মুক্তিযুদ্ধ ও হিন্দু ইতিহাস: ০২


"ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও জন্মভূমি বাংলাদেশ"

"বাংলাদেশ" শুধু একটি ভূমির নাম নয়, বরং এ হলো এক অমর চেতনা। সেই উপলব্ধি যা নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে নিজ মাতৃভূমির প্রতি নিবেদিত হওয়ার সর্বোত্তম উদাহরণ। মাতৃভূমির সার্বভৌমত্বের রক্ষায় এ বাংলার ভূমিপুত্রগণ সদা আপোষহীন। কোনো আগ্রাসী শক্তির নিকট কখনোই এ মাটির মানুষ পদাবনতা স্বীকার করেনি। কখনো বিপ্লবী হয়ে তো কখনো মুক্তিযোদ্ধা হয়ে স্বদেশ ব্রতের দীক্ষা নিয়েছে অকুতোভয় সংগ্রামী জনতা। দেশপ্রেমের এই চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে মোহিনী চৌধুরী লিখেছিলেন, 

"মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে"

সত্যি অশ্রুজলেই সেই বীর সন্তানদের আত্মত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সুদীর্ঘ। কখনো বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম করেছে, আবার সেই বৃটিশ অধীনতা পাশ থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সেই শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে পুনরায় স্বাধীনতা মুক্ত বাতাস আস্বাদন করেছে মুক্তিকামী মানুষেরা। 

সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রত্যেক শ্রেণী পেশার মানুষ, ধর্ম-বর্ণ, বাঙালি-অবাঙালি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের রয়েছে ব্যাপক অবদান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো বিশেষ জাতি কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীর লড়াই ছিলো না। আদিবাসী সম্প্রদায়ের উক্য চিং বা ইউ. কে. চিং মারমা কিংবা তরুণ জগৎ জৌতি দাস বা নারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আশালতা বৈদ্য সকলের অংশগ্রহণই ছিলো স্বাধীনতার লড়াইয়ে। 

তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেও পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে বঙ্গভূমির মানুষের সংগ্রামের প্রসিদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। যার মধ্যে ভাষা আন্দোলন সবার অগ্রভাগে এবং মূল প্রেরণাদানকারী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তবে সেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় বীরের মাধ্যমে। তিনি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত! 

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম তৎকালীন বাংলা প্রদেশের ত্রিপুরা [বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া] জেলার রামরাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন কসবা ও নবীনগর মুন্সেফ আদালতের সেরেস্তাদার। ধীরেন্দ্রনাথ পড়াশোনা করেছেন নবীনগর হাই স্কুল, কুমিল্লা কলেজ, এবং কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। 

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। এভাবে তিনি রাজনৈতিক জীবনের শুরু করেন। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে তিনি তিন মাসের জন্য আইন ব্যবসা স্থগিত রেখে এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন, বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনি আইন পাসের সাথে ধীরেন দত্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেন। ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন কারাগারে বিনাশ্রম ও সশ্রম দণ্ড ভোগ করেন। 

১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস দলের টিকিটে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ঐ বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ হতে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের পর একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। 

ভাষা সংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত:

তিনি পার্লামেন্ট সদস্য হয়ে সবসময় ছিলেন মাতৃভূমি এবং সেখানকার মানুষের অধিকারের স্বপক্ষে। পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট শ্রেণীর সিধান্ত উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। পলিটিক্যাল হাই প্রোফাইল ব্যক্তিগণ তাদের অভিমতের সাথে একমত। কিন্তু পাকিস্তানের মাত্র ৬% মানুষ উর্দু ভাষার ব্যবহার করে। অন্যদিকে পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬% বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা।  ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলির জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কিন্তু হিন্দু ও বাঙালি হওয়ায় তার দাবিকে প্রাদেশিকতার অভিযোগ করে পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট ব্যক্তিত্ব। ওনার জনপ্রিয়তা ও ওনার সাংগঠনিক শক্তিকে ভয় পেয়েই জিন্নাকে মাঠে নেমে বলতে হয় যে বাংলা ভাষাকে কোনমতে রাষ্ট্রভাষা তো দূরের কথা, কোন সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। তবে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। 

কিন্তু এরপরেও তার পথচলা থেমে থাকেনি। তিনি পরবর্তী সময়েও নিজ জন্মভূমির মানুষের পাশে থেকেছেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং তখন থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। এতদসত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখতেন। 

তবে জন্মভূমির জন্য তার এখনো কিছু দেওয়া বাকি ছিলো। হ্যাঁ তার জীবন দিয়ে মাতৃভূমির প্রতি সর্বশেষ সেবাটুকু তিনি করেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এ্যাডভোকেট আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন সত্যিকারের একজন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক। মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সংগ্রাম। কিন্তু বর্তমানে কিছু স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এরুপ ধর্মীয় উসকানি প্রদানের উদ্দেশ্য এরুপ মন্তব্য উপস্থাপন ও প্রচার করে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু জনগোষ্ঠীর কোনো অবদান নেই। কিন্তু সত্যি কি হিন্দুরা মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্লিপ্ত ছিলো? অবশ্যই না! বহু হিন্দু সংগঠক হিসেবে কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজ মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মনিয়োগ করেছে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন সেই আত্মত্যাগকারীদের একজন। 

তবে এটাও সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কর্তৃক পরিকল্পিত জেনোসাইড এর অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি হিন্দুজনগোষ্ঠী। এবং তারা বহুভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ভারত ও হিন্দুদের চক্রান্ত বলে অভিহিত করার চেষ্টা করে। যা তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মন্তব্য থেকে সুস্পষ্ট হয়। 

 "পাকিস্তানের চিফ অব আর্মি স্টাফ এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফ প্রায় প্রতিদিনই জানতে চাইতেন, কতজন হিন্দুকে আজ হত্যা করা হয়েছে। একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের উদ্ধৃতি দিয়ে বইয়ে বলা হয়েছে, সাধারণভাবেই সৈনিকদের মধ্যে বাঙালিদের প্রতি ছিল তীব্র ঘৃণা। তাই হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।" -  জেনারেল টিক্কা খান [গ্যারি জে ব্যাস এর নিকট প্রদত্ত বিবৃতি] 

বিঃদ্রঃ উপরিউক্ত আর্টিকেল এর উদ্দেশ্য কোনো বিভেদ বা জাতিগত বিদ্বেষের প্রচার নয়। বরং বহুদিন ধরে প্রচলিত প্রোপাগাণ্ডার প্রত্যুত্তর। আমরা ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি, মহান মুক্তিযুদ্ধ সকল বাঙালি-অবাঙালি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ছিল।

তথ্যসূত্র: 

১. পাকিস্তানের গণহত্যার দলিলের অভাব নেই, লজ্জা আর দায় এড়াতেই এখনো অস্বীকার, মেহেদী হাসান, ২৫ মার্চ, ২০১৭। দৈনিক কালের কণ্ঠ।
২. একটি টেলিগ্রাম, একটি বই ও গণহত্যার দলিল, শওগাত আলী সাগর, ২৪ নভেম্বর, ২০১৪, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

⚡মুক্তিযুদ্ধ ও হিন্দু ইতিহাস: ০২

#veda #bangladeshfreedoomfighter

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন