সনাতন সন্ন্যাসী ও কৃতিত্ব: ০১
"মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জীবনী"
✨ সনাতন সন্ন্যাসী ও কৃতিত্ব: ০১
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী গুজরাটের অন্তর্গত কাঠিবাড়ের মৌর্ভি রাজ্যের টঙ্কারা নামক গ্রামে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চারা গ্রাম মৌর্ভিরাজ্যের প্রধান নগর মৌর্ভির নিকটে অবস্থিত। দয়ানন্দের পূর্ব নাম ছিল মূলজী শঙ্কর। মূলজী শঙ্করের পিতার নাম কর্ষণজী এবং পিতামহের নাম লালাজী। ইহারা উদীচ্য ব্রাহ্মণ। কর্ষণজী ছিলেন উচ্চ রাজকর্মচারী। ভূসম্পত্তিও তাঁহার যথেষ্ট ছিল। তিনি ধর্মভীরু ও বেদানুরাগী ছিলেন। পুত্র মূলজী শঙ্করের তিনি অষ্টম বর্ষে উপনয়ন সংস্কার করাইয়া সন্ধ্যা উপাসনা শিক্ষা দিয়াছিলেন। দশম বর্ষ বয়সে মূলজী সমগ্র যজুর্বেদ কন্ঠস্থ করিয়াছিলেন। চতুর্দশ বর্ষ বয়সে পিতার সহিত সারা দিন উপবাস করিয়া শিবরাত্রির প্রহরে প্রহরে শিবপূজা করিতেছিলেন। শিবলিঙ্গের উপর নির্ভয়ে একটি মূষিক আতপ তন্ডুল খাইতেছে-এই দৃশ্য দেখিয়া তাঁহার মনে মূর্তি পূজা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগিয়াছিল। অষ্টাদশ বর্ষ বয়সে সহোদরা ভগ্নীর ও ঊনবিংশ বর্ষ বয়সে খুল্লতাতের মৃত্যু তিনি স্বচক্ষে দর্শন করায় তাঁহার মনে স্থায়ী বৈরাগ্যের সৃষ্টি হইয়াছিল। মাতা-পিতা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার চেষ্টা করিলে পুত্র দ্বাবিংশ বর্ষ বয়সে গৃহত্যাগ করেন। ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষিত হইয়া "শুদ্ধ চৈতন্য ব্রহ্মচারী" নামে তিনি কাযার বস্তু ও মন্ডল ধারণ করিলেন। পিতা তাঁহাকে বলপূর্বক গৃহে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু সক্ষম হন নাই। নর্মদা প্রদেশের চানোদ-কল্যাণী নামক স্থানে শৃঙ্গগিরি মঠ হইতে আগত পূর্ণানন্দ সরস্বতীর নিকটে সন্ন্যাসাশ্রমে দীক্ষিত হইয়া তিনি দয়ানন্দ সরস্বতী নাম ধারণ করেন। তখন তাঁহার বয়স ২৪ বৎসর। তিনি নানাস্থানে পরিভ্রমণ করিয়া জ্ঞান ও যোগবিদ্যা আহরণ করিয়াছিলেন। চানোদ-কল্যাণীতে পরমানন্দ পরমহংসের নিকট বেদান্তসার, কৃষ্ণ শাস্ত্রীর নিকট ব্যাকরণ, কাশীর রামনিরঞ্জন শাস্ত্রীর নিকট কৌমুদী ও ন্যায়শাস্ত্র এবং জ্বালানন্দ পুরী ও শিবানন্দ গিরির নিকট তিনি যোগাভ্যাস শিক্ষা করিয়াছিলেন। টেহিরিতে কোন রাজপণ্ডিতের নিকট হইতে তিন জ্যোতিষ ও তন্ত্রগ্রন্থ পাঠ করিয়াছিলেন। শ্রীনগর, রুদ্রপ্রয়াগ, শিবপুরী, কেদারঘাট, তুঙ্গনাথশৃঙ্গ, উখিমঠ, গুপ্তকাশী, যোশীমঠ, অলখনন্দার উৎপত্তি স্থল, সিদ্ধপদ, বসুন্ধরা, বদরিনারায়ণ, রামপুর, চিদ্ধাঘাটী, কাশীপুর, দ্রোণসাগর, প্রভৃতি হিমালয়ের দুর্গম তীর্থক্ষেত্রে তিনি জ্ঞানান্বেষণে ও প্রকৃত যোগীর সন্ধানেই পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন। হিমালয়ের বিভিন্ন বনে, গুহায়, নদীতটে এবং তুষারবৃত স্থানে ভ্রমণ কালে বহু সময় তাঁহার জীবনও বিপন্ন হইয়াছিল। এই ভাবে ১৭ বৎসর কাল আর্যবর্তের ও দক্ষিণাত্যের নানা আশ্রম, মঠ, মন্দির দর্শন করিয়া এবং অসংখ্য সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গ করিয়া ৩৯ বৎসর বয়সে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে মথুরায় দণ্ডী স্বামী, ব্রহ্মবিৎ ও বৈদিক পণ্ডিত স্বামী বিরজানন্দের নিকট উপস্থিত হন। তিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ পণ্ডিত। দয়ানন্দ তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া তাঁহার নিকট পাণিনী, মহাভাষ্য, উপনিষদ' মনুস্মৃতি, ষড়দর্শন, বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করেন। বিদ্যাধ্যয়ন সমাপ্তির পর গুরুর নিকট হইতে বিদায় কালে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলেন-"সত্য শাস্ত্রের উদ্ধারে কৃতসঙ্কল্প থাকিব, অবৈদিক মিথ্যা মতবাদের খণ্ডন করিব ও বৈদিক ধর্মের প্রচারে জীবন অর্পণ করিব"। দয়ানন্দ এই প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন। গুরুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া তিনি ভারতের বিভিন্ন তীর্থে ও বিদ্যাকেন্দ্রে পরিভ্রমণ করিয়া বৈদিক ধর্ম প্রচার করিতে থাকিলেন। আগরা, কানপুর, ঢোলপুর, কেরেলা, জয়পুর, আজমীর, হরিদ্বার, কর্ণবাস, রামঘাট, অনুপসহর প্রভৃতি স্থানে বৈদিক ধর্মের প্রচার করিয়া এবং স্থানবিশেষে তিনি দেশের প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ পণ্ডিত, মৌলবী ও পাদ্রীগণের সহিত শাস্ত্র বিচার করিয়া দিগ্বিজয়ীরূপে কাশীধামে উপস্থিত হইলেন। কাশীর পণ্ডিতেরা প্রমাদ গুণিলেন। কাশীর সম্মানরক্ষায় কাশীরাজ অগ্রগ্রামী হইলেন। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর মঙ্গলবার অপরাহ্ণ ৩ ঘটিকায় শাস্ত্র বিচারের তারিখ ও সময় নির্ধারিত হইল। আনন্দবাগে শাস্ত্রবিচারের স্থান নির্দিষ্ট হইল। জনকোলাহলে আনন্দবাগ পরিপূর্ণ হইল। কাশীনরেশ স্বয়ং সভাপতির আসনে উপবিষ্ট হইলেন। পণ্ডিত বালশাস্ত্রী, শিবসহায় শর্মা, মাধবাচার্য, বামনাচার্য, দেবীদত্ত শর্মা, বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী ও অম্বিকা দত্ত প্রভৃতি ৩০ জন লব্ধপ্রতিষ্ঠ পণ্ডিত এক দিকে, অপর দিকে হিমাচল সদৃশ অচল অটল' স্থিরচিত্ত, শান্ত ও গম্ভীর মূর্তি মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী একাকী। বিচার্য বিষয়-"মূর্তিপূজা বেদানুকূল কিনা"। সেই শাস্ত্রবিচারে দয়ানন্দ বিজয় লাভ করিলেন। বিপক্ষ পণ্ডিতেরা কোলাহল করিয়া সভা ত্যাগ করিলেন। বঙ্গের প্রসিদ্ধ বৈদিক পণ্ডিত স্বর্গীয় সত্যব্রত সামশ্রমী সেই বিচার সভায় উপস্থিত ছিলেন। স্বীয় মাসিক পত্র "প্রত্নকমর নন্দিনী'তে তিনি দয়ানন্দের বিজয় ঘোষণা করেন। ইহা ছাড়া "রেহিলাখণ্ড সমাচার" লাহোরের "জ্ঞানদায়িনী পত্রিকা", কলিকাতার প্রসিদ্ধ "হিন্দু পেট্রিয়ট" পত্রিকায় ও "পায়ওনিয়ার" পত্রিকায় শাস্ত্রবিচারের প্রকৃত বিবরণ প্রকাশিত হইল। সব পত্রিকাতেই দয়ানন্দের জয় ঘোষিত শাস্ত্রবিচারের প্রকৃত বিবরণ প্রকাশিত হইল। সব পত্রিকাতেই দয়ানন্দের জয় ঘোষিত হইল। কাশীর পণ্ডিতেরা নিরুপায় হইয়া "দয়ানন্দ পরাভূতি" নামক সংস্কৃত পুস্তক ও "দুর্জন মতমর্দ্দন" নামক হিন্দী পুস্তক এবং গুপ্ত বিজ্ঞাপন ছাপাইয়া দয়ানন্দের বিরুদ্ধে প্রচার করিতে লাগিলেন। শাস্ত্র বিচারের পর ২৬শে জানুয়ারী দয়ানন্দ এলাহাবাদে রওয়ানা হইলেন। তিনি এতদিন তিনি কাশীতেই ছিলেন। কাশীর শাস্ত্রবিচার সভায় "ভূপ্রদক্ষিণ" প্রণেতা ব্রাহ্মসমাজী ব্যারিষ্টার চন্দ্রশেখর সেনও উপস্থিত ছিলেন। তিনি দয়ানন্দকে কলিকাতায় যাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বেদ বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে দয়ানন্দের পূর্ব হইতেই কলিকাতায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তুমরাঁও, পাটনা, জামালপুর, মুঙ্গের ও ভাগলপুরে বৈদিক ধর্ম প্রচার করিয়া তিনি ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর কলিকাতায় উপস্থিত হন। ভাগলপুরের স্থানীয় জমিদার স্বর্গীয় তেজনারায়ণ সিংহ ও তাঁহার আত্মীয় স্বর্গীয় মহাবীর প্রসাদ স্বামীজীর শিষ্য হন। এই মহাবীর প্রসাদ কলিকাতায় থাকিতেন এবং ইনিই সর্বাগ্রে কলিকাতায় আর্যসমাজের মন্ত্রী ছিলেন এবং ইহার অর্থ সাহায্যেই স্বর্গীয় দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় উপাদান সংগ্রহ করিয়া দয়ানন্দের জীবনী সর্বপ্রথম বাঙ্গলা ভাষায় প্রকাশ করেন। ২০ হাজার টাকা ব্যয় করিয়া তিনি কলিকাতায় "আর্যবর্ত প্রেস" স্থাপন ও "আর্যবর্ত" হিন্দি সমাচার পত্র প্রকাশ করেন ও বহু বৈদেশিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। স্বামী দয়ানন্দকে হাওড়া স্টেশনে অভ্যর্থনা করিয়া স্বর্গীয় চন্দ্রশেখর সেন তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া পাথুরিয়া ঘাটার রাজা যতীন্দ্র মোহন ঠাকুরের গৃহে উপস্থিত হন। তাঁহার ভ্রাতা সৌরেন্দ্র মোহন ঠাকুর বরাহ নগরের সন্নিকটে নৈনানের বাগান বাড়ীতে তাঁহার থাকিবার ব্যবস্থা করিয়া দেন। এই সময় কলিকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ স্বামী দয়ানন্দের নিকটে গিয়া নানা বিষয়ের আলোচনা করিতেন। কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, উক্ত কলেজের অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও পণ্ডিত রাজনারায়ণ গৌড় তাঁহার সহিত অতি কূট বিষয় লইয়া প্রশ্নোত্তর করিতেন। স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, সিটা কলেজের অধ্যক্ষ কৃষ্ণচন্দ্র মিত্র, আদি ব্রাহ্মা সমাজের উপদেশক হেমচন্দ্র চক্রবর্তী, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাজনারায়ণ বসু মহাশয় দয়ানন্দের প্রতি অনুরক্ত হন। ব্রাহ্মসমাজী হইলেও দ্বিজেন্দ্রনাথ ও রাজনারায়ণ অগ্নিহোত্রের উপযোগিতা স্বীকার করিয়াছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রাজনারায়ণ বসু মহাশয়ের অনুরোধে কলিকাতা আর্যসমাজের পক্ষ হইতে পণ্ডিত শঙ্করনাথ বোলপুর শান্তি নিকেতনে উপাসনার বেদীর সম্মুখে হোম করার জন্য পণ্ডিত অচ্যুতানন্দ মিশ্রকে প্রেরণ করিয়াছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ যতদিন বাঁচিয়াছিলেন ততদিন এবং তাঁহার মৃত্যুর পরেও বহুদিন নিয়মিতভাবে সেখানে হোমানুষ্ঠান হইত। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে দয়ানন্দ ত্রিচত্বারিংশ মাঘোৎসবের ১১ই মাঘ জোড়াসাঁকো রাজবাড়ীতে উপস্থিত হইয়াছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁহার পুত্রগণ দয়ানন্দের সহিত বার্তালাপে খুবই আহ্লাদিত হইয়াছিলেন। দয়ানন্দ সংস্কৃত ভাষায় বক্তৃতা করিতেন ও কৌপীন মাত্র পরিধান করিতেন। কেশবচন্দ্রের অনুরোধে তিনি হিন্দীতে বক্তৃতা আরম্ভ করেন ও সাধারণভাবে বস্ত্র পরিধান আরম্ভ করেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ৯ই জানুয়ারী তারিখে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের লিলি কটেজে দয়ানন্দ বক্তৃতা করিয়াছিলেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি স্বর্গীয় গোরাচাঁদ দত্তের গৃহে ও ৯ই মার্চ বরাহনগরের নৈশ বিদ্যালয়ে দয়ানন্দের বক্তৃতা হয়। কলিকাতায় আরও অনেক স্থানে তাঁহার বক্তৃতা হয়। তাঁহার কলিকাতায় অবস্থিতিকালে কেহ তাঁহার সহিত শাস্ত্রবিচার করিতে সাহস করেন নাই। কলিকাতার বাহিরে হুগলী, চুঁচুড়া, নবদ্বীপ, মূলাজোড় ও মুর্শিদাবাদের অপর পারে বালুচর নামক স্থানে বৈদিক ধর্ম সম্বন্ধে তিনি বক্তৃতা করেন। চুঁচুড়ার স্বর্গীয় বৃন্দাবনচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়ের গৃহে তাঁহার বক্তৃতা হয়। স্ব০ তারাচরণ তর্করত্ন মহাশয়, দয়ানন্দের সহিত শাস্ত্রবিচারে অগ্রসর হন ও কিয়ৎকাল পরে পরাজয় স্বীকার করেন। ইনিই কাশী শাস্ত্রবিচারে ছিলেন। চুঁচুড়ার শাস্ত্রবিচার সভায় স্ব০ ভূদেব মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই এপ্রিল তারিখে তিনি বঙ্গদেশ পরিত্যাগ করেন। হুগলী হইতে তিনি ভাগলপুর যাত্রা করেন। বঙ্গদেশে তিনি চারি মাস কাল অবস্থান করিয়াছিলেন। কলিকাতায় বেদবিদ্যালয় স্থাপনের জন্যও তিনি সচেষ্ট ছিলেন কিন্তু তাহা সম্ভব হয় নাই। দয়ানন্দের কলিকাতা ত্যাগের পর কলিকাতা সিনেট হলে দয়ানন্দের বিরুদ্ধে এক সভার অনুষ্ঠান হয়। মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, পণ্ডিত তারানাথ বিদ্যাবাচস্পতি, পণ্ডিত রসময় বিদ্যালঙ্কার ও নবদ্বীপের পণ্ডিত-ভূষণচন্দ্র তর্করত্ন এই সভার উদ্যোক্তা ছিলেন। তিন শতাধিক পণ্ডিত এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। মাদ্রাজের রাম সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীও এই সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। মহারাজ যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর, রাজা রাজেন্দ্রনাথ মল্লিক, উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, স্ব০ চারুচন্দ্র মল্লিক, রাজা কৃষ্ণদাস পাল প্রভৃতি অনেকেই সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। দয়ানন্দের অনুপস্থিতিতে দয়ানন্দের বিরুদ্ধে সভার আয়োজন হইয়াছে বলিয়া স্ব০ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সে সভায় যোগদান করেন নাই। সভায় দয়ানন্দের বিরুদ্ধে একতরফা বক্তৃতা হইয়াছিল। দয়ানন্দ বঙ্গদেশ হইতে রওয়ানা হইয়া ছাপরা, ফরাকাবাদ, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, নাসিক প্রভৃতি স্থানে শাস্ত্রবিচার ও বৈদিক ধর্ম প্রচার করিয়া ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বোম্বাই শহরে উপনীত হন। এই ভ্রমণ কালে তিনি বহু স্থানে বেদবিদ্যালয়ও স্থাপন করিয়াছিলেন। এলাহাবাদ অবস্থানকালে তিনি "সত্যার্থ প্রকাশ" গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়া রাজা জয়কৃষ্ণ দাসকে তাহা মুদ্রিত করিবার ভার দিয়াছিলেন। যাহাতে বৈদিকধর্মের পুনরুদ্ধারের জন্য দেশব্যাপী প্রচার কার্য স্থায়ীরূপে চলিতে পারে এইজন্য ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই এপ্রিল তারিখে তিনি সর্বপ্রথম আর্যসমাজ স্থাপন করেন। পৃথক্ কোনো সমাজ, সম্প্রদায় বা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্দেশ্য তাঁহার ছিল না। মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ দ্বারাই বৈদিক ধর্মের পুনরুদ্ধার হইতে পারিবে-প্রথমে তিনি এই আশাই পোষণ করিয়াছিলেন কিন্তু ব্রহ্ম সমাজের ও প্রার্থনা সমাজের নেতৃবৃন্দের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়া তিনি অনুভব করিতে পারিয়াছিলেন যে, তাঁহারা রাজা রামমোহনের উদ্দেশ্য ও আদর্শ হইতে বিচ্যুত হইয়া ভিন্ন পথে পরিচালিত হইতেছেন। বোম্বাই শহরে মাত্র ২৩টি ব্যক্তি হইয়া আর্যসমাজ স্থাপিত হইল। সভাপতি হইলেন কর্ষণ দাস। দয়ানন্দকে সভাপতি পদের জন্য নানাভাবে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি সে পদ গ্রহণ করিলেন না। সাধারণ সদস্য পদ গ্রহণ করিয়াই তিনি তৃপ্ত রহিলেন। এইবার তিনি সমগ্র বেদ মুদ্রিত করিয়া জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য ব্রতী হইলেন। রাবণ, মহীধর, উবট, সায়ণ প্রভৃতির নবীন বেদভাষ্যে বেদের সত্য ধর্ম আবৃত রহিয়াছে, অন্যদিকে মোক্ষমূলার, গ্রীফিথ প্রভৃতির অনুবাদে বেদ সম্বন্ধে নানারূপ প্রান্তমত প্রচারিত হইতেছে। এই বেদকে দেশের ও বিদেশের ভাষ্য ও অনুবাদের লাঞ্ছনা হইতে রক্ষা করিবার জন্যই তিনি যাস্কের নিরক্তকে ভিত্তি করিয়া যৌগিক ব্যাখ্যার সাহায্যে বেদভাষ্য প্রণয়নে ব্রতী হইলেন। কাশীতে তিনি বেদভাষ্য রচনার সূত্রপাত করেন। অযোধ্যার সরযূবাগে তিনি "ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা" প্রণয়ন করেন। মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে "ভারত সম্রাজ্ঞী" উপাধিকে অভিহিত করার জন্য রাজপ্রতিনিধি লর্ড লিটন যখন দিল্লীতে মহাসমারোহে দরবারের আয়োজন করিতেছিলেন তখন দয়ানন্দ "ঋগ্বেদাদি ভাষ্য ভূমিকা'র পাণ্ডুলিপি লইয়া দিল্লীতে উপস্থিত হইলেন। তিনি ভারতভূমি হইতে ধর্মবিরোধ দুরীকরণের জন্য এক সম্মেলনে সর্বসম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দকে আহ্বান করিয়াছিলেন। তাহাতে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র, স্যার সৈয়দ আহম্মদ, হরি দেশমুখ, লালা অলখধারী, নবীচন্দ্র রায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি অনেকেই উপস্থিত হইয়াছিলেন। সব প্রতিনিধিই স্ব স্ব অভিমত ব্যক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু সকলে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিলেন না। ব্যর্থ মনোরথ হইয়া সকলে সভাস্থল ত্যাগ করিলেন। দিল্লী হইতে মীরাট যাত্রার সময়ে তিনি এক বাঙ্গালী যুবকের উপর বেদ-ভাষ্য মুদ্রণের ভার দিয়া তাঁহাকে কাশীতে পাঠাইয়া দেন। এই বাঙ্গালী যুবকই দয়ানন্দকে মোক্ষমূলর, গ্রীফিথ প্রভৃতির বেদের ইংরেজী অনুবাদ পড়িয়া শুনাইতেন। কেশবচন্দ্র দয়ানন্দকে ইংল্যান্ডে বেদ প্রচারের জন্য উৎসাহ দিয়াছিলেন। তজ্জন্য তিনি প্রস্তুতও হইয়াছিলেন কিন্তু তাঁহার প্রীতিভাজন ছাত্র শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা দ্বারা তাঁহার সে সঙ্কল্প পরিত্যাগ করেন। শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা দ্বারা তাঁহার সে ইচ্ছা পূরণ হয় নাই। মীরাট হইতে দয়ানন্দ চাঁদাপুরে আগমন করেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ তারিখে মুন্সি প্যারেলাল চাঁদাপুর মেলায় হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান মতের আলোচনার জন্য এক বিরাট সম্মেলনের আয়োজন করেন। তাহাতে স্কই, নোবেল, পার্কার ও জনসন নামক পাদরী-চতুষ্টয় খ্রিস্টানদের পক্ষ হইতে, মোহম্মদ কাসেম আব্দুল মজুর নামক মৌলবীদ্বয় মুসলমানদের পক্ষ হইতে এবং স্বামী দয়ানন্দ বৈদিক ধর্মের বা হিন্দুধর্মের পক্ষ হইতে অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। শাস্ত্রবিচারে টিকিতে না পারিয়া মৌলবীরা ও পাদরীরা সভাস্থল পরিত্যাগ করেন। সভায় বৈদিক ধর্মেরই জয় ঘোষিত হইল। লাহোরের ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ হইতে স্বর্গীয় নবীনচন্দ্র রায় পণ্ডিত অমর নাথ প্রভৃতি দয়ানন্দকে লাহোরে আনয়ন করিলেন। দয়ানন্দের বক্তৃতায় রক্ষণশীল হিন্দুরা ক্রুদ্ধ হইলেন। ব্রহ্মসমাজীরাও সুখী হইতে পারিলেন না। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের অনেকে দয়ানন্দের বৈদিক সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করিলেন। ব্রহ্মসমাজের কর্তৃপক্ষ দয়ানন্দের আন্দোলনের বিরোধী হইলেন। উপায়ান্তর না দেখিয়া কতিপয় বিশিষ্ট সদস্য ব্রাহ্মসমাজ পরিত্যাগ করিয়া লাহোরে আর্যসমাজ স্থাপন করিলেন। লালা মূলরাজ আর্যসমাজের সভাপতি হইলেন এবং সারদা প্রসাদ ভট্টাচার্য সহকারী সভাপতি হইলেন। ব্রাহ্মসমাজের উপকরণাদি লইয়া ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন লাহোরের ডাঃ রহিম খাঁর গৃহে আর্যসমাজের প্রথম অধিবেশন হইল। সেইদিন ব্রাহ্মসমাজের নির্দিষ্ট উপাসনা পদ্ধতি অনুসারেই আর্য সমাজের উপাসনা কার্য নির্বাহিত হইয়াছিল। আর্যসমাজের জন্য লাহোরে আর্যসমাজ স্থাপনের দিন কোন উদার ব্রহ্ম সমাজ বা হিন্দু স্থান দান করেন নাই। এখানে মুসলমান ডাঃ রহিম খাঁর উদারতা উল্লেখযোগ্য। এইভাবে দয়ানন্দ তাঁহার জীবদ্দশায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহু আর্যসমাজ স্থাপন করিয়াছিলেন। কর্ণেল অল্ফট্ ও ম্যাডাম ব্লাভাটস্কি আমেরিকা হইতে ভারতে আসিয়া দয়ানন্দকে সভাপতিরূপে রাখিয়া থিওসাফিষ্ট সম্প্রদায় স্থাপন করেন। তাঁহাদের গতিবিধি ও উদ্দেশ্য সন্দেহজনক মনে করিয়া কিছুদিন পর দয়ানন্দ তাঁহাদের সংশ্রব ত্যাগ করেন। রাজপুতানার দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে বৈদিক ধর্মের পুনুরুদ্ধার কল্পে তিনি আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছিলেন। উদয়পুরের মহারাণা মহাদেব গোবিন্দ রাণাড়ে, শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা প্রভৃতি ২৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লইয়া তিনি পরোপকারিণী সভা স্থাপন করেন এবং তাহাতে তিনি তাঁহার পুস্তক, ধন, বস্ত্রাদি ও যথাসর্বস্ব দান করেন। যোধপুরে থাকা কালীন আততায়ী তাঁহার খাদ্য-দ্রব্যে বিষ মিশ্রিত করিয়া দেয়। তাহার ফলে তাঁহার শরীরে ব্রণ হয়। চিকিৎসার জন্য তিনি আজমীরে চলিয়া আসেন। যজুর্বেদ ভাষ্য তিনি সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন ঋগ্বেদের ভাষ্য তিন চতুর্থাংশ সম্পূর্ণ হইয়াছিল। পরবর্তী অসম্পূর্ণ অংশের ভাষ্য কলিকাতার প্রসিদ্ধ দাতা শেঠ নারায়ণজী পোদ্দার ও শেঠ ছাজুরাম চৌধুরীর অর্থব্যয়ে পণ্ডিত শিবশঙ্করজী কাব্যতীর্থ ও পণ্ডিত আর্যমুনি দ্বারা সম্পাদিত ও মুদ্রিত হইয়াছিল, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ৩০শে অক্টোবর মঙ্গলবার উপাসনান্তে সমাধিস্থ হইয়া পরে চক্ষুউন্মীলন করিয়া "হে দয়াময়, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক" এই কথা বলিতে বলিতে তিনি দেহত্যাগ করেন।
স্বামী দয়ানন্দ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করিয়াছেন বটে কিন্তু তাঁহার জীবনের বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ দেশবাসীকে নিরন্তর প্রেরণা দান করিতেছে। তিনি ভারতবর্ষকে নানাবিধ অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন দেখিয়াছিলেন। ধর্মের নামে, পরকালের নামে ও মুক্তির নামে বহু লোক দেশবাসীকে শোষণ করিতেছে, পূজার নামে জীব বলি দ্বারা মন্দির কলুষিত হইতেছে; স্ত্রী ও শুদ্র সর্ব মানবের ধর্মগ্রন্থ অক্ষয় জ্ঞান ভাণ্ডার বেদের শিক্ষা দীক্ষা হইতে বঞ্চিত রহিয়াছে। কর্তাভজা, গুরুবাদ, অবতারবাদ ও পৌরোহিত্যবাদের শোষণনীতি ও দুর্নীতিতে দেশবাসী বিভ্রান্ত; পাশ্চাত্য সভ্যতার মোহে ও চাকচিক্যে আর্যসন্তান দলে দলে খ্রিস্টান মত গ্রহণ করিতেছে; সমাজের অনুদারতা ও অত্যাচারে নির্যাতিত হইয়া দেশবাসী মুসলমান মত গ্রহণ করিতেছে; বেদের শিক্ষাদীক্ষা বিলুপ্ত। পুরাণ, কুরাণ ও বাইবেলের মতমতান্তরে বৈদিক ধর্ম লোকচক্ষুর অন্তরালে সমাচ্ছন্ন সর্বোপরি দাসমনোভাবে ও সংকীর্ণতার শৃঙ্খলে দেশের অধিকাংশ নরনারীই আবদ্ধ-দয়ানন্দ দেশের এই ভয়াবহ দৃশ্য স্বচক্ষে দেখিয়া মর্মাহত হইয়াছিলেন। বেদ ও বৈদিক ধর্মের পুনরুদ্ধার ব্যতীত আর্যসন্তানগণ পূর্বগৌরব ফিরিয়া পাইবে না-এই ধারণার বশবর্তী হইয়া তিনি বেদোদ্ধারে ব্রতী হইয়াছিলেন। যাহাতে সমগ্র বিশ্বে বৈদিক ধর্মের প্রচার হয় ও আর্যাবর্তের নরনারী জ্ঞানে গুণে শুদ্ধ হয়, এ জন্য তিনি আর্যসমাজ স্থাপন করিয়াছিলেন। জ্ঞানকাণ্ডের জন্য তিনি "সত্যার্থ প্রকাশ" ও "ঋগ্বেদাদি ভাষ্য ভূমিকা", কর্মকাণ্ডের জন্য "সংস্কার বিধি" ও উপাসনা বা ভক্তিকাণ্ডের জন্য "আর্যাভিবিনয়" গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। আর্যসমাজ মহর্ষি দয়ানন্দের প্রারদ্ধ কার্য পূরণের জন্যই স্থাপিত হইয়াছিল। শুদ্ধি, সংগঠন, বেদপ্রচার, গুরুকুল স্থাপন, অনাথ-অবলা উদ্ধার দ্বারা আর্যসমাজ আজ ভারতে ও ভারতের বাহিরে ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষেত্রে বিপ্লব ও চেতনার সঞ্চার করিয়াছে। এ সবই মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর দান।
✏️Run With #veda
মন্তব্যসমূহ