"আর্য-অনার্য" শব্দ নিরসনঃ-
*হিস্ট্রি নামক উপন্যাসের গালগল্প / গুলগাপ্পার ইতিহাস* - পর্ব ১
সাব-টাইট্ল্: *একাডেমিক নাক-ই কি সৌন্দর্যের মাপকাঠি?*
নামটা বেশ জম্পেশ হল, যাই বলুন!
এমন নামের ব্যাখ্যা খুব সিম্পল –
১। ভারতীয় হিস্ট্রি নিয়ে বিভিন্ন ন্যারেটিভ মূল টেক্সটের আলোয় পরীক্ষা করে দেখবো
২। গালগল্প / গুলগাপ্পা – এটা গণতান্ত্রিক চয়েস দিলাম; যে যেভাবে নেবেন
৩। ‘হিস্ট্রি’ – ‘মা যা হয়েছেন’ – তা আর ‘ইতিহাস’ এক নয়। অতএব দুটোই থাকলো।
৪। একজন একাডেমিসিয়ানের ‘নাক’ বিষয়ক মন্তব্য পরীক্ষা করতে হবে। অগত্যা সাব-টাইট্ল্!
আলোচনা শুরু …
গল্প ১:
ঋগ্বেদ হল ‘আর্য বনাম অনার্য’ হিস্ট্রি
সমস্যা: ‘অনার্য’ শব্দটাই ঋগ্বেদে নেই। ইন ফ্যাক্ট, শ্রুতিতে নেই।
প্রশ্ন: তাহলে ‘আর্য বনাম অনার্য’ কি করে ভ্যালিড গল্প-নাম হয়?
মন্তব্য:
ক। ‘অনার্য’ শব্দ প্রথম আছে প্রাচীন পারস্যের আভেস্তায়। তারা আবার ‘বিদেশীদের’ ‘অনার্য’ বলতো [নাস্ক ১৯: ভেন্দিদাদ (জুদ দিউ দাদ) ৪৪ (ফার্গার্দ ১-১১, ১৩-২২), অংশ ৫৭] । তার মানে, তাদের চোখে সব ভারতীয় মানেই ‘অনার্য’। সুন্দর আপেক্ষিকতা।
খ। জরাথুষ্ট্র ‘আর্য’ শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘সাধারণ মানসিকতা’ এবং ‘মিথ্যার’ (‘দ্রুজ’) বিপরীতে ‘মহান’ (noble) বোঝাতে (গাথা ৩৩.৩-৪। ৪৬.১। ৪৯.৭)। [আরও উদাহরণ আছে, কয়েকটিই দিলাম]
গ। গৌতম বুদ্ধ আর্য আর অনার্য শব্দ ব্যবহার করেছেন সৎ সজ্জন নৈতিক ধার্মিক ও তার বিপরীত বোঝাতে।
ঘ। তামিল সঙ্গম সাহিত্যে ‘অনার্য’ শব্দ নেই; ‘আর্য’ শব্দ আছে প্রশংসার্থে
ঘ। তার মানে, শ্রুতির ঋষিরা, জরাথুষ্ট্র, তামিল কবিরা, গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর – কেউই জানতেন না ‘আর্য বনাম অনার্য’ মানে ‘আর্যজাতি বনাম অনার্যজাতি’, অথচ আমাগো হিস্ট্রি ঔপন্যাসিকরা জানে!
গল্প ২:
ঋগ্বেদ থেকে জানা যায় ‘আর্যজাতি আক্রমণ/ আগমন তত্ত্ব’
সমস্যা: ‘আর্যজাতি’ শব্দটাই ঋগ্বেদ তো দূরের কথা, আজ থেকে ২০০ বছর আগের কোন গ্রন্থেই নেই
প্রশ্ন:
ক। তাহলে ‘আর্যজাতি’ নিয়ে গল্প কি করে ভ্যালিড হয়?
খ। আচ্ছা, বৈদিক হিন্দুদের পবিত্র ও সর্বোচ্চ গ্রন্থে যে শব্দ নেই, সেই রকম শব্দ যদি একাডেমিক্সের নাম করে বানানো বা কল্পনা ভ্যালিড হয়, তাহলে ইহুদী খ্রিস্ট ইসলামের সর্বোচ্চ পবিত্র গ্রন্থেও – তরাহ বাইবেল কোরআন - কি একইরকম ভাবে নতুন কোন শব্দ কল্পনা করা যাবে?
প্রস্তাব:
ক। সুতরাং, দ্বিচারিতা ত্যাগ করতে হবে
খ। যে প্রাচীন গ্রন্থে যে শব্দ আছে, ইতিহাস নির্মাণ সেই ভিত্তিক হবে
গ। নতুন শব্দ কল্পনা করে তত্ত্ব বানাতে চাইলে, সব ক্ষেত্রেই তাই হবে – ‘সাম্যবাদ কি কসম’!
গল্প ৩:
‘আর্যজাতি বনাম দ্রাবিড়/ তামিল’ গল্প
সমস্যা:
ক। তামিল সঙ্গম সাহিত্যে, ‘অনার্য’ শব্দ তো নেইই, উল্টে ‘আর্য’ প্রশংসা আছে।
খ। সমগ্র তামিল সঙ্গম সাহিত্য জুড়ে বেদ, বেদের ঋষি, রাম, কৃষ্ণ, রামায়ণ, মহাভারতের সশ্রদ্ধ উল্লেখ বারবার আছে
প্রশ্ন:
ক। তাহলে ‘আর্যজাতি বনাম দ্রাবিড়/ তামিল’ গল্প কি করে ভ্যালিড হয়?
খ। উত্তর ভারত বনাম দক্ষিণ ভারত – এই গালগল্প/ গুলগাপ্পা কি করে চলে?
প্রস্তাব: তামিল সঙ্গম সাহিত্য পড়ুন
[উপরোক্ত তিনটি গল্প না হয় আরও সবিস্তারে গল্প করা যাবে। এই পর্বে এরপরের ৪ নং গল্পটি নিয়ে কিঞ্চিৎ রগড়াইবো – কারণ তাহাতে ‘নাক’ আছে]
গল্প ৪:
ঋগ্বেদে ‘অনাস’ শব্দ আছে, অর্থাৎ ‘যার নাক নেই’ = তার মানে, ‘থ্যাবড়া নাক’ = ‘অনার্য’
সমস্যা:
ক। শুধু ঋগ্বেদেই নয়, সমগ্র শ্রুতিতে (বেদ ব্রাহ্মণ আরণ্যক উপনিষদ) ‘অনাস’ শব্দ মাত্র ১ বার আছে ঋষি গৌরিবীতি-র ৫.২৯.১০ ঋকে
খ। সেই একটিমাত্র ‘অনাস’ শব্দ থেকে আমাগো হিস্ট্রি ঔপন্যাসিকরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, ‘অনাস = থ্যাবড়া নাক = অনার্য’! ভাবা যায়!
গ। যে যার পারিবারিক এ্যালবামের পাতা ওলটান। যে কোন মানুষের মধ্যেই থ্যাবড়া নাক পাবেন। সো হোয়াট? তায় আবার সবার জিন এক।
‘অনাস’ মানে কি?
সায়ন, উইলসন, গেল্ডনার, ব্রেরটন-জ্যামিসন, রমেশ চন্দ্র দত্ত – এই পণ্ডিতরা বলছেন ‘অনাস’ মানে মুখহীন বা বাচ্-হীন। এখন ‘বাচ্-হীন’ মানে বোবা নয়। তার তাৎপর্য মন্ত্রহীন। শব্দটি ‘দস্যু’ সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে।
কিন্তু ইরফান হাবিবের মত হিস্টোরিয়ান বলছেন, ‘অনাস’ মানে ‘নাকহীন’ এবং ‘কুৎসিত’!
তিনি কি বলেছেন, অনুবাদে দেখা যাক -
হাবিব-ঠাকুর: ‘শারীরিক গড়ন বা চামড়ার রঙ (ভাবগত অর্থে বর্ণ) অন্তত প্রাথমিকভাবে নিশ্চয়ই এখানে সক্রিয় ছিল, কেননা যাদের বলা হত অনস অর্থাৎ কুৎসিত (অন-আস) বা নাসিকাহীন (অ-নাস), এদের শারীরিক বৈশিষ্ট সেই দস্যুদের একেবারে বিপরীত ছিল। বেশ উদ্দীপ্ত আবেগে অনার্যদের কালো চামড়ার (কৃষ্ণ-ত্বাচ) মানুষ হিসাবে বর্ণনা করা হত।’ (১.১০০.১৮)। (হাবিব, ইরফান; বিজয় কুমার ঠাকুর। ২০১৩। বৈদিক সভ্যতা। ভাষান্তর: কাবেরী বসু। কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, পৃ ১৭)।
প্রথম কথা, ‘বেশ উদ্দীপ্ত আবেগে’ হাবিব-ঠাকুর যতই ‘অনার্যদের কালো চামড়া’র গল্প বানান, ঋগ্বেদে ‘অনার্য’ শব্দই নেই, তা আগে উল্লেখ করেছি।
দ্বিতীয়ত, তাঁদের ‘কুৎসিত’ শব্দ ব্যবহার বিশেষ আলোচনার দাবী রাখে। হাবিব-ঠাকুর দেখা যাচ্ছে ‘বডি শেমিং’-এর মানসিকতা আছে। দৈহিক বৈশিষ্টকে ‘কুৎসিত - সুন্দর’ এই ‘বাইনারি’র বাইরে তাঁরা ভাবতে পারছেন না। নিজেদের অজ্ঞাতেই তাঁদের বর্ণবাদী এলিটতন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ছে। ঐ ঋকে ‘অনাস’ শব্দ আছে, কিন্তু ‘অনাস’ মানে ‘কুৎসিত’ এ তথ্য তাঁরা কোথায় পেলেন?
হাবিব বোধহয় নিজের নাকের গড়নকে সৌন্দর্যের মাপকাঠি মনে করেন।
এইজন্যই এই পোস্টে স্পেশাল সাব-টাইট্ল্ দিয়েছি।
এবার একটু কমন সেন্স দিয়ে ইরফান হাবিবের এই হিস্ট্রি উপন্যাস বোঝা যাক।
পাশ্চাত্য মতে, ঋগ্বেদ রচনাকাল ১৫০০-১০০০ খ্রিস্ট পূর্ব। আপাতত সময়কাল নিয়ে তর্কে যাব না। ধরে নিলাম, ঠিক আছে ৫০০ বছর ধরে লেখা।
মানে, আজ ২০২২য়ে যদি কোন সম্পূর্ণ গ্রন্থ পাই, তার লেখা শুরু হয়েছে ১৫২২ – উপমা দিলাম।
তার মানে, ১৫২২ থেকে ২০২২ – এই ৫০০ বছরে মাত্র একটি শব্দ ‘অনাস’ দেখে এবং তার নিজের মত অর্থ করে, পণ্ডিতপ্রবর ইরফান হাবিব সিদ্ধান্তে আসছেন এখানে ‘অনার্য’ ‘নাকহীন’ ‘কুৎসিত’ বলা হয়েছে!
লজিকটা একবার ভাবুন।
১৫২২ থেকে ২০২২ – এই সময়কালের মাত্র একটি শব্দ ভাঙ্গিয়ে এই ৫০০ বছর নিয়ে সাধারণীকরণ করে ফেললেন পণ্ডিত ইরফান!
আচ্ছা, সাম্যবাদী মনোভাবে, আমরা যদি একমাত্র ‘হত্যা’ শব্দটা আব্রাহামিয় রেলিজিওনের গ্রন্থগুলি থেকে নিয়ে সমগ্র গ্রন্থগুলিকেই সেই শব্দের আঙ্গিকে ভাবি? ইরফান হাবিব কি তাই করবেন?
আচ্ছা, জানেন কি ঋগ্বেদে কতগুলি ঋক আছে?
উত্তর - ১০৫৫২ ঋক।
আচ্ছা, জানেন কি ঋগ্বেদে কতগুলি শব্দাক্ষর আছে?
উত্তর – ঋগ্বেদে শব্দাক্ষর বা syllable সংখ্যা – ৩,৯৭,২৬৫
সংখ্যাটা ভাবুন। ৩,৯৭,২৬৫
এবার ভাবুন, ঐ ৩,৯৭,২৬৫ শব্দাক্ষরের মধ্যে মাত্র দুটি শব্দাক্ষর ‘অনাস’!
তার ভিত্তিতেই ৩,৯৭,২৬৫-এর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেলো?
কি ভয়াবহ!!!
এ হিস্ট্রি উপন্যাস না হলদে মলাট?
ক্রমশ
লেখস্বত্ত: ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচারে : VEDA
মন্তব্যসমূহ