"বেদ ও বিমানবিদ্যা"
মনুষ্য এ জগতে বিচরণ খুব প্রাচীন নয়। পৃথিবী সৃষ্টির বহু পরে বিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মনুষ্যের ক্রমবিকাশ হয়েছে। মনুষ্যের পূর্ণবিকাশ লাভের পর আদিম বর্বর বন্যদশা থেকে সভ্যতার দিকে অগ্রসরমান হয়েছে। অজানাকে জানার অদম্য মনোভাব মনুষ্যকে সর্বদা তাড়না দিয়েছে। ফলস্বরূপ, একদা শিকারী হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতি হিসেবে সুপরিচিত মনুষ্য সমাজ স্থান করে নিয়েছে জ্ঞান, বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের ধারক, প্রাণীকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে। মহাবিশ্বের বিশালতা থেকে সমুদ্র অতল গহ্বরে লুকায়িত রহস্য উন্মোচন করে চলেছে প্রতিনিয়ত। যন্ত্রচালিত যানবাহন যেমন নির্মাণ করে এনেছে শিল্প বিপ্লব, তেমনি মহাবিশ্বের পথে পাড়ি দিয়ে করেছে অসম্ভবকে সম্ভব।
বিজ্ঞানে জয়যাত্রায় বহু আবিষ্কার এনেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন, জীবনকে করেছে সহজ ও আধুনিক। সেই সকল আধুনিক আবিষ্কার এর মধ্যে বিমান আবিষ্কার সবথেকে অনবদ্য আবিষ্কার হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বর্তমান সূত্র অনুসারে, রাইট ভ্রাতৃদ্বয় এর মাধ্যমে আধুনিক বিশ্ব বিমান যাত্রার যুগে প্রবেশ করে
অরভিল রাইট এবং উইলবার ছিলেন দু'জন মার্কিন প্রকৌশলী ভ্রাতার যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম নিয়ন্ত্রিত, শক্তিসম্পন্ন এবং বাতাসের চাইতে ভারী সুস্থিত মানুষ-বহনযোগ্য উড়োজাহাজ তৈরি করেন।
কিন্তু বিমান চালনার ইতিহাস রাইট ব্রাদার্স এর চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন ও সুগভীর। পরাধীন ভারতে ১৮৬৪ সালে মহারাষ্ট্রের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এ অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তি। নাম তার শিবকর বাপুজী তালপাড়ে। তিনি জামশেদজী জিজিভাই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তার শিক্ষক চিরঞ্জীলাল ভার্মার দ্বারা পবিত্র বেদ ও বৈদিক শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত হয় এবং এর নিমিত্তে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বেদ ভাষ্য দ্বারা প্রভাবিত হন এবং প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নে প্রয়াস করেন। তিনি ঋষি ভরদ্বাজের লিখিত বিমান শাস্ত্র অধ্যয়ন শুরু করেন এবং বৈদিক সংস্কৃতও শেখেন। পরবর্তীতে বহু প্রচেষ্টার ফলে ১৮৯৫সালে তৈরি করেন বিমান, নাম দেন " মরুতসখা "।
কিন্তু বিমানবিদ্যার ইতিহাস এর চেয়ে প্রাচীন ও সুসংবদ্ধ। "বিমান" শব্দের উল্লেখ বৈদিক সংস্কৃত মন্ত্রেই বিদ্যমান। আমাদের প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ বাল্মিকী রামায়ণে আমরা "পুষ্পক বিমান" এর উল্লেখ পাই, এছাড়াও মহাভারতের শান্তিপর্বেও আকাশযান এর উল্লেখ রয়েছে,
তত্ সুপর্ণাকরিথমাস্থিতৎ বৈষ্ণবৎ পদম্। ভাভিরপ্রতিমৎ ভাতি ত্রৈলোক্যমবভীসয়ত্।।
- মহাভারত, শান্তিপর্ব-২২৮/১৩
অর্থাৎ, সেই প্রভাপুঞ্জ ভগবান বিষ্ণুর [মহর্ষি বিষ্ণুর] একটি বিমান ছিল, যা নিজ দিব্য প্রভা দ্বারা তিন লোককেই প্রকাশিত করার ন্যায় অনুপম যাতায়াত করতে পারতো। সূর্য এবং গড়ুর যে আকাশ মার্গে চলে, সেই আকাশ মার্গে সেই বিমানটিও চলতো।
বিমানবিদ্যা শুধুমাত্র ঐতিহাসিক গ্রন্থ সমূহে সীমাবদ্ধ নয় বরং প্রাচীন ঋষিগণ বিমানবিদ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ও বিবিধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ঋষি ভরদ্বাজ সেই বিমানবিদ্যার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। তার রচিত "বৈমানিক শাস্ত্র" ও "যন্ত্র সর্বস্ব" গ্রন্থদ্বয়ে বিবিধ প্রকারের বিমান, তাহার জ্বালানি সম্পর্কে আলোচনা করেন।
অর্থাৎ বিমানবিদ্যার সহিত সনাতনধর্ম শাস্ত্রের সম্পর্ক যথেষ্ট প্রাচীন ও সুগভীর। কিন্তু এই সুগভীরতা লাভ করেছে, কারণ সনাতনধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ সেই বিজ্ঞানের সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী গ্রন্থ। সৃষ্টিতত্ত্ব, সালোকসংশ্লেষণ, জলচক্র, সপ্ত রশ্মির মতো বিমানবিদ্যা স্থান পেয়েছে বেদমন্ত্র এর মধ্যে। বেদের সেই অমৃত জ্ঞান জানার প্রয়াস করি তবে,
ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ২২তম সুক্তের ২য় মন্ত্রে বলা হয়েছে,
"ও৩ম্ যা সুরথা রথীতমোভা দেবা দিবিস্পৃশা।
অশ্বীনা তা হবামহে।।" - ঋগ্বেদ ১/২২/২
অর্থাৎ, পরমাত্মা উত্তম রথের নির্মাতা! তিনি জল ও অগ্নীর ন্যায় পবিত্র। তাঁকে যজ্ঞে আহ্বান করি। যিনি প্রশংশনীয় রথ নির্মাতা মনুষ্যগণকে সৃষ্ট করেছেন। তারা এমন রথ নির্মাণ করে যা আকাশ মার্গ দ্বারা এক স্থান হতে অন্য স্থানে শীঘ্র গমনশীল।
ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ২২তম সুক্তের ১৪তম মন্ত্রে পুনরায় বলা হয়েছে,
"ও৩ম্ তয়োরিদ্ ঘৃতবত্পয়ো বিপ্রা রিহন্তি ধীতিভিঃ। গন্ধর্বস্য ধ্রুবে পদে।।" - ঋগ্বেদ ১/২২/১৪
অর্থাৎ, যে বুদ্ধিমান পুরুষ যাহা হইতে প্রশংশনীয় হয়, সেই প্রকাশময় এবং অপ্রকাশময় লোককে ধারণ এবং আকর্ষণ আদি গুন দ্বারা পৃথিবীর ধারণকারী বায়ু যে সর্বত্র বিদ্যমান নিশ্চল অন্তরিক্ষ স্থান আছে, তাহাতে বিমান আদি যানে গমনাগমন করেন এবং প্রশংসিত হইয়া উক্ত লোকেই আশ্রয় লইয়া প্রশংশনীয় জলময় রসাদি পদার্থকে গ্রহণ করেন।
ভাবার্থ: বিদ্বানের পৃথিবী আদি পদার্থ দ্বারা বিমান আদি যান নির্মাণ করিয়া তাহার কৌশলে জল এবং অগ্নীর প্রয়োগ দ্বারা ভূমি, সমুদ্র এবং আকাশে যাওয়া আসা করা উচিত।
ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ১৮৩তম সুক্তের ১ম মন্ত্রেও বিমান সম্পর্কে বলা হয়েছে,
"ত্বং যুঞ্জাথাং মনোসো যো জবীয়ান ত্রিবন্ধরো বৃষণা যস্ত্রিচক্র।
যেনোপয়াথঃ সুকৃতাদুরোনাং ত্রিধাতুনা পতোযো বির্ণ পণৈঃ।।" - ঋগ্বেদ ১/১৮৩/১
অর্থাৎ, হে শিল্পবিদ্যা মনুষ্যগণ! যে রথ মনের গতি অপেক্ষাও অধিক গতিশীল, যার তিনটি বন্ধুর ন্যায় চক্র আছে। যা সুফলদায়ী ও তিনপ্রকার ধাতু বিশিষ্ট, পক্ষি স্বরূপ পক্ষ বলে আকাশপথে এখান হইতে ওখানে যাতায়াত করতে পারে। সে রথে আরোহণ করে তোমরা সেইরূপ অতিদ্রুততার সহিত সুকৃতকারীর গৃহে যাও। সে রথ যোজনা কর।
ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ৩৮তম সুক্তের ১২তম মন্ত্রে পুনরায় বলা হয়েছে,
"ও৩ম্ স্থিরা বঃ সন্তু নেময়ো রথা অশ্বাস এষাম্।
সুসংস্কৃতা অভীশবঃ।।" - ঋগ্বেদ ১/৩৮/১২
অর্থাৎ, হে বিদ্বান! তোমাদের এই পবনের নিকট হইতে উত্তম শিল্পবিদ্যা দ্বারা সংস্কার হইয়া কলা চক্রযুক্ত (রথাঃ) বিমান আদি রথ, মার্গে (পথে) ব্যাপ্তকারী অগ্নি আদি বা অশ্বের সদৃশ দৃঢ় বলযুক্ত হইবে (শত্রুদের দূর্বল বা পরাজিত করতে)।
ঋগ্বেদ এ আরো মন্ত্রে আমরা বিমান সম্পর্কে ধারণা লাভ করি,
"অনশ্বো জাতো অনভিশু রকথ্যে রথস্ত্রিচক্রঃ
পরিবর্তে রজঃ মহত্তদ্বো দেবস্য প্রবাচনং
দ্যামৃভবঃ পৃথিবীং যচ্ছ পূষ্যথ।।" - ঋগ্বেদ ৪।৩৬।১
অর্থাৎ, হে রথ নির্মাতা মনুষ্যগণ! তোমাদের নির্মিত প্রশংসনীয় রথ অশ্ববিহীন, লাগামহীন, তিনচক্র বিশিষ্ট এবং আকাশে ভ্রমণকারী।তোমাদের এই দিব্য সুখ্যাতিযোগ্য মহান কর্মদ্বারা অন্তরিক্ষ ও পৃথিবী উভয়ই পুষ্ট হয়।
শুধু ঋগ্বেদে নয়, বরং সামবেদে বিমানবিদ্যা সম্পর্কে বলা,
"প্রতি প্রিয়তমং রথং বৃষণং বসুবাহনম্॥
স্তোতা বামশ্বিনাবৃষিঃ স্তোমেভির্ভূষতি প্রতি মাধ্বী মম শ্রুতং হবম্॥" -সামবেদ ৪১৮
অর্থাৎ, হে রথের নির্মাতা আর চালক শিল্পীজন! অতিশয় প্রিয়, শত্রুসেনার ওপর শস্ত্রাস্ত্রসমূহের বর্ষণের সাধনভূত, ধন ধান্য ইত্যাদিকে দেশান্তরে পৌঁছে দেয়া বিমানাদি যানকে তোমাদের প্রশংসক বিদ্বান মানব দেশান্তরে নিয়ে যাওয়াকারী পদার্থসমূহ দ্বারা অলঙ্কৃত করেন। হে মধুর গতিবিদ্যা জানা শিল্পীগণ! তোমরা আমার বিমানাদি যানের নির্মাণ করা তথা এগুলোকে চালানোর বিষয়ক আহ্বানকে পূর্ণ করো ॥
ভাবার্থঃ সকল মানবের এমন কর্ম করা উচিত, যাতে পুনর্জন্মে মানবশরীরই প্রাপ্ত হয়। এভাবেই রাষ্ট্রে শিল্পবিদ্যার উন্নতি দ্বারা বেগবান্ ভূমি সম্বন্ধ, জলযান আর অন্তরিক্ষ্যান বানানো উচিত আর দেশান্তরগমন, ব্যাপার, যুদ্ধ ইত্যাদিতে প্রয়োগ করা
উচিত ॥
আরো বহুবিধ মন্ত্র রয়েছে যেখানে বিমানবিদ্যার উল্লেখ রয়েছে।
হে অমৃতের সন্তানগণ! বেদ অপার জ্ঞানের ভান্ডার। আমরা আমাদের শিকড় থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলে বেদের অমৃত জ্ঞান থেকে দূরে। বেদে সকল প্রকার জ্ঞানের উপস্থিতি রয়েছে। তাই আমাদের সকলের উচিত সেই অমৃত জ্ঞান অর্জন করে পুনরায় জগতে জৌতি ছড়িয়ে দেওয়া।
✍️ VEDA