"পদবি নহে, কর্মগুণে শ্রেষ্ঠত্ব"
"পদবি নহে, কর্মগুণে শ্রেষ্ঠত্ব"
মনুষ্যের প্রকৃত সৌন্দর্য, শ্রেষ্ঠত্ব তাহার কর্মে। একজন ব্যক্তির নাম, বংশমর্যাদা কিংবা পদবির ব্যবহার থেকে তাহার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় এমন মোটেও নয়। কারণ, নিজ নাম কিংবা বংশমর্যাদা বা পদবির গৌরব ব্যক্তির কর্মের কারণে সুপরিচিতি কিংবা মর্যাদাবান করে তোলে। নিজের নামের শেষে সুউচ্চ পদবি ব্যবহার করে কিংবা নিজের পূর্বপুরুষের বংশধর হিসেবে নিজেকে গৌরবান্বিত করতেই পারে। কিন্তু নিজ কর্ম যদি তদরুপ না হয়, তবে সে আত্মাভিমানে পুলকিত হওয়ার অনর্থক ও মূর্খের সদৃশ কর্ম।
বর্তমান সময়ে এসে, আমরা সকলে নিজের নামের শেষে নির্দিষ্ট কিছু পদবি ব্যবহার করতে গর্ববোধ করে থাকি। পূর্বপুরুষের পদবি ব্যবহার করে, নিজেকে পরিচিত করার চেষ্টা করে থাকে সমাজে সিংহভাগই। কিন্তু আমরা কি কখনো এই পদ-পদবীর ইতিহাস সম্পর্কে জানার প্রয়াস করেছি কিংবা এই পদবির দম্ভোক্তি সত্যই যথোচিত কি না সে বিষয়ে ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি ⁉️
পদবির ইতিহাস খুব প্রাচীন বা প্রাগৈতিহাসিক এমন নয়। বরং ইতিহাসবিদগণ পদবির দম্ভোক্তিকে ইতিহাসের কালগণনায় নবধারা হিসেবে গণ্য করেন।
আমরা সনাতনী ভ্রাতা-ভগিনীগণ যদি নিজেদের ঐতিহাসিক ধর্মগ্রন্থ মহাভারত ও বাল্মিকী রামায়ণ এর দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে আমরা এই পদবির উল্লেখ পাইনা। যদি আমাদের প্রশ্ন করা হয়, যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এর পদবি কি ছিল, দ্রৌপদী কিংবা পঞ্চ পান্ডবদের পদবি কি ছিল কিংবা বাল্মিকী রামায়ণ এ মহাবলী হনুমান, মেঘনাদ কিংবা আর্য শ্রেষ্ঠ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর পদবি কি ছিল? তবে আমাদের কাহারো পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভবপর হবে নাহ। কারণ, এই পদবির দম্ভোক্তি সত্যি খুব প্রাগৈতিহাসিক নয়। এমনকি সেই সময়ের প্রভাবশালী মুনি-ঋষিদের নামের শেষেও কোনও বর্ণজ্ঞাপক পদবীর চিহ্ন নেই। বরং সে যুগে বিভিন্ন রাজবংশের পরিচিতি ছিল ব্যক্তির নাম অনুসারে, পদবী অনুযায়ী নয়। যেমন- কুরুবংশ, রঘুবংশ ইত্যাদি। তাই মনে করা হয় যে, একমাত্র শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকলাপ (পুজো, বিয়ে, উপনয়ন, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি) ছাড়া শৰ্ম্মা, বৰ্ম্মা, ভূতি, দাস ইত্যাদি ব্যবহৃত হতো না। সম্ভবত তথাকথিত পৌরাণিক যুগের বেশ কয়েক শতাব্দী পরে সনাতনীদের নামের সাথে পদবী জুড়ে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। পূর্বে পদবী ছিল না; তবে অন্তনাম ছিল। যেমন গুপ্ত, পাল ও আদি মধ্যযুগের বিভিন্ন লিপি ও তাম্রশাসনে -শর্ম্মণ, -দেব, -স্বামী, -ভট্ট ইত্যাদি অন্তনাম। কালক্রমে এই অন্তনাম থেকে ধীরে ধীরে পদবী যাত্রা আরম্ভ হয়।
📌 পদবির উৎস: বাংলায় জাতি বিভাজনের ইতিহাসে বল্লাল সেনের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। সেন বংশের রাজত্বকালে বিশেষত বল্লালসেনের সময় জাতিভেদ প্রথা একধরণের মান্যতা পেতে শুরু করে। বল্লালসেন কর্মভেদ বা পেশা অনুযায়ী সনাতনীদলর ৩৬টি জাত বা শ্রেণীতে ভাগ করেন। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে, সনাতনীদের উদ্দেশ্য বলা হতো হিন্দুদের তো ৩৬ জাতি। কিন্তু পদবির প্রভাব শুধু এই তত্ত্ব থেকে বৃদ্ধি ঘটেনি। বরং, পদবি সৃষ্টিতে স্থান, পেশা, গোত্র, উপাধি বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
📌 গোত্র ও প্রবর ভিত্তিক পদবী: ধারণা করা হয়ে থাকে, পদবীর বিবিধ উৎসের মধ্যে গোত্র ও প্রবরভিত্তিক পদবীই সর্বপ্রাচীন। গোত্রভিত্তিক পদবী বর্তমান সময়েও বিয়ে ও অন্যান্য শাস্ত্রীয় কাজে গুরুত্বপূর্ণ। মোট ৩৭টি গোত্র ও ৬৯টি প্রবরের নাম পাওয়া যায়, যদিও আজকাল এত গোত্রনাম শোনা যায় না। গোত্র-প্রবর্তক ও সেই বংশের ঋষিদের প্রবর বলা হয়। উদাহরণস্বরুপ, কাশ্যপ গোত্রের প্রবর কশ্যপ, অপ্সার, নৈধ্রুব। গোত্রভিত্তিক যেসব পদবী এখনও প্রচলিত সেগুলি হল ভার্গব, ভরদ্বাজ, কপিল, গর্গ, বিষ্ণু, গৌতম, কাশ্যপ ইত্যাদি। সব গোত্রই একসময় পদবী হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এখনও কিছু রয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলে ও মহারাষ্ট্রে।
📌 পেশা ভিত্তিক পদবী: পদবীর অন্যতম উৎস পেশা বা কর্ম। অন্নসংস্থান এর জন্য মানুষ যুক্ত হয়েছে বহুবিধ পেশায়। সেই পেশার সঙ্গে জুড়ে গেছে নামের পদবী বা উপনাম হিসেবে, এবং বংশপরম্পরায় বয়ে নিয়ে চলেছে সেই পেশার স্মৃতি। এরকমই কিছু পদবী হলো – আচার্য্য, কানুনগো, কীর্ত্তনীয়া, খাসনবিশ, গায়েন, ঘটক, চৌধুরী, জোয়ারদার, তালুকদার, তরফদার, থাণ্ডার, বক্সী, মহাপাত্র, মজুমদার, মালাকার, লস্কর, হাজরা, হালদার ইত্যাদি।
📌 উপাধিভিত্তিক পদবী: রাষ্ট্র বা প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে উপাধি প্রাপ্তির প্রচলন রয়েছে। তবে সে-সকল উপাধি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে তাহার কর্মের ভিত্তিতে প্রদান করা হয়েছিলো। কিন্তু সে উপাধি যোগ্যতা কিংবা ধারণের অধিকারী না হওয়া সত্ত্বেও
উত্তরসূরীরা অনুসরণ করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, খাঁ, চক্রবর্তী, চূড়ামণি, বিদ্যাসাগর, রায়বাহাদুর ইত্যাদি।
📌 স্থানভিত্তিক পদবী: ভৌগোলিক কারণেও পদবীর প্রচলন রয়েছে। বর্তমান সময়ের গাঞি পদবীগুলো। যেমন, গঙ্গ (গাঞি নাম) + উপাধ্যায় গঙ্গোপাধ্যায়; বন্দ্যো (গাঞি নাম) + উপাধ্যায় – বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি।
ঐতিহাসিকদের ধারণা পদবি বিশেষত জাতিপ্রথাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সেজন্য 'শনিবারের চিঠি'তে সজনীকান্ত দাস সাহস করেই লেখকদের পদবী বিলুপ্ত করেছিলেন। পদবী যে প্রতিক্রিয়াশীলতাকে উসকানি দেয় তা সজনীকান্ত দাস পরিষ্কার দেখতে পেতেন বলেই মনে হয়। পদবীর আড়ালেই তো লুকিয়ে থাকে জাতিভেদ। যেমন করুণাময় গুড় নামে এক ব্যক্তি সকল গুণের অধিকারী হয়েই যোগ দিয়েছিলেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে। কিন্তু অধস্তনরা তাকে মানতে নারাজ। কারণ তাদের ধারণা, গুড় মশাই নিম্ন বর্ণের।
জাতিপ্রথার প্রভাব এতই গভীরভাবে পদবীতে প্রভব পড়েছিলো যে তা একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়।
ব্রাহ্মণ, পুরোহিত এবং বৈষ্ণব, বণিক, কায়স্থ, বৈদ্য, মাহিষ্য, ভূ-স্বামীদের প্রাপ্ত পদবী, নবশায়ক ও অন্যান্য পেশাজীবী পদবী, তফশীলী জাতি গৃহীত পদবী সমূহ দ্বারা বর্তমানে নব ছদ্মবেশী জাতপ্রথাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আলোচনা দীর্ঘায়িত না করার জন্য এবং বৈষম্যহীন সমাজ এর জন্য সে পদবী সমূহকে বিভাজন এড়িয়ে চলা উত্তম।
পদবী আমাদের পরিচয় এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেজন্য, এই পদবীকে নাকচ করা কঠিন ও অসম্ভব বটে। কিন্তু এই পদবীর দম্ভোক্তি আমাদের সনাতনী সমাজকে ভেতর থেকে দূর্বল, বিভাজিত ও বৈষম্য সৃষ্টি করে চলছে এটা অনস্বীকার্য। বর্তমান সময়ে জাতিপ্রথা অনেকাংশে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। শাস্ত্র সচেতন ও মহাপুরুষদের প্রচেষ্টার ফলে, বর্ণাশ্রম ও জাতিপ্রথার মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট এবং জন্ম নয় বরং গুণ ও কর্মের মাধ্যমে বর্ণ নির্ধারিত হয় এটা ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট। বর্ণাশ্রম জন্মের ভিত্তিতে নয় বরং গুণ ও কর্ম অনুসারে তা পবিত্র বেদ এর মন্ত্রে ও শ্রীমদ্ভগবদগীতার শ্লোকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। ঋগ্বেদ ৯ম মন্ডল, ১১২তম সুক্তের ১ম মন্ত্রে পরমাত্মা আমাদের উদ্দেশ্যে বলছেন,
"নানানাং বা উ ন ধিয়ো বি ব্রতানি জনানাম্।"
-ঋগ্বেদ ৯/১১২/১
অর্থাৎ, আমাদের নানা জনের চিন্তা, মেধা ও বুদ্ধি নানারকম। আর সেই অনুসারেই আমাদের ব্রত তথা কর্ম নির্ধারিত হয়।
শ্রীমদ্ভগবদগীতা যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ বিষয় স্পষ্ট করে বলেছেন,
"চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ"
- শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৪/১৩
অর্থাৎ গুণ ও কর্মের অনুসারেই চার বর্ণের শ্রেণীবিভাগ হয়েছে।
"ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রানাং চ পরন্তপ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানিং স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ"।।
- শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১৮/৪১
অর্থাৎ, হে পরন্তপ! স্বভাবজাত গুণ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রদের কর্মসমূহ বিভক্ত হয়েছে।
তবে শাস্ত্রের সেই বিধান যেন অসার হয়ে যায় আমাদের পদবীর দম্ভোক্তিতে এসে। একজন মনুষ্য তাহার বংশীয় পদমর্যাদা কিংবা ইতিহাস এর অংশীদার হবে এবং গর্ববোধ করবে এটা স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু সে অংশীদারত্ব যখন নিজেকে বড় করে, অপরকে অস্পর্শ কিংবা নিচু দেখানোর মতো বিষয় হয় তবে সেটা অশনিসংকেত।
আমরা সকলে ধীরে ধীরে শাস্ত্র সচেতন হচ্ছি। কিন্তু এখনো আমাদের মধ্যে পদবী দ্বারা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষত, বিবাহ সংস্কার এর সময়ে এই পদবী হয়ে দাঁড়ায় এক দূর্ভেদ্য প্রাচীর হিসেবে। নির্দিষ্ট পদবীর লোকেরা, অপর পদবীর সঙ্গে কোনো প্রকার বৈবাহিক সম্পর্ককে মান্যতা দিতে প্রস্তুত নয়। যা বহুবিধ ক্ষেত্রে, অঘটনের কারণ হয়ে থাকে। যেমন তথাকথিত জন্মগত ব্রাহ্মণ পদবীর উত্তরসূরীদের এরূপ বিভাজন সুস্পষ্ট। ফলস্বরূপ, আমাদের সনাতনী সমাজ এখনো সর্বোতভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ছে।
এটা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, জাতিপ্রথা সনাতন ধর্মের অংশ নয় বরং বর্ণাশ্রম যা গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। তবে কেন? এখনো সে কুপ্রথার প্রভাব এখনো বর্তমান। এটা আমাদের মধ্যে থাকা মিথ্যা দম্ভোক্তির বহিঃপ্রকাশ নয়তো কি?
📌 বর্তমান সময়ে বংশীয় পদবী নিয়ে সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা যেমন কম নয়, তেমনি অসুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা সহস্রগুণ। আমাদের কর্মই আমাদের পরিচয়। কিন্তু কর্ম শুধুমাত্র দায়িত্ব স্বরুপ। সে দায়িত্ব পালনকে কেন্দ্র করে যদি আমাদের মধ্যে কোনো দম্ভোক্তি কিংবা বিভাজনের সৃষ্টি হয় তবে আমরা পরমাত্মার উপদেশকে অমান্য করছি। যা কোনো ভাবে কাম্য নয়। আমরা কর্মগুণে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শুদ্র হবো কিন্তু আমাদের সন্তান শুধুমাত্র জন্মসূত্রে সে বর্ণের উত্তরসূরি হতে পারে নাহ। বরং তাহার মধ্যে যদি সে গুণ বিদ্যমান থাকে, একমাত্র তবেই সে উক্ত বর্ণের উত্তরসূরি হতে পারে।
সেজন্য, হে অমৃতের সন্তানগণ! শাস্ত্রে আমাদের সকলকে অমৃতের সন্তান হিসেবে সম্বোধন করেছে।
"শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ" - ঋগ্বেদ ১০/১৩/১
অর্থাৎ, শোন হে বিশ্ববাসী, তোমরা সকলে অমৃতের সন্তান। সেজন্য, আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ কিংবা পদ-পদবীর দম্ভোক্তি কাম্য নয়। পদবীর দম্ভোক্তিতে কাহারো প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করা অধর্ম। কারণ শাস্ত্র বলেছে, "অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সং ভ্রাতরো বাবৃধুঃ" - ঋগ্বেদ ৫/৬০/৫ অর্থাৎ, তোমরা সকলে ভাই ভাই, কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়।
🔎Run with #veda
মন্তব্যসমূহ