• সামনা সামনি যাজ্ঞবল্ক ও গার্গী,,,,সেদিন জনক রাজার মহাযজ্ঞে ------সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী কে ❓

সামনা সামনি যাজ্ঞবল্ক ও গার্গী,,,,সেদিন জনক রাজার মহাযজ্ঞে ------সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী কে?

বিদেহ রাজা জনকের রাজসভা। সভাসদ ও আগত অজস্র ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি, ব্রাহ্মণদের উপস্থিতিতে সভা পরিপূর্ণ। মহাযজ্ঞ সমাপ্ত। এবার রাজা সভায় উপস্থিত শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদকে সোনা দিয়ে বাঁধানো শিঙওলা এক হাজার গাভী দান করবেন।

"বলুন, জ্ঞানীজনেরা, আপনাদের মধ্যে ব্রহ্মিষ্ঠ কে? তাকে আমি গাভীগুলি দান করে পুণ্য অর্জন করতে চাই।" ঋষি, ব্রাহ্মণেরা নিশ্চুপ। ঐ মহতী সভায় কে দাবি করবেন, "আমিই শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ"? আবার অপর কাউকে স্বীকৃতি দিতেও মন চায় না। সকল

পন্ডিতই নিজের পান্ডিত্যে গর্বিত।

অবশেষে উঠলেন যাজ্ঞবল্ক," মহারাজ, গাভীগুলি আমাকে দিন।" শোনা মাত্র রে রে করে উঠলেন বাকিরা, "আপনি নিজেকে সবার সেরা বলে দাবি করেন ?" যাজ্ঞবল্ক বললেন," না না। ব্রহ্মিষ্ঠকে আমি প্রনাম করি। আসলে গাভীগুলি

আমার দরকার।" "বললেই হল দরকার? দরকার আমাদের সকলের। আপনি যদি গাভী নিতে চান তো আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করুন।"

দেখতে পাচ্ছেন সামান্য সোনার শিঙওলা হাজার গাভীর জন্য ব্রহ্মবিদদের কামড়াকামড়ি? এরা চিরস্থায়ী বংশতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে না, তাও হয়? এ কাহিনি বৃহদারণ্যক উপনিষদের সময়কালের। ঐ উপনিষদেই কাহিনিটা আছে। এই সময়কালের কিছু কাল পর থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রবল হতে শুরু করে।

যাই হোক, সকলে একে একে প্রশ্ন করছেন। হেলায় স্টেপ আউটে সব ডেলিভারি মাঠের বাইরে উড়িয়ে দিচ্ছেন যাজ্ঞবল্ক। মুখ চুন হচ্ছে পন্ডিতদের।

হঠাৎ এক প্রান্ত থেকে ভেসে এল সুললিত কন্ঠস্বর," ঋষিবর, আমি কিছু প্রশ্ন করতে পারি?"

যাজ্ঞবল্ক তাকালেন। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সুন্দরী তরুণি ব্রহ্মবাদিনী গার্গী বাচকম্বী।"ঋষিবর, সব কিছু যদি জলের ওপর অধিষ্ঠিত হয়, জল কিসের ওপর অধিষ্ঠিত ?"

"অন্তরীক্ষে।"

"অন্তরীক্ষ কিসে অধিষ্ঠিত ?"

"গন্ধর্বলোকে।" "গন্ধর্বলোক?"

"চন্দ্রলোকে।"

"চন্দ্রলোক ?"

"আদিত্যলোকে।" "আদিত্যলোক ?"

"দেবলোকে।"

"দেবলোক?"

"ব্রহ্মলোকে।"

"আর, ব্রহ্মলোক কিসে অধিষ্ঠিত ?"

চমকে উঠলেন যাজ্ঞবল্ক। এ কী প্রশ্ন করেছে মেয়ে? এতকাল নিজের অধীত সব বিদ্যা, বোধ দিয়ে তিনি সর্বোচ্চ ব্ৰহ্মকে জেনেছেন। সেই ব্রহ্মলোক কিসে অধিষ্ঠিত, এ প্রশ্ন তো তার নিজের মাথাতেই আসেনি। সব কিছু ব্রহ্মেই শুরু, ব্রহ্মেই লীন। সেই ব্রহ্মলোক কিসে অধিষ্ঠিত, এ প্রশ্ন হয় নাকি ? এর উত্তর জানা সম্ভব নাকি ? ভরা সভাগৃহে যাজ্ঞবল্ক ধরাশায়ী। গার্গীর কাছে চূড়ান্ত পর্যুদস্ত। মানতে পারছেন না। যে যাজ্ঞবল্ক নিজের আশ্রমে বসে ব্রহ্মবাদিনী স্ত্রী মৈত্রেয়ীর সঙ্গে খোলামেলা ব্রহ্ম আলোচনা করেন, জ্ঞান মার্গে বিকশিত হতে স্ত্রীকে উৎসাহ দেন, সেই যাজ্ঞবল্কের মুখ থেকে বেরিয়ে এল রুষ্ট সতর্কবার্তা।

"এ তুমি কী প্রশ্ন করেছ, গার্গী ? ঐ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা চলে না। জানো না তুমি ? আর প্রশ্ন কোরো না। তোমার মাথা খসে পড়বে।" গার্গী বুঝল ভরা মহতী সভায় যাজ্ঞবল্ক নিজের পরাজয়ের লজ্জা গোপন করতে রুষ্ট সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন। অর্থাৎ যে কাজ করতে সে উঠেছিল, তা পূর্ণ সফল। সে নীরবে আসন গ্রহন করল।

প্রসঙ্গতঃ খ্রিস্ট জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে দাঁড়িয়ে ভারতীয় তরুণির তোলা প্রশ্নের উত্তর সর্বাধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের হাতেও নেই। বিগ ব্যাং থিওরি মেনে সিঙ্গুলারিটি উইথ ইনফাইনাইট ডেনসিটিতে মহা বিস্ফোরনে তৈরী হল স্থান। সেই স্থানে ব্রহ্মান্ডের সব কিছু অবস্থিত। কিন্তু ঐ সিঙ্গুলারিটি কিসে অবস্থিত ? মহাশূন্য বলা যাবে না। বিজ্ঞানগত ভাবে যে শূন্যকে মানুষ বোঝে তা একটা স্থান, যা পুর্ণ হয়। বিস্ফোরনের আগে স্থান তৈরি হয়নি। তাহলে তা কিসে অবস্থিত ? গণিত বিগ ব্যাঙের উৎস অবধি পৌঁছেছে। (টেলিস্কোপে এখনো পৌঁছনো যায়নি।) তার ওপারটা এখনো অজানা।যাই হোক, রাজা আর একবার সকলকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন। মানে, একশ পাওয়ার যোগ্য স্টুডেন্ট। কিন্তু একটা কোয়েশ্চেন যা তা ভাবে আউট অফ সিলেবাস পড়ে গেছে। আর একটা সুযোগ দেয়া হোক। সুযোগ দিলে কী হবে? কেউ আর প্রশ্ন করে না। কী প্রশ্ন করবে ? আগের রাউন্ডে তাদের সব সেরা প্রশ্নের উত্তর যাজ্ঞবল্ক দিয়ে দিয়েছেন।

কিছুক্ষণ আগেই যাজ্ঞবল্কের ছুঁড়ে দেয়া রুষ্ট সতর্ক বার্তা পরোয়া না করে আবার উঠল গার্গী," আপনাদের কাউকে কোনো প্রশ্ন করতে হবে না। আমি ওনাকে মাত্র দুটো প্রশ্ন করব। যদি উনি সঠিক উত্তর দিতে পারেন তা হলেই প্রমানিত হয়ে যাবে যে এখানে উনিই শ্রেষ্ঠ ব্ৰহ্মবিদ।"

পন্ডিতদের ভুরুতে কুঞ্চন। এ কী বলে মেয়ে ? অত অত পন্ডিতের হাতে আর প্রশ্ন নেই। সেখানে এই মেয়ে আরো দুটো প্রশ্ন করবে এবং এমন প্রশ্ন যার উত্তরে নির্ধারিত হয়ে যাবে কে সেরা ব্রহ্মবিদ? এত বড়ো আত্মবিশ্বাস!

"ঋষিবর, অতীত বর্তমান ভবিষ্যত এবং স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কিসে অধিষ্ঠিত ?" "অনন্তে।" "আর, অনন্ত কিসে অধিষ্ঠিত ?"

পন্ডিতরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। এ আবার কী প্রশ্ন? অনন্ত তো শেষ

কথা। তার আবার অধিষ্ঠান ? ইনফিনিটির তো না আছে শুরু, না আছে

শেষ। তাকে ধারণ করবে কে?

"ব্রহ্ম। ব্ৰহ্মই শেষ কথা। অনন্ত তিনিই ধারণ করেন। তিনি ভিন্ন আর কিছু নেই। মানুষ তাকে উপলব্ধি করে না। কিন্তু এ ব্রহ্মান্ডে তিনিই বক্তা, তিনিই শ্রোতা, তিনিই দ্রষ্টা, তিনিই বোদ্ধা।"

যাজ্ঞবল্কের ঐ কথাকে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা আছে প্রায় সমকালীন ছান্দোগ্য উপনিষদে। প্রজ্ঞাই ব্রহ্ম, প্রজ্ঞাই অনন্ত।

বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলতে হলে, এ জগতে যা কিছু গণিত, পদার্থ বিদ্যা, রসায়ণ বিদ্যা, জীববিদ্যা, প্রযুক্তি, যা কিছু সূত্র, যা কিছু লজিক, সব ব্রহ্মান্ডের মগজে আগে থেকেই উপস্থিত। মানুষ তার ধী শক্তি কাজে লাগিয়ে সে সব আবিষ্কার ও আহরণ করে চলেছে। বিজ্ঞানের বক্তব্য আরো অনন্ত জ্ঞান আছে এই ব্রহ্মান্ডে। সে সব আবিষ্কার করতে পারলে নতুন গণিত, নতুন ফিজিক্সের তত্ত্ব ও সূত্র তৈরি হবে। বর্তমান এস্ট্রো-ফিজিক্সে ব্রহ্মান্ড দশ মাত্রার। আমরা চার মাত্রায় আবদ্ধ। একটা করে মাত্রা পেরলে ভোজবাজি দেখব। সে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এছাড়া যে শব্দ তরঙ্গ মুখ থেকে নির্গত হয়, কানে আসে, তা এই ব্রহ্মান্ডেই আছে। এই ব্রহ্মান্ড আমাদের অপলক দেখে চলেছে, শুনে চলেছে। যা কিছু অতীত শব্দ, দৃশ্য, ইতিহাস, সব রেকর্ডেড আছে ব্রহ্মান্ডে। তার নজর এড়িয়ে কিছু হয় না। মানে ঐ "বোম্মা জানে গোপন কম্মটি।"

সুতরাং ব্রহ্মান্ড মানেই প্রজ্ঞা। সেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, শ্রেষ্ঠ বোদ্ধা, বক্তা, শ্রোতা,

সেই ব্রহ্ম, সেই অনন্ত। সিঙ্গুলারিটি উইথ ইনফাইনাইট ডেনসিটি কথাটাই বুঝিয়ে দেয় যে ইনফিনিটি ঐ সিঙ্গুলারিটিতেই ধারণ হয়ে আছে। যাজ্ঞবল্কের উত্তর শুনে গার্গী অভিবাদন জানিয়ে বলল, " আপনি তর্কাতীত ভাবে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ। গাভীগুলি নিয়ে যান।"

ঐ প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পন্ডিতপূর্ণ ভরা রাজসভায় রাজার উপস্থিতিতে এক বিদুষী তরুণির কাছে পর্যুদস্ত হয়েছিলেন পণ্ডিত শ্রেষ্ঠ যাজ্ঞবল্ক। পরের পর্যায়ে ঐ তরুণিই বিচার করেছিল তার ব্রহ্মজ্ঞানের সীমা। তার সূক্ষ্মতম দর্শন তত্ত্ব বুঝেওছিল একমাত্র সেই তরুণি। সে কথা বৃহদারণ্যকে স্পষ্ট লেখা আছে। এই জায়গাটাতে সততা ছিল তৎকালীন রচয়িতাদের। বিদুষী নারীর হাতে জ্ঞানী পুরুষের পরাজয় বা নারীর জ্ঞানের মানদন্ডে পুরুষের জ্ঞানের পরিধি বিচারকে তারা গোপন করেনি।

সেই গার্গীর দেশে গার্গীর জন্মের তিন হাজার বছর পর দাঁড়িয়ে ঘরে ঘরে তো জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে অগণিত গার্গী থাকার কথা, কিন্তু নেই কেন?

(সংগ্রহ,,,পি বিশ্বাস)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

🔸সনাতন ধর্ম ও নারী 💐

সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️

▪️একাদশী" কি শাস্ত্র সম্মত ❓