🙏বেদ পরিচয়ঃ🙏
"বেদোহখিলো ধর্মমূলম্। (মনুস্মৃতি, ২/৬)
অর্থাৎ— বেদ এই একমাত্র ধর্মের মূল। বেদ শব্দটি বিদ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার উৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞান। এ জ্ঞান কোন সাধারণ জ্ঞান নয়; এক অতীন্দ্রিয় অপৌরুষের জ্ঞান। ঝর্ণা ধারার মত স্নিগ্ধ এ জ্ঞান জীব কল্যাণে নেমে এসেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।পৃথিবী কীভাবে চলবে তার একটি নির্দেশিকাই বেদ। বেদ নৈমিত্তিক (প্রয়োজনার্থক) জ্ঞান।
সমগ্র আকাশে পশ্যন্তি মধ্যমা বেদ বানী ভরা আছে। মনস্তাত্ত্বিক এই ফ্লাকচুয়েশন বানী কম্পন্নরত অবস্থায় আকাশে নৃত্যের ন্যায় ছন্দায়িত হচ্ছে। আমাদের ঋতম্বরা প্রজ্ঞা লাভকারী সমাধিস্থ ঋষি তা শ্বাস প্রশ্বাসের ন্যায় সহজে গ্রহন করে নিয়েছিলেন।
আজ আমাদের নিকট তাহা চারবেদ হিসাবে খ্যাত।
তাইতো ঋষি মনু বলেছেন, ‘বেদঃ অখিলধর্মমূলম্।বেদ অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধর্মের মূল। প্রায় একই কথা ধর্ম সূত্রকার ঋষি গৌতমও বলেছেন- ‘বেদঃ ধর্মমূলম্।’ বেদের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নি:শ্বাসরূপে অবিহিত করা হয়েছে।
আদি ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ (VEDA) । এই বেদ (পুস্তক) কিন্তু কোনো একক ধর্মগ্রন্থ নয়। অনেকগুলো ধর্মগ্রন্থের সমষ্ঠি ।এর মধ্যে আছে চারটি সংহিতা ( ঋকঃ, যজুঃ, সামঃ ও অথর্ববেদ ), ব্রাহ্মণ, আরন্যক (অরণ্য ব্রহ্ম অর্থে ব্যবহৃত হয়,অরণ্য অর্থাৎ যা নিবিড়,গভীর,ব্রহ্মতত্ত্বও নিবিড় এবং দূরহগাহ্য। সেই অরণ্য অর্থাৎ ব্রহ্ম সম্বব্ধীয় জ্ঞান যে শাস্ত্রে আছে তাই আরণ্যক।)এবং উপনিষদ ।রচনাকালের দিক থেকে সংহিতা চারটিই সবার আগে রচিত।তারপর ব্রাহ্মণ এবং আরন্যক,আর তারপরে উপনিষদ।
“অস্য মহতো ভূতস্য নি:শ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ”।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২.৪.১০)
সেই পরমেশ্বর থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদের উৎপত্তি। স্বয়ং প্রকাশ এই চতুর্বেদই পরমেশ্বরের নি:শ্বাসস্বরূপ। যেমন বায়ুপ্রবাহ বিহীন আমরা এক দণ্ডও বেঁচে থাকতে পারি না। তেমনি ঈশ্বরের নি:শ্বাসরূপ বেদের জ্ঞানপ্রবাহহীন আমরা চলতে পারবো না, আমাদের মানবসভ্যতার জ্ঞানপ্রবাহ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাইতো কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে বেদজ্ঞান প্রবাহের প্রকাশ ঘটান।
“যুগান্তে অন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্ মহর্ষয়ঃ।
লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতা স্বয়ম্ভূবা।”
------------------------ (মহাভারত: শান্তিপর্ব, ২১০.১৯)
যুগান্তে প্রলয়কালে বেদ অপ্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুতে মহর্ষিরা তপস্যার মাধ্যমে স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর থেকে এ জ্ঞান পুনরায় লাভ করেন।
অর্থাৎ কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে মানবজাতিকে বেদ জ্ঞান দান করেন। ঋষিদের বলা হয় ‘সাক্ষাৎকৃতধর্মাণ। যাঁরা অখিল ধর্মের মূল বেদকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছেন, তাই তাঁরা ঋষি।
নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন- স্বয়ম্ভূ অভ্যানর্ষত্তদূষীর্ণামৃষিত্মম্। (নিরুক্ত : ২.১)
তপস্যার গভীরে ঋষিদের কাছে স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মবাণী বেদ স্বয়ং আগমন করে এজন্যই তাঁদের ঋষি বলা হয়। ঋষিদের কাছে বেদবাণী ছবির মত ভেসে ওঠে ধ্যানের গভীরে। এ বেদবাণী দর্শনের জন্যই তাঁদের মন্ত্রদ্রষ্টা বলা হয়; মন্ত্রস্রষ্টা নয়।
পরাশর সংহিতায় (১/২০) বলা হয়েছে-‘ন কশ্চিৎ বেদকর্তাস্তি’।
অর্থাৎঃ কোন মানুষ বেদের রচয়িতা নয়, স্বয়ং ঈশ্বরই এর রচয়িতা।
দ্রষ্টা ঋষিরা অমৃতময় বেদকে শিষ্য পরম্পরায় শ্রুতির মাধ্যমে শিখিয়ে দিতেন। এভাবেই শ্রুতি পরম্পরায় বেদ ধরা ছিল বহুদিন। একারণেই এর অন্য নাম শ্রুতি।
শতপথ ব্রাহ্মণ শ্লোক অনুসারে অগ্নি, বায়ু ও সূর্য (আদিত্য) তপস্যা করে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্বেদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রথম তিন বেদ অর্থাৎ ঋগ্বেদকে অগ্নি, যজুর্বেদকে বায়ু ও সামবেদকে সূর্য (আদিত্য) প্রকাশ করেন। শেষে ঝষি অঙ্গিরা অথর্ববেদ প্রকাশ করেন।
ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ব্ববেদ। চারি বেদে যথাক্রমে চারি বিষয়ের বর্ণনা রহিয়াছে, যথা- বিজ্ঞান, কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান। সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বর অগ্নি ঋষি, বায়ু ঋষি, আদিত্য ঋষি ও অঙ্গিরা ঋষির আত্মায় যথাক্রমে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ প্রকাশ করিয়েছেন।
ঋচ্ ধাতুর অর্থ স্তুতি করা অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা; যে বেদে সর্ব পদার্থের স্তুতি অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা হইয়াছে তাহাই ‘ঋগ্বেদ’।
যজ্ ধাতুর অর্থ দেব পুজা, সঙ্গতি করণ ও দান। যে বেদে মোক্ষ সাধনা ও ইহলৌকিক ব্যবহার অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের বিধান প্রকাশিত হইয়াছে তাহাই ‘যজুর্বেদ’।
যাহাতে জ্ঞান ও আনন্দের উন্নতি হয় তাহাই ‘সামবেদ’। থর্ব অর্থ সচল এবং অথর্ব অর্থ অচল ব্রহ্ম; যাহাতে অচল ব্রহ্মের জ্ঞান ও সংশয়ের দোদুল্যমান অবস্থার সমাপ্তি হয় তাহাই ‘অথর্ব’ বেদ। ছন্দ, অথর্বাঙ্গিরস ও ব্রহ্মবেদ এগুলি অথর্ব বেদেরই নাম।
মহামতী বেদব্যাস বেদকে সংহত ও বিভক্ত করেন। সম্পূর্ন বেদকে একত্রিত করে সংহত করে প্রকাশ করা হয়েছে বলে বেদ কে সংহিতা বলা হয়। এই সংহিতা হল চার বেদ।চারি বেদের সংহিতা অংশ প্রধানত মন্ত্রাত্মক।("তেষামৃগ্ যত্রার্থবশেন পাদব্যবস্থা"মীমাংসাসূত্র ২/১/৩৫)
বেদের মন্ত্র ভাগ ঋক,সাম,যজুঃ ভেদে ত্রিবিধ। ঋক্ বেদ কাব্যময়,ছন্দো বা ছন্দোবদ্ধ বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশিত। সামবেদ প্রধানতঃ ঋক বেদের মন্ত্র এবং অন্যকিছু মন্ত্র নিয়ে সঙ্গীতময়। আর ঋক ও সাম ভিন্ন বেদ হল যজুর্বেদ যা গদ্যাত্বক। মন্ত্রাত্মক এই দেদেরই যজ্ঞে প্রয়োগ ব্যবস্থিত। ই ত্রিবিধ বেদকে অবলম্বন করেই যজ্ঞ প্রতিষ্ঠত।এই জন্য বেদের আর এক নাম ত্রয়ী। অনেকের মত, অথর্ববেদের যজ্ঞে বব্যহারনা থাকায়তা বেদ পদবাচ্য নয়- এরূপমত প্রচলিত থাকলেও তা গ্রহনযোগ্য নয়।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে লেখা আছে "অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিমেতৎ ঋক্-বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অথর্বাঙ্গিরসঃ"(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৪/১০)- অর্থাৎ এই সাকল বেদ সেই পরমেশ্বরের নিঃশ্বাসস্বরূপ।
মীমাংসা সূত্র বলা হয়েছে "শেষে ব্রাহ্মণ শব্দঃ"(মীমাংসাসূত্র ২/১/৩৩)- তাৎপর্য এই য, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ যে গুলিকে মন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন সেঘুলিই মন্ত্র। আর যার সাহায্যে মন্ত্রের বিনিয়োগ ইত্যাদি জানা যায়,সেই অংশই ব্রহ্মণ।
শতশত ঋষিদের নিকট থেকে লক্ষাধিক মন্ত্র নিয়ে একসাথে সম্পাদনার মাধ্যমে প্রকাশ করেন শ্রীকৃষ্ণ নামক এক ঋষি। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন, তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় ‘বেদব্যাস’। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস।
বেদে 28000 পাণ্ডুলিপি রয়েছে আর এই পাণ্ডুলিপি মহারাষ্ট্রের পোনের অরিয়েন্টে রিচার্চ ইন্সটিটিউটে নিরাপদ কেন্দ্রের ভাণ্ডারে রাখা হয়েছে।ঋগ্বেবেদের 30 পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই ইউনেস্কো 1500 থেকে 1800 খৃষ্ঠাব্দের মধ্যে ঝগবেদের এই 30 পাণ্ডুলিপির তথ্য সংগ্রহ করে সাংস্কৃতিক তথ্য কেন্দ্রে রাখে।
পন্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী👇
বেদ আর্য্য জাতির ধর্ম্মগ্রন্থ এবং সমগ্র মানবের আদি জ্ঞান ভাণ্ডার। জগতের যাবতীয় ধর্ম বেদ হইতেই জন্মলাভ করিয়াছে, বিশ্বের যাবতীয় ভাষা বৈদিক ভাষা হইতেই নিঃসৃত। পৃথিবীর যে কোনও মানব তাহার শিক্ষা সভ্যতা ও ভাষার ইতিহাস পাঠ করিতে ইচ্ছা করিলে তাহাকে বেদের শরণাপন্ন হইতে হয়।
বেদের মধ্যে যে অক্ষর জ্ঞান সম্পদ স্তূপীকৃত রহিয়াছে তাহা আহরণের জন্য যুগে যুগে সব দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা আমরণ পরিশ্রম করিয়াছেন। সে পরিশ্রম এখনও শেষ হয় নাই। পৃথিবীর নানা জাতি নানা ভাষায় ও নানা ভাবে আজও বেদের গবেষণা করিতেছে। বেদের উপর পণ্ডিতগণ শ্রদ্ধা থাকিলেও সকলে বেদকে একভাবে দেখেন না। যাঁহারা বেদ-বিষয়ে গবেষণা করিয়াছেন তাঁহাদিগকে আমরা চারিভাগে ভাগ করিতে পারি। একদল বেদকে “পৌরুষেয়”, দ্বিতীয় দল “আর্ষ”, তৃতীয় দল “ঈশ্বরীয়” এবং চতুর্থ দল “অপৌরুষেয়” বলেন।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বেদকে পৌরুষেয়’ বলেন। তাঁহাদের মতে বেদ মানবের রচনা মনে করিয়াই তাঁহারা বেদকে পুরুষ বিশেষের রচিত বা “পৌরুষেয়” বলেন। বেদ তাঁহাদের মতে মানব মস্তিষ্কের চরম উৎকর্ষ। ঋষিদিগকেই তাঁহারা বেদ মন্ত্রের রচয়িতা ও উপদেষ্টা মনে করেন। বেদ মানব জাতির গ্রন্থ ভাণ্ডারে প্রাচীনতম গ্রন্থ ইহা তাঁহারা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। বেদকে কেন্দ্র করিয়াই ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। তাঁহারা এই সব সাহিত্য রাজির মধ্য হইতে প্রাচীন আর্য জাতির ইতিহাস উদ্ধার করিতে সচেষ্ট রহিয়াছেন। প্রাচীন পৃথিবীর ভৌগোলিক বৃত্তান্তও তাঁহারা বেদ হইতেই উদ্ধার করিতে প্রায়াস পাইয়াছে। পৌরুষেয়বাদী এই সব দেশী ও বিদেশীপণ্ডিত বেদকে উপাদেয় গ্রন্থ ও গবেষণার ক্ষেত্র মনে করয়িা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখিতেছেন।
দ্বিতীয় পক্ষ বেদকে “আর্ষ” বলেন। প্রাচীনকাল হইতেই ইহারা ঘোষণা করিয়া আসিতেছেন যে, বেদ ঋষি প্রণীত। স্বচ্ছ-হৃদয়, সত্যাচারী শুদ্ধাত্মা ঋষিরা পুণ্যবলে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ বিষয়ের যে সাক্ষাৎ জ্ঞান দর্শন করিয়াছিলেন, ইহাই বেদ মন্ত্রের সমষ্টি। ইঁহাদের মতে বেদের বিষয়ীভূত জ্ঞান সর্বদাই একরস থাকে। কল্প কল্পান্তরেও এই জ্ঞানের পরিবর্তন হয় না। এই জ্ঞান মানব জাতির উন্নতির চির সহায়। এক কথায় আর্ষবাদীরা বেদ মন্ত্রের ভাষাকে ঋষিদের নিজস্ব মনে করেন, কিন্তু বেদমন্ত্রের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নিজস্ব মনে করেন। তাঁহাদের মতে বেদান্তর্গত ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রাপ্তির নিয়ম অপৌরুষেয় বা ঈশ্বরীয়। পরমেশ্বর বেদকে উৎপন্ন করিয়াছেন এবং ইহা ঋষিদের ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। পৌরুষেয় ও আর্ষ পক্ষ উভয়েরই মতেই বেদমন্ত্র একসঙ্গে রচিত হয় নাই। বেদ মন্ত্র রচনা করিতে ঋষিদের কয়েক পুরুষ অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ রচিত হইয়াছে। আর্ষবাদী মতে উপনিষদ রচিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই ঋষিদের যুগ শেষ হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদের মধ্যে কল্পিত উপাখ্যানও আছে। বেদের ভাষা ঋষিদের নিজের বলিয়াই তাঁহারা ইহাকে ‘আর্ষ’ বলিয়া থাকেন।
Untitled
তৃতীয় পক্ষ বেদকে “ঈশ্বরীয়” বলেন। তাঁহাদের মতে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রথমে স্বচ্ছ হৃদয় মানবের হৃদয়ে ঈশ্বর বেদবাণীর প্রেরণা দান করেন। যে সব মানবের আত্মা পূর্ব সৃষ্টিতে শুভকর্ম দ্বারা শুদ্ধ থাকে তাঁহাদের হৃদয়ই বেদবাণীর প্রেরণা লাভ করে। ঈশ্বরীয় পক্ষ বলেন –চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও স্বর্গলোকাদি যেমন পূর্ব কল্পের অনুযায়ী, যেমন এ কল্পে রচিত হইয়াছে তেমন পূর্ব পূর্ব কল্পে বেদ যেভাবে প্রকট হইয়াছিল এ কল্পেও সেই ভাবেই প্রকট হইয়াছে। ইহাদের মতে বেদের মন্ত্র, ভাষ্য ও অর্থ প্রত্যেক কল্পে একরূপ ভাবেই চলিয়া আসিতেছে। আর্ষপক্ষ জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন আর ঈশ্বরীয় পক্ষ ভাষা, শব্দ, মন্ত্র ও জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন। ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলেন, - কল্পের প্রথমে ব্রহ্মার হৃদয়ে বেদ অর্পিত হইয়াছিল এবং ব্রহ্মার নিকট হইতে শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। কাহারও মতে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, অঙ্গিরা এই চারিজন ঋষির হৃদয়ে চারি বেদ অর্পিত হইয়াছিল। এই চারিজন ঋষি হইতেই শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবজাতির মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদ ‘ঈশ্বরীয়’ ও নিত্য। কল্পের প্রারম্ভে ঋষিরা ইহার প্রকাশ করিয়াছিলেন। বেদ ঋষিদের নিজস্ব বস্তু নয়, তাঁহারা বেদের রচয়িতা নহেন তাঁহারা বেদের দ্রষ্টা। উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন এই ঈশ্বরীয় পক্ষ সমর্থন করিয়াছেন। উত্তর মীমাংসার মতে বেদ দিব্যবাক্।
চতুর্থ পক্ষ বেদকে “অপৌরুষেয়” বলেন। ইঁহারা বেদের উৎপত্তি স্বীকার করেন না; অভিব্যাক্তি স্বীকার করেন। মীমাংসা দর্শনকার জৈমিনীর মতে শব্দ নিত্য। নিত্য পদার্থ অপরিণামী ও প্রবাহ ভেদে দ্বিবিধ। যাহার স্বরূপ বা গুণের কোনই পরিবর্তন হয় না তাহা ‘অপরিণামী-নিত্য’ এবং যাহা নানা রূপান্তরের মধ্যেও নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেতাহা ‘প্রবাহ-নিত্য’। পরমাত্মা অপরিণামী-নিত্য। তিনি সর্বদাই এক রস থাকেন কিন্তু প্রকৃতি প্রবাহ-নিত্য। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের চক্র প্রকৃতি নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয় কিন্তু কারণ রূপে ইহা নিত্য। বেদ শব্দময়। মহর্ষি জৈমিনি শব্দকে নিত্য বলিয়াছেন। অ-আ-ক-খ প্রভৃতি বর্ণের উৎপত্তি হয় না। ইহার অভিব্যক্তি হয়। স্বর্ণ হইতে অলঙ্কারের উৎপত্তি হয় কারণ অলংকার পূর্বে ছিল না। অন্ধকার গৃহে প্রদীপের সাহায্যে অলঙ্কার দৃষ্ট হয় এখানে অলঙ্কারের অস্তিত্ব পূর্বেই ছিল, তবে তাহার মাত্র অভিব্যক্তি হইল। কোনও বস্তুর অভিব্যক্তির পূর্বে তাহার উৎপত্তি হয়, উৎপত্তির পূর্বে অভিব্যক্তি হয় না। ক, খ, গ, ঘ প্রভৃতিকে অক্ষর বলে, কেননা ইহাদের ক্ষরণ বা ধংস হয় না। অক্ষর জগতের প্রত্যেক স্থানেই বর্ত্তমান রহিয়াছে। কন্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতি স্থান অক্ষরকে উৎপাদন করে না, ব্যক্ত করে মাত্র। অক্ষর সমস্টি মিলিত হইয়া পদ ও শব্দসমষ্টি। ইহারা কোন অর্থ প্রকাশ করিতে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে অক্ষর বা বর্ণ কোন পুরুষ বিশেষের রচিত নয় বলিয়া অপৌরুষেয়। বর্ণ অপৌরুষেয় হইলেও বিভিন্ন অর্থের সংকেত অনুসারে ইহার মিলিত হইয়া পদ গঠন করে এবং বিভিন্ন পদও অর্থের সংকেতানুসারে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে। মনুষ্যকৃত গ্রন্থে এই সব বর্ণ ও বাক্যের সাহায্যে অর্থের সংকেত প্রকাশ করা হইয়াছে। বেদ ও মনুষ্যকত গ্রন্থে পার্থক্য এই স্থানে যে মনুষ্যকৃত গ্রন্থের বর্ণ বা অক্ষর অপৌরুষেয় হইলেও পদ বা বাক্য সমষ্টি পৌরুষেয়। কিন্তু বেদের পদ, শব্দার্থ, বাক্য বাক্যার্থ সবই অপৌরুষেয়। বেদমন্ত্রকে কোন পুরুষ বিশেষ রচনা করে নাই। ইহা নির্দিষ্ট আকারে অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। ঋষিরা নিজের তপোবলে এই নিত্য বেদকে দর্শন করেন ও তাহাকে অভিব্যক্ত করেন। বেদমন্ত্রের অর্থকেও তাঁহারা দর্শন করেন। বেদ শব্দার্থ সন্বন্ধযুক্ত হইয়াই অনাদিরূপে অবস্থান করে। ঋষিরা যুগে যুগে ইহা প্রকাশ করেন। জৈমিনি শব্দের নিত্যতা প্রমাণ করিয়াই বেদের নিত্যত্ব সিদ্ধ করিয়াছেন এবং শব্দের অনিত্যত্ব খণ্ডন করিয়াছেন।
ঋগ্বেদে এক একটি মন্ত্রের নাম 'ঋক'। কয়েকটি ঋক্ দ্বারা কোন দেবতার যে একটি স্তুতি রচিত হয়, তার নাম 'সূক্ত'। অনেক গুলি সূক্ত দ্বারা একটি 'মন্ডল' গঠিত হয়। এইরূপ ১০মন্ডলে ৮৫ অনুবাক ও ১০১৮ সূক্তে সম্পূর্ণ হইয়াছে।
ঋগ্বেদের বেদের দেবতা ও ঋষি
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন –‘শব্দ স্বয়ং উৎপন্ন হয় না, কণ্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতির প্রযত্ন দ্বারা ইহা উৎপন্ন হয়; শব্দ এক প্রকারের উচ্চারণ ক্রিয়া। উচ্চারণের সহিত স্বল্প সময়ের জন্য শব্দ প্রত্যক্ষ হয়। ইহা প্রথমে অনুৎপন্ন ছিল, উচ্চারণের সময় স্বল্প সময়ের জন্য ইহার স্থিতি হয় এবং উচ্চারণের পরেই ইহার ধ্বংস হয়। অতএব যাহা উৎপন্ন তাহা নিত্য নহে। শব্দের নিত্যতাবাদীরা ইহার উত্তরে বলেন, উচ্চারণের পূর্বে শব্দের অস্তিত্ব আছে; ইহা নিরাকার, নিত্য ও অব্যক্তরূপে আছে। উচ্চারণ করিলে ইহা উৎপন্ন হয় না, শুধু ব্যক্ত হয় মাত্র। উচ্চারণের পর ইহার ধ্বংস হয় না শুধু শ্রবণেন্দ্রিয়র অগোচর হয় মাত্র। উচ্চারিত হইলে ইহা শ্রবণেন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হয় এবং শব্দকারীর সহিত ইহার কোন সন্বন্ধ থাকে না। আজ একটা শব্দ শ্রুতি গোচর হইয়া জ্ঞান প্রকাশ করিল, বহুদিন পরও শব্দটী জ্ঞান প্রকাশ করিবে। ইহাতেই শব্দের নিত্যতা সিদ্ধ হয়।
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন-‘রাম শব্দ করিল, যদু শব্দ করিবে’ ইত্যাদি বাক্যে শব্দের কর্তা রাম ও যদুকেই বুঝায়। যখন শব্দ কোন ব্যক্তি কর্তৃক উৎপন্ন কার্য, তখন তাহার নিত্যতা হইতে পারে না’। শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘রাম ও যদু শব্দের নির্মাতা নহে, শব্দের উচ্চারণ কর্তা মাত্র। কেহই শব্দকে উৎপন্ন করিতে বলে না, উচ্চারণ করিতেই বলে। উৎপন্ন পদার্থের উপাদান কারণের প্রয়োজন হয় কিন্তু শব্দ উৎপাদনের জন্য উপাদান কারণ পাওয়া দুষ্কর। বায়ু শব্দের উপাদান কারণ নয়। বায়ু সাহায্য করে মাত্র। বায়ু শব্দকে বহন করে। ধ্বনি ও শব্দের পার্থক্য সকলেই মানিয়া থাকেন।
শব্দের অনিত্যবাদীরা বলেন –‘এক সঙ্গে বহু লোকে মিলিয়া শব্দ করিলে তাহার বৃদ্ধি হয় এবং অল্প লোক, বালক বা রোগী উচ্চারণ করিলে তাহা হ্রাস হয়, শব্দ নিত্য হইলে তাহাতে হ্রাস বৃদ্ধি হইতে পারে না’। নিত্যতাবাদীরা বলেন- ‘বহুজনে মিলিয়া শব্দ করিলে শুধু ধ্বনি বৃদ্ধি পায়, শব্দ বৃদ্ধি পায় না। ধ্বনির হ্রাস বৃদ্ধিতে শব্দের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে না’।
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘নিত্য বস্তুর হ্রাস বৃদ্ধি হয় না কিন্তু ব্যাকরণ গ্রন্থে দেখি শব্দের বিকৃতি, রূপান্তর ও হ্রাস বৃদ্ধি হয়।’ শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন-‘ব্যাকরণ গ্রন্থে যে, ‘ই’ স্থানে ‘য’ হয় বা ‘উ’ স্থানে ‘ব’ হয় ইহা আকৃতির বিকৃতি ভাব নহে এখানে দুটী বর্ণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক।’
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন –‘বহু সময় বহু স্থানে বহু লোক একই শব্দের উচ্চারণ করে। শব্দ নিত্য হইলে এইরূপ ঘটিত না।’। শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘নিত্য বস্তুর ইহাও একটি লক্ষণ। একই পরমাত্মাকে বহু স্থানে বহু ব্যক্তি অনুভব করিতে পারে। ইহাতে নিত্যত্ব খণ্ডিত হয় না, সিদ্ধ হয়।’
চারিবেদ
পরমাত্মা যেমন নিত্য তাঁহার জ্ঞান এই বেদও নিত্য। ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যা জানিবার জন্য একই বেদ চারিভাগে বিভক্ত হইয়াছে-ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ব্ববেদ। চারি বেদে যথাক্রমে চারি, বিষয়ের বর্ণনা রহিয়াছে, যথা- বিজ্ঞান, কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান। ঋচ্ ধাতুর অর্থ স্তুতি করা অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা; যে বেদের সর্ব পদার্থের স্তুতি অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা হইয়াছে তাহাই ‘ঋগ্বেদ’। যজ্ ধাতুর অর্থ দেব পুজা, সঙ্গতি করণ ও দান। যে বেদে মোক্ষ সাধনা ও ইহলৌকি ব্যবহার অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের বিধান প্রকাশিত হইয়াছে তাহাই ‘যজুর্বেদ’। যাহাতে জ্ঞান ও আনন্দের উন্নতি হয় তাহাই ‘সামবেদ’। থর্ব অর্থে সচল এবং অথর্ব অর্থে অচল ব্রহ্ম; যাহাতে অচল ব্রহ্মের জ্ঞান ও সংশয়ের দোদুল্যমান অবস্থার সমাপ্তি হয় তাহাই ‘অথর্ব’ বেদ। ছন্দ, অথর্বাঙ্গিরস ও ব্রহ্মবেদ এগুলি অথর্ব বেদেরই নাম।
বেদের আয়তন ও মন্ত্রসংখ্যা
ঋগ্বেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা ১০৫৮৯। সমস্ত ঋগ্বেদ ১০ মণ্ডলে, ৮৫ অনুবাকে ও ১০১৮ সূক্তে বিভক্ত। ঋগ্বেদকে অন্য ভাবেও বিভাগ করা হইয়াছে। যেমন-অষ্টক ৮, অধ্যায় ৬৪ ও বর্গ ১০২৪। যজুর্বেদের মোট মন্ত্র সংখ্যা ১৯৭৫ এবং সাম বেদের মন্ত্রসংখ্যা ১৮৯৩। সামবেদ ৩ ভাগে বিভক্ত, যথা পূর্বার্চিক, মহানাম্নীআর্চিক ও উত্তরার্চিক। মহানাম্নী আর্চিককে পূর্বার্চিকের মধ্যেই ধরা হয়। পূর্বার্চিক ৪ কাণ্ডে বিভক্ত, ৪ কাণ্ড ৬ প্রপাঠক বা ৫ অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রপাঠক অর্দ্ধ প্রপাঠক ও দশতিতে বিভক্ত। উত্তরার্চিক ২১ অধ্যায় ও ৯ প্রপাঠক। এই প্রপাঠকগুলিতে অর্দ্ধ প্রপাঠক আছে, দশতি নাই কিন্তু সূক্ত আছে। অথর্ব্ব বেদের মন্ত্রসংখ্যা ৫৯৭৭। অথর্ববেদে ২০ কাণ্ড। এই কাণ্ডগুলি ৩৪ প্রপাঠকে বিভক্ত। ইহাতে ১১১ অনুবাক্, ৭৭ বর্গ ও ৭৩১ সূক্ত। সমগ্র বেদে মোট মন্ত্রসংখ্যা ২০৪৩৪।
-পন্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী