"প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ও গুরুকুল"
🌿🌼 নমস্কার 🌼🌿
" ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।
- “এই জগতে জ্ঞানের সমান পবিত্রকারী নিঃসন্দেহে কিছুই নেই।” [শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪/৩৮]📖🌿
🍂✍️পবিত্র শ্লোক থেকে উপলব্ধি হয় যে প্রাচীন সময়ে এ ভূখণ্ড জ্ঞান বিজ্ঞানে কতটুকু সফল ও অগ্রগামী ছিলো। জ্ঞানের আরাধনা এখানে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানে অধিষ্ঠিত ছিলো। কিন্তু পাশ্চাত্যের অনুকরণে আজ আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের গর্বের ইতিহাস। আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা ও গুরুকুল।
🍂✍️বর্তমান সময়ের গুরুকুল শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই কম হলেও। প্রাচীন কাল থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্ব সময় পর্যন্ত এ ভূখণ্ডে গুরুকুল ব্যবস্থা টিকে ছিল। এখানে বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন এবং গবেষণা করা হতো। এমন গুরুকুল এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে চাণক্য, বিষ্ণুগুপ্ত, আর্যভট্ট, পাণিনি এবং বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে। গুরুকুল শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুকাল থেকে একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রদান করা হতো। গুরুকুল এর ভর্তি কাল শুরু হতো উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমে এবং শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে চতুরাশ্রম এর ২য় ধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যে দিয়ে শেষ হতো। এই সময় কালে একজন শিক্ষার্থী বহু বিষয়ে অধ্যয়ন করতো যেমন, বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র সমূহ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা,রণনীতি ইত্যাদি।
🍂✍️গুরুকুল ব্যবস্থা:
তৎকালীন সময়ে মুদ্রণযন্ত্র না থাকলেও পাঠদান থেমে থাকেনি। অনন্য কৌশলে শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হতো। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে রাজপুত্র ---সবার জন্য ছিল কঠোর অনুশীলনের ব্যবস্থা। এমনকি, গুরু সন্দীপনি মুনির পাঠশালায় ছয় বেদাঙ্গ, উপনিষদ, চার বেদ, ধনুর্বেদ, তর্কশাস্ত্র ও ছয় প্রকার রাজনীতি বিদ্যা শিক্ষা করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। এই ছয় প্রকার রাজনীতি হচ্ছে---সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধ ও আশ্রয়। গুরুকুলের খরচ চালানোর জন্য বরাদ্দ ছিল রাজকীয় দান "অগ্রহার গ্রাম।" আর ব্রহ্মচারী বিদ্যার্থীদের ভিক্ষা দেওয়াটা ছিল গৃহস্থের কর্তব্য।
গুরুকুল শিক্ষা পদ্ধতি:
শিক্ষা পদ্ধতি ছিল---
১) পূর্বজ্ঞান পরীক্ষার জন্য (আজকের ভাষায় "পূর্বপাঠের পুনরালোচনা"): উপক্রম,
২) গুরুবাণী: শ্রবণ,
৩) সমবেত আবৃত্তি: অভ্যাস,
৪) সতীর্থদের সঙ্গে আলোচনা বা আজকের ভাষায় "গ্রুপ ডিসকাশন, "
৫) আলোচনান্তে তথ্য আহরণ,
৬) যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ: উপপত্তি এবং এরপর
৭) একক প্রচেষ্টায়: মনন ও নিদিধ্যাসন।
গুরুকুলের পর ছিল তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীল, বল্লভী, কাশী, কাঞ্চি, ওদন্তপুরী, বিক্রমমণিপুরের মতো নামী বিশ্ববিদ্যালয়। সবচেয়ে প্রাচীন ছিল তক্ষশীলা। এখানকার ছাত্র ছিলেন পাণিনি, চাণক্য, শুশ্রূত, জীবক। রাজপুত্রদের শিখতে হতো সাংখ্য, যোগ, লোকায়ত দর্শন, পুরাণ, ইতিহাস, আখ্যায়িকা, ধর্মশাস্ত্র, কৃষি, বাণিজ্য, পশুপালন, দণ্ডনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, ১৮ রকম শিল্পকলা, গণিত, রসায়ন, জ্যোতিষ ও আয়ুর্বেদ। নালন্দায় ছিলেন প্রায় ১০ হাজার শিক্ষক-ছাত্র, বিক্রমশীলায় ৫ হাজার। শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। কৌটিল্যের লেখায় আমরা পাই ভারতের মৌর্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থার পরিচয়। কৌটিল্য জানাচ্ছেন ( ১২ শ অধ্যায়), শিক্ষার মধ্যে ছিল শুশ্রূষা, শ্রবণম, ধারণম, উহপোহম, বিজ্ঞানম, তত্ত্বাভিনিবেশম।
১) শিক্ষার আগ্রহ ও উদ্যোগ: শুশ্রূষা,
২) গুরুমুখে বিদ্যার ব্যাখ্যা শ্রবণ: শ্রবণম,
৩) আচার্যের কথার মর্মার্থবোধ: গ্রহণম,
৪) স্মৃতি সহায়ে শিক্ষণীয় বিষয় ধারণ: ধারণম,
৫) পারস্পরিক বিষয়ভিত্তিক আলোচনা: উহপোহম
৬)অধীত বিদ্যা বিষয়ে সামগ্রিকবোধ: বিজ্ঞানম,
৭) অধীত বিদ্যার মর্ম প্রবেশ: তত্ত্বাভিনিবেশম।
ওই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শব্দবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, বৌদ্ধধর্ম, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, শরীরতত্ববিদ্যা, সংগীত, চিত্রকলা এসব বিষয় পড়ানো হতো।
রাধা কুমুদ মুখার্জি তাঁর Ancient Indian Education গ্রন্থে হিউয়েন সাঙ-এর কথা লিখেছেন, “Foreign students came to the establshment to put an end to their doubts and then became celebrated.”
নালন্দায় পড়াশোনা অনেক বেশি শ্রুতিনির্ভর ছিল এবং শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করাই ছিলো তার উদ্দেশ্য। বস্তগত প্রাপ্তি এই শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো না, বরং শিক্ষালাভের মূল উদ্দেশ্য ছিলো “knowledge for knowledge sake”। অনেক বেশি আলোচনা, যুক্তি-পাল্টাযুক্তির আশ্রয়ে অধ্যয়ন চলতো।
হিউয়েন সাঙ আরও লিখেছেন (Mookerji, 2016), “There eminent and accomplished men assemble in crowds, discuss possible and impossible doctrines, and after having been assured of the excellence of their opinions by wise men, become far famed for their wisdom.”
চৈনিক পর্যটক ইৎ সিং জানাচ্ছেন, নালন্দার পাঠ্যক্রমে ছিল মহাযান, হীনযান বৌদ্ধমত, থেরবাদ, তত্ত্বনিচয়, ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ ( শব্দবিদ্যা), রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, যোগ, যাদু, তান্ত্রিক বৌদ্ধশাস্ত্র, জ্যোতিষ, ব্যবহারিক শাস্ত্র, শিল্পবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা ইত্যাদি।
ইৎ সিং আরো বলেন, ছয় বছর বয়সে ভর্তির ব্যবস্থা ছিল এবং আট বছর বয়সে পড়তে হতো পাণিনি ব্যাকরণের প্রথম অংশ। এরপর দশ বছর বয়সে পাণিনির কঠিন অংশ পড়তে হতো। তারপর পনেরো বছরে আয়ত্ত্ব করতে হতো গোটা পাণিনি ব্যাকরণ। সেই সঙ্গে পড়তে হতো পতঞ্জলির মহাভাষ্য, হেতুবিদ্যা ও অভিধর্ম। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ছিল নালন্দা। নালন্দায় ছিলেন অধ্যাপক অতীশ দীপঙ্কর, শান্ত রক্ষিত, পণ্ডিত শীলভদ্রের মতো বিশিষ্ট গুণীজনেরা।
🍂✍️কিন্তু কিভাবে এই প্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়। এর কারণ অনুসন্ধানে আমাদের ফিরে দেখতে হবে ভারতের কারারুদ্ধ ইতিহাস। প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিজ্ঞানের তীর্থ স্থান রুপে ছিল প্রসিদ্ধ। কিন্তু অজ্ঞানীদের আগ্রাসনে খিলজি কতৃক ধ্বংস হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। কথিত আছে যে, এত গ্রন্থ সেখানে সংগ্রহীত ছিল যে আনুমানিক ৩ মাস সেখানে আগুন জ্বলে ছিল। তবে তারপরেও গুরুকুল শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কিন্তু যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এখানে উপনিবেশ স্থাপন করে তখন তারা এ ভূখণ্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নজর দেয়।
১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকার কতৃক "Indian Education Act" প্রণয়ন করা হয়। যা Lord Macaulay কতৃক প্রণীত হয়। তবে তার পূর্বে তিনি একটি জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং দুইজন ব্রিটিশ অফিসারকে জরিপ করতে প্রেরণ করেন যাদের নাম ছিল G W Luther এবং Thomas Munro. একজনকে উত্তর ভারতে প্রেরণ করেন এবং অন্যজন গিয়েছিল দক্ষিণ ভারতে। G W Luther এবং Thomas Munro ফিরে এসে এক আশ্চর্যজনক রিপোর্ট পেশ করেন, যেখানে উল্লেখ করা হয়, উত্তর ভারতে শিক্ষার হার ৯৭% এবং দক্ষিণ ভারতে শিক্ষার হার ১০০%। তৎকালীন বৃটিশ সরকার এই সিধান্তে উপনীত হলেন যে বৃটিশ উপনিবেশকে স্থায়ী করতে হলে গুরুকুল শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে সেখানে বৃটিশ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রযুক্ত করতে হবে। ফলস্বরূপ, ভারতে অবস্থিত বেশিরভাগ গুরুকুল ধ্বংসের শিকার হয় এবং এ মহান শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়।
🍂✍️বর্তমান সময়ে পূর্বের মতো গুরকুল শিক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ্য করা না গেলে আর্য সমাজ কতৃক গুরুকুল শিক্ষা ব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস হয়। ফলস্বরুপ ভারত, মরিশাস এবং ফিজিতে DAV এর কার্যক্রম চলমান। যা আমাদের হারিয়ে যাওয়া গৌরবের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং অনুপ্রাণিত করে গুরুকুল পুনঃ প্রতিষ্ঠার। আশা করি সমগ্র বিশ্বে গুরুকুল শিক্ষা ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবে। আসুন নিজের শিকড়ে ফিরে আসি, বৈদিক ধর্মের দিকে ফিরে আসি।
প্রচারে: VEDA
মন্তব্যসমূহ