ্রাস হয়।

🔅অন্ত্রের ক্রিমির জন্য: অন্ত্রের ক্রিমির চিকিৎসার জন্য পারম্পরিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে গোমূত্র ব্যবহার করা হয়, এবং ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাতেও এটি যাচাই করা হয়েছে।

🔅বায়ো-এনহ্যান্সার: দেহের অভ্যন্তরে অন্য ওষুধ যাতে সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য প্রায়শই ওষুধের সাথে গোমূত্র দেওয়া হয়।

🔅ত্বকের জন্য: গোমূত্র অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। ফলে এটি ত্বকের বলিরেখা এবং কুঞ্চন হ্রাস করে ত্বককে বয়স বৃদ্ধির চিহ্নগুলিকে হ্রাস করে। যেহেতু গোমূত্র বয়সের ছাপ পড়াকে দেরি করিয়ে দিতে পারে, তাই একে জীবন-দায়ী তরল বলা হয়।

⚠️ কিন্তু আমাদের জানা আবশ্যক যে, আয়ুর্বেদে গোমূত্র সরাসরি নয় বরং নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা চিকিৎসার জন্য কাজে লাগানো হয়ে থাকে। সেজন্য, কোনো একজন আয়ুর্বেদ বিশারদ এর পরামর্শ ব্যতীত গোমূত্র সরাসরি ব্যবহারকে মান্যতা দিতে না যাওয়া উচিত। 

📌 এছাড়াও গোবর আমাদের জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। সেজন্য, আমাদের উচিত সত্যকে জানা। সত্য ও অর্ধসত্যের মধ্যে পার্থক্য জেনে সংশয় নিবারণ করা। নিশ্চিত ভাবে আপনি শাস্তিস্বরূপ যে বিধান তাকে নিত্যদিনের জন্য প্রযোজ্য হিসেবে মান্য করবেন নাহ। যাহার যে উপকারিতা তাহা গ্রহণ করে, নিজেদের উপকারে ব্যবহার করা জ্ঞানীর কর্ম।

🔎Run with #veda 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