"হিন্দু শব্দের উৎপত্তি"


______________"হিন্দু শব্দের উৎপত্তি"______________

    
"হিন্দু" শব্দ নিয়ে আজকের এই লেখা সকল সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই বোনদের জন্য। প্রাচীনকাল হতে আমাদের পরিচয়ে যে "আর্য" শব্দের প্রচলন ছিল, কিন্তু হটাৎ কবে থেকে তা "হিন্দু" হয়ে গেলো বা কোথা থেকে এই "হিন্দু" কথাটির উৎপত্তি হলো? আজ সে বিষয় নিয়েই আলোচনা করবো শাস্ত্র প্রমানসহ। 

সবার প্রথমে "আর্য" কথাটি পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। "আর্য" শব্দটি কোনো জাতিগত নাম নয়। "আর্য" হলো মানবের গুণগত অর্থাৎ গৌনিক নাম। আমাদের জাতি হলো একটাই তা "মনুষ্য" জাতি। "আর্য" শব্দের অর্থ হলো শ্রেষ্ঠ/জ্ঞানী ব্যক্তি, এর একটা সাধারণ প্রমাণ দিচ্ছি গীতা থেকে,

⭕️ দেখুন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কি বলছেন -

"কুতস্ত্বা কশ্মলমিদম্‌ বিষমে সমুপস্থিতম্‌ 
  অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুনঃ"
                                       গীতা - ২ অঃ / শ্লোক ২

ভাবার্থ : হে অর্জুন! এই অসময়ে তোমার মধ্যে এরুপ মোহ কোথা হইতে এলো? শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা এমন আচরণ করে না এবং এই মোহ স্বর্গ বা কীর্তি কোনোটিই প্রদান করে না। 

[গীতা প্রেস ভাষ্য]

এখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অনার্য বলেছে। যেহেতু অর্জুন কোনোভাবেই তার বিপক্ষ দলের সাথে যুদ্ধ করতে চাইছে না, তাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অনার্য অর্থাৎ অজ্ঞানী, আনাড়ি, মূর্খ বলছেন। অর্থাৎ "আর্য" আর "অনার্য" এই দুই হলো মানবের গুণগত নাম।

⭕️ এখন ''পবিত্র বেদ'' এ পরমাত্মা আর্য সম্পর্কে কি বলেছে আসুন জেনে নিই সে বিষয়ে -

🔘 "কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্" - [ঋগ্বেদ ৯/৬৩/৫ মন্ত্র]
 
অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বকে শ্রেষ্ঠ বা মহৎ করে তোলো।

🔘 "আর্যা ব্রতা বিসৃজন্তো অধি ক্ষমি" - [ঋগ্বেদ ১০/৬৫/১১]

🔘 “বি জানীহ্যার্যান্যে চ দস্যবো বর্হিষ্মতে রন্ধয়া শাসদব্রতান্”  

                                                         - [ঋগ্বেদ - ১/৫১/৮]

⭕️ রামায়ণে দেখুন -

🔘 “সর্বদাভিগতঃ সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ। 
    আর্যসর্বসমশ্চৈব সদৈব প্রিয়দর্শন।।” 

                                       বাল্মীকি রামায়ণ - ১/১/১৬ শ্লোক

অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্র সদা-সর্বদা সৎপুরুষদের সাহচর্যে থাকতেন যেরূপ সমুদ্র সদা নদীসমূহের সাথে মিলে থাকে তথা তিনি আর্য, সমদর্শী ও সকলের প্রিয় ছিলেন।

"আর্য" শব্দটি বেদাদী শাস্ত্রে অসংখ্য জায়গায় পাবেন। কিন্তু কেউ কি আমায় "হিন্দু" শব্দটি একবার কোনো বেদ, উপনিষদ, বেদান্ত, দর্শন, মনুস্মৃতি, ব্রাহ্মণ শাস্ত্র থেকে দেখাতে পারবেন?  
– পারবেন না। 

এই ভারতে পূর্ব থেকেই বিদ্বান ঋষি মহর্ষিরা জন্ম নিয়েছে এবং তারা এখানে বসবাস করত বলে এই জায়গায় নাম ছিল "আর্যাবর্ত" অর্থাৎ 'আর্যদের নিবাস'।

আসুন এইবার আলোচনা করি "আর্যাবর্ত" থেকে 
"ভারত", "হিন্দুস্তান" বা "ইন্ডিয়া" হলো কিভাবে !

