সৈনিক যুদ্ধে হত্যা করলে তা কেন পাপ নয় ⁉️
সৈনিক যুদ্ধে হত্যা করলে তা কেন পাপ নয় ⁉️
সনাতন ধর্মশাস্ত্র সদা সত্য ও যৌক্তিক প্রমাণের আলোকে যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রদান করে। অসত্য, অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত ধারণার স্থান সনাতন শাস্ত্র সমূহে অনুপস্থিত। জীবাত্মার জন্য মঙ্গলজনক, কল্যাণকর ও মোক্ষ প্রদায়ী উপদেশ রয়েছে ধর্মশাস্ত্র সমূহে।
জীবনের কণ্টকাকীর্ণ পথে নিজেকে অদম্য আগ্রহের সাথে পরিচালিত করার জন্য ধর্মশাস্ত্র আলোকশক্তি। কারণ, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সংশয় ও দ্বিধায় পরিপূর্ণ। সে সংশয় নিবারণে ধর্মশাস্ত্র একমাত্র আস্থার পাত্র। তেমনি এক সংশয় উদীয়মান হয়েছে সনাতনী ভ্রাতা-ভগিনীর মধ্যে যে,
"হত্যা করা অনুচিত" ইহা সনাতন ধর্মশাস্ত্রের অন্যতম শিক্ষা। সেজন্য আমাদের অন্যতম প্রচলিত বাক্য "অহিংসা পরম ধর্ম"। তবে একজন সৈনিক যুদ্ধে হত্যা করলে তা পাপ নয় কেন?
সনাতন ধর্মের সর্বোত্তম গ্রন্থ বেদে নিরীহ প্রাণী ও নিরপরাধ মনুষ্য হত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে।
"ও৩ম্ ইমং মা হিংসীদ্বিপাদ পশু সহস্রাক্ষ মেধায় চীয়মান" - যজুর্বেদ ১১/৪৭
অর্থাৎ, হে সহস্র প্রকার দৃষ্টি যুক্ত রাজন! সুখ প্রাপ্ত করানোর জন্য নিরন্তর বৃদ্ধিশীল এই দ্বিপদী মনুষ্য এবং পশুকে হত্যা করো না।
ঋগ্বেদে বলা হয়েছে,
"একজন নিরীহ মানুষের যে ক্ষতি করে, সে মানুষ নয়, তার থেকে দূরে থাকো" - ঋগ্বেদ ২/২৩/৭
কিন্তু কি কারণে একজন যোদ্ধার ক্ষেত্রে হত্যাকে বৈধ বলা হয়েছে। এই সংশয় নিবারণে আমাদের জানা আবশ্যক যে, হিংসা কখন বৈধ এবং কখন একজনের প্রাণ নেওয়া পাপ নয়।
যোদ্ধা যিনি গুণ ও কর্ম অনুসারে ক্ষত্রিয়। আমরা সকলে অবগত ক্ষত্রিয়ের কর্ম হচ্ছে দেশ ও প্রজার রক্ষা করা। ক্ষণু' হিংসা অর্থযুক্ত (তনাদি) ধাতুর সঙ্গে 'কতঃ' প্রত্যয় যোগে 'ক্ষতঃ' শব্দের সিদ্ধি হয়, আর 'ক্ষত' উপপদে ত্রৈঙ্ পালন অর্থে (ত্বাদি) ধাতুর সঙ্গে "অন্বেষপি দৃশ্যতে"-(অষ্টাধ্যায়ী: ৩/২/১০১) সূত্রের সাথে 'উ' প্রত্যয় পূর্বপদান্যকারলোপ হয়ে 'ক্ষত্র' শব্দ হয়েছে। "ক্ষত্র এব ক্ষত্রিয়ঃ" স্বার্থে ইয়ঃ যোগে 'ক্ষত্রিয়'। "ক্ষদন্তি রক্ষতি জনান্ ক্ষত্র" অর্থাৎ যিনি জনগণের রক্ষা কার্য করেন, অথবা যে ব্যক্তি আক্রমণ, ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষা করেন তাকে ক্ষত্রিয় বলা হয়।
"শৌর্যং তেজো ধৃতিদাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্। দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্" ॥
- গীতা ১৮/৪৩
অর্থাৎ, শৌর্য, তেজ, ধৈর্য, দক্ষতা, যুদ্ধেও বিমুখ না হওয়া ও দান এবং ঈশ্বরভাব-এগুলো ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম।
"প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ। বিষয়ে প্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ॥"-মনুস্মৃতি: ১/৮৯
অর্থাৎ, বেদাধ্যয়ন ও অগ্নিহোত্র করা, সুপাত্রকে দান ও প্রজার রক্ষা করা, বিষয়ে অনাসক্ত হয়ে জিতেন্দ্রিয় থাকা ক্ষত্রিয়ের কর্ম।
একজন সৈনিক দেশ রক্ষার্থে এবং প্রজার রক্ষায় যদি আততায়ী কিংবা আক্রমণকারীকে প্রতিহত না করে তবে কি করে সে তাহার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম যুদ্ধ করা, তাহলে সে তাহার গুণ ও স্বভাবজাত কর্ম কি রুপে পরিত্যাগ করতে পারে।
এরুপ সংশয় নিবারণে যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ক্ষত্রিয় বীর ও যোদ্ধা ধনুর্ধর অর্জুনকে বলেন,
"সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাল্যসি"॥ গীতা২/৩৮
অর্থাৎ, সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় সমান মনে করে তারপর যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হও। 'ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম যুদ্ধ করা'-এই জ্ঞানে যুদ্ধ করলে পাপ প্রাপ্ত করবে না।
এজন্যই একজন সৈনিক বা যোদ্ধার যুদ্ধ ক্ষেত্রে হত্যাকে বৈধ বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো নিরীহের হত্যাকে কখনো সমর্থন করা হয়নি। যুদ্ধ ক্ষেত্রেও, সনাতনী যোদ্ধাগণ নিরস্ত্র অবস্থায় থাকাকালে কোনো যোদ্ধার প্রতি আক্রমণ থেকে বিরত থাকতেন। অনেক এর এরুপ ধারণা হতে পারে যে, সৈনিক হিসেবে এরুপ প্রাণ নেওয়া অনুচিত তাই শস্ত্র ত্যাগ করে সন্ন্যাস নেওয়া উচিত কিংবা চতুবর্ণের অন্য বর্ণের কর্ম পালন করা উচিত। তবে তাহাদের শ্রীমদ্ভগবদগীতা পুনরায় অধ্যয়ন এর প্রয়োজন রয়েছে। কারণ শ্রীমদ্ভগবদগীতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট বলেছেন,
"শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নান্নোতি কিল্বিষম্।।"
- গীতা ১৮/৪৭
অর্থাৎ, স্বধর্ম গুণহীন হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। স্বভাবনির্দিষ্ট কর্ম করে মানুষ পাপ প্রাপ্ত হয় না।
"সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ।
সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্লিরিবাবৃতাঃ ॥"
- গীতা ১৮/৪৮
অর্থাৎ, হে কৌন্তেয় (অর্জুন)! সহজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও ত্যাগ করতে নেই। কেননা, ধোঁয়া দ্বারা আবৃত অগ্নির ন্যায় সমস্ত কর্মই দোষ দ্বারা আবৃত।
সেজন্য, আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করি। কর্মের ফলের আশা ত্যাগ করে, সমস্ত কর্ম ঈশ্বরে প্রতি নিবেদিত করে কর্ম করি। জীবনের পথচলায় ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে চলি। কিন্তু সর্বদা এটা অবগত থাকি,
"পর্যস্তাং পৃথিবীং সর্বাং সাশ্বাং সরথকুঞ্জরাম্ ।
যোমোচয়েন্মৃত্যুপাশাৎপ্রাপ্নুয়াদ্ধর্মমুত্তমম্ ॥"
- মহাভারত ৫.৯৩.৬
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কাউকে প্রাণে রক্ষা করে, এমনকি পশুপাখির প্রাণও রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র পৃথিবীকে মৃত্যুপাশ থেকে মুক্ত করে উত্তম মর্যাদা লাভ করে।
🔎Run with #veda
মন্তব্যসমূহ