চক্রব্যূহ


চক্রব্যূহ

চক্রবুহ্য বা চক্রব্যূহ হলো একটি প্রাচীন ভারতীয় যুদ্ধ কৌশল বা সামরিক গঠন, যা মহাভারত মহাকাব্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি একটি জটিল, ঘূর্ণায়মান বিন্যাস, যা শত্রুদের বিভ্রান্ত করতে এবং তাদের পরাজিত করতে ব্যবহৃত হতো। চক্রব্যূহকে সাধারণত একটি গোলাকার বা চক্রাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যার মধ্যে সৈন্যরা স্তরে স্তরে সাজানো থাকে এবং ক্রমাগত ঘুরতে থাকে, যাতে শত্রুর পক্ষে এর ভেতরে প্রবেশ করা বা এর গঠন ভাঙা কঠিন হয়ে পড়ে।

✨মহাভারতের প্রেক্ষাপটে চক্রব্যূহ:

মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে চক্রব্যূহের সবচেয়ে বিখ্যাত উল্লেখ পাওয়া যায়, বিশেষ করে অভিমন্যুর মৃত্যুর ঘটনায়। অভিমন্যু, অর্জুনের পুত্র, এই ব্যূহের ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কারণ তিনি গর্ভে থাকাকালীন তার পিতার কাছ থেকে এর ভেদ করার কৌশল শিখেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তিনি ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় জানতেন না। ফলে কৌরবদের প্রধান যোদ্ধারা—দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, কর্ণ, দুর্যোধন প্রমুখ—তাকে ঘিরে ফেলে এবং অসম লড়াইয়ে তাকে হত্যা করে। এই ঘটনা মহাভারতের একটি ট্র্যাজিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত।

✨চক্রব্যূহের গঠন:

চক্রব্যূহের গঠন ছিল অত্যন্ত জটিল। এটি সাধারণত এমনভাবে তৈরি করা হতো:
১. বহিঃস্তর: এখানে সাধারণ সৈন্যরা থাকত, যারা শত্রুকে প্রাথমিকভাবে আটকাত।
২. মধ্যস্তর: এখানে অভিজ্ঞ যোদ্ধারা অবস্থান করত, যারা শত্রুর অগ্রগতি রোধ করত।
৩. অন্তঃস্তর: এখানে সেনাপতি বা প্রধান যোদ্ধারা থাকতেন, যারা ব্যূহের মূল শক্তি ছিল।

ব্যূহটি ক্রমাগত ঘূর্ণনশীল থাকত, যা শত্রুর জন্য এর দুর্বলতা খুঁজে বের করা কঠিন করে তুলত। এটি ভেদ করতে হলে শত্রুকে প্রতিটি স্তর ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে হতো, যা প্রায় অসম্ভব ছিল যদি না তার কাছে এর গঠন ও কৌশল সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকে।

✨মহাভারতের রেফারেন্স:

চক্রব্যূহ কৌশলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে, যেখানে দ্রোণাচার্য কৌশলে চক্রব্যূহ তৈরি করেছিলেন। অর্জুনের অনুপস্থিতিতে অভিমন্যু এতে প্রবেশ করলেও, বাহির হওয়ার কৌশল না জানার কারণে তিনি প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিহত হন।

মহাভারত, দ্রোণ পর্ব (Drona Parva) - 🌱অধ্যায় 47🌱

"तत्राभिमन्युं संप्रेक्ष्य चक्रव्यूहं प्रविश्य च।
निष्क्रम्य न शक्नोति ततो गत्वा निपातितः।।"

(অর্থ): "অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশ করলেন, কিন্তু বাহির হওয়ার পথ জানতেন না, ফলে তিনি সেখানে নিহত হন।"

✨শ্রীমদ্ভগবদগীতা চক্রব্যূহ প্রসঙ্গ

যদিও শ্রীমদ্ভগবদগীতায় চক্রব্যূহের সরাসরি উল্লেখ নেই, তবে যুদ্ধ, কর্তব্য ও ধর্মের উপর গীতার শ্লোকগুলো গুরুত্বপূর্ণ। অভিমন্যুর আত্মত্যাগ এবং তার সংগ্রামের সাথে সম্পর্কিত কিছু গীতার শ্লোক হলো:

🌱শ্রীমদ্ভগবদগীতা 2.47🌱

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি ॥ ২-৪৭॥

(অর্থ): "তোমার কর্তব্য শুধু কর্ম করা, ফলের প্রত্যাশা নয়। কর্মের ফলের জন্য তুমি দায়ী নও, এবং অকর্মণ্যতাও কাম্য নয়।"

এটি চক্রব্যূহে প্রবেশকারী যোদ্ধার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে, কারণ তারা নিশ্চিত পরিণতি না জেনেও কর্তব্যের জন্য যুদ্ধে প্রবেশ করত।

✨চক্রব্যূহের আধুনিক প্রভাব

এনসার্কলমেন্ট (Encirclement Strategy): আধুনিক সামরিক যুদ্ধবিদ্যায় শত্রুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার কৌশল।

ডিফেন্সিভ লেয়ারিং (Defensive Layering): প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে বাহিনী মোতায়েন।

গেরিলা যুদ্ধ: প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য কৌশলগত বিন্যাস, যা চক্রব্যূহের অনুপ্রেরণা বহন করে।
 

চক্রব্যূহ শুধু একটি যুদ্ধ কৌশলই নয়, এটি জীবনের জটিলতা ও চ্যালেঞ্জেরও প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। অনেক সময় এটি এমন পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা হয়, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন।

চক্রব্যূহ  বাস্তব সামরিক কৌশলের একটি উদাহরণ। এটি যুদ্ধের কৌশলগত পরিকল্পনা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সামরিক নেতৃত্বের দক্ষতার প্রতীক। চক্রব্যূহের ধারণা আধুনিক সামরিক রণনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

✏️ #veda
✨ Run with veda

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

▪️আমি কোন পথে যাবো ❓

▪️একাদশী" কি শাস্ত্র সম্মত ❓

🔸সনাতন ধর্ম ও নারী 💐