রাজা "ভরত" এর নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হয় "ভারতবর্ষ"। যখন মুঘলরা এলো তখন এই জায়গার নাম হলো "হিন্দুস্তান" এবং  ইংরেজরা আসার পরে নাম দিলো "ইন্ডিয়া"। যখন মুঘলরা এই দেশে রাজত্ব করা শুরু করে তখন তারা আমাদের উপর "জিজিয়া কর" আরোপ শুরু করে । "জিজিয়া কর" সম্পর্কে অনেকেই ইতিহাসে পড়েছেন। অমুসলিমদেরকে যদি মুসলিম শাসন করে তাহলে সেই অমুসলিমকে "জিজিয়া কর" দিতে হবে এইটা কুরআনের বাণী (সূরা ৯ আত তাওবাহ্.. আয়াত ২৯) তাই আমাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য আমাদের নাম দেওয়া হয় "হিন্দু", অর্থাৎ আমাদেরকে তখন "হিন্দু" বলে ডাকতো। অবশ্য এর আগে থেকেই তাদের ধর্মগ্রন্থে হিন্দু, হিন্দুস্তান এই শব্দগুলোর উল্লেখ আছে। যেহেতু মুসলিমদের দেওয়া নাম এই "হিন্দু" সেহেতু তাদের হিসেব মতোই এই নামের অর্থ তারাই দিয়েছে। 

আপনারা যদি "হিন্দু"-র অর্থ উর্দু , ফারসি , আরবি ভাষার মধ্যে খুঁজতে যান তাহলে এর অর্থ মিলবে - 'চোর' , 'লুচ্চা' , 'ডাকাত' , 'মাতাল' , 'দাঙ্গাবাজ' , 'কালো' , 'শয়তান' , 'কাফের'। আপতত এর থেকে আর খারাপ কিছু অর্থ নেই। ডিকশনারীর নাম বলে দিচ্ছি- "Gayas-ul-Lughat" ফারসী ডিক্শনারী , "Kareem-ul-Lughat" আরবি ডিকশনারি , "Feroz-ul-Lughat" ঊর্দু ডিকশনারি, এগুলোতে পেয়ে যাবেন  "হিন্দু" শব্দের অর্থ কি। যতটা খারাপ বলা যায় 'ঘৃণাবাচক' শব্দ; এর একটা এই "হিন্দু"। মোঘলরা আমাদের নাম "হিন্দু" দিয়েছে আর আমরা সেটা গ্রহন করেছি। কেউ আমাদের বা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে চোর, ডাকাত, মাতাল, দাঙ্গাবাজ প্রভৃতি বলছে আর এটা শুনে কি আমাদের গর্ব হবে নাকি অসম্মান হবে একটু ভেবে দেখবেন। এরপরও বলবেন আমি হিন্দু, আমি গর্বিত!!

আমাদেরকে ওরা হিন্দু বললো কিন্তু আমরা কখনোও ভেবে দেখিনি আসলে সেটা কি। আমরা গলার মালা করে নিয়েছি। এবার দেখা যাক কিছু বিদেশি ভন্ড ঐতিহাসিক এবং এদেশীয় মূর্খ হিন্দুরা কিভাবে একটা মিথ্যা ঘটনা তৈরি করেছে এই "হিন্দু" নামের অর্থ নিয়ে, যা আরো মূর্খতাপূর্ণ।

আমিও একসময় নিজের অজান্তে এটা ভাবতাম .. 
"হিন্দু" নাকি তাদের বলা হয় যারা সিন্ধু নদীর তীরে বসবাস করতো। ফার্সি / মুসলিমরা নাকি সিন্ধু বলতে পারতো না তাই "হিন্দু" বলতো আর আমাদের মূর্খ পূর্ব-পুরুষরা ভাবতো ওদের "স" উচ্চারণ হয় না। "স" উচ্চারণ করতে গেলেই বোধ হয় ওদের "হ" উচ্চারণ হয়ে যায়। যদি তাই মেনে নিই তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় - "সিন্ধু" থেকে যদি "হিন্দু" হয় তাহলে আজ পর্যন্ত "সিন্ধু" নদীর নাম কি "হিন্দু" নদী হয়েছে? কেন হয়নি? 

আচ্ছা আবারও মেনে নিলাম ওদের ভাষাতে 'স' নেই তাহলে "ফারসি" শব্দ কিভাবে হবে? "ফারহী" হবে তো তাই না? "মুসলমান" থেকে "মুহলমান" তো ? "ইসলাম" থেকে "ইহলাম" ? কিন্তু আজ পর্যন্ত কি তাই হয়েছে ? 

এই হলো আমাদের সমস্যা 😃 আমরা সত্যকে কেউ মানতেই চাইনা, যুক্তি দিয়ে কেউ বুঝতেই চাই না কোনো বিষয় 😃 অন্ধের মতো শুধু ভুলগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি 😃

উপরিউক্ত এই তথ্য বা কথাগুলো একটাও আমার বলা নয়, এই কথাগুলো যিনি বলেছেন তার নাম হলো "পন্ডিত মহেন্দ্র পাল আর্য"। সনাতন ধর্ম সম্পর্কে যারা মোটামুটি চর্চা করেন তারা নিশ্চয়ই "মহেন্দ্র পাল" কে চেনেন। যে "মহেন্দ্র পাল" জী আগে মুসলিম ছিলেন, তার পূর্ব নাম ছিল "মেহবুব আলি"। তিনি উত্তর প্রদেশের এক মসজিদের ইমাম ছিলেন তারপর তিনি মহর্ষি দয়ানন্দ জীর "সত্যার্থ প্রকাশ" গ্রন্থটি পড়ে সে ইসলামের সমস্ত ভুল ভ্রান্তিগুলোকে জানতে পারেন তারপর তিনি সনাতন বৈদিক ধর্মকে গ্রহণ করেন।

এই সমস্ত তথ্য জানার পরও অনেক সনাতনী ভাই জোর গলায় বলে যে আমরা হিন্দু ! আমি সেই সমস্ত ভাইদের প্রশ্ন করতে চাই যে - আপনারা কেন হিন্দু ? সেই ভাই উত্তরে অবশ্যই বলবেন যে - "হিন্দু" বলে আমাদের ডাকা হতো তাই আমরা "হিন্দু"। আপনাদের "হিন্দু" বলে কারা ডাকতো ? নিশ্চয় আমরা নিজেই নিজেকে হিন্দু বলতাম না ? অবশ্যই অন্য কোনো দেশের ব্যক্তিগণ আমাদের "হিন্দু" বলতো ? তাহলে আপনারা এইটাই প্রমাণ করছেন যে আপনারা লোকের দেওয়া নামকেই বেশি গুরুত্ব দেন। আমি এইটাই ভাবছি যে আজ যদি ভিন্ন দেশের ব্যক্তিরা আমাদের পাগল , অজ্ঞানী , অসভ্য বলে ডাকতো তাহলে ঠিক "হিন্দু" শব্দের মতোই এই শব্দগুলোকেও গুরুত্ব দিতেন তাই না ? বিষয়টি ভেবে দেখবেন। আমাদের সমস্ত শাস্ত্র বলছে আমাদের গুনগত নাম "আর্য"; বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা আজ নিজেকে "হিন্দু" বলতেই ব্যস্ত। "হিন্দু" নাম হওয়ার পর থেকে আমরা বেদাদী শাস্ত্রচর্চাকেও বাদ দিয়ে দিয়েছি, আজ হিন্দু সমাজ সনাতন বৈদিক ধর্মের শাস্ত্র থেকে অনেকটা দূরে আজ আমরা শাস্ত্রকে ভুলে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসকে এখনও আমাদের ধর্মে স্থান দিয়ে রেখেছি।।

[একটি ধর্মীয় ওয়েবসাইট থেকে উপরের লেখাটা নেওয়া]

"সবশেষ আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমার লেখাটা এত ধর্য্যের সঙ্গে পড়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, কেননা এই ধরনের লেখা ধর্য্য সহকারে পড়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পরে। এবং শেষে সকলের অন্তঃস্থ আত্মাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করছি, আমার ভক্তি ও শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন- 🙏🏻

ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন