বৈদিক শাস্ত্র পড়ে কি আমার পেটের ক্ষুধা মিটবে? বাদ দাও তো এসব ধর্মজ্ঞান।


"ক্ষুধার চিন্তা সে তো পশুর বৃত্তি 
মনুষ্যের তো আরো উৎকৃষ্ট কৃত্বি"

নমস্কার সকল অমৃতের সন্তানগণ! এ জগতে বহু প্রাণপ্রাচুর্যে সমৃদ্ধ। বহু প্রাণের স্পন্দন ধ্বনিত হয় এ মৃত্তিকা প্রাঙ্গণে। কিছু প্রাণ উদ্ভিদজাত, কিছু প্রাণ স্তন্যপায়ী, আবার কিছু প্রাণ অতিসুক্ষ ধারায় বিরাজমান এই ধরিত্রী বুকে। কিন্তু সকল প্রাণীকুল এক সমানভাবে এই জগতে প্রভাববিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। হাজারো প্রজাতির মধ্যে মনুষ্য জাতি একমাত্র সে সক্ষমতা অর্জনে সফল হয়েছে। যেখানে অন্য প্রাণী বা উদ্ভিদ প্রজাতিসমূহ বেঁচে থাকার সংগ্রামে রত এবং খাদ্য অনুসন্ধানে সর্বদা নিয়োজিত, সেখানে মনুষ্য শুধু খাদ্য সংস্থানে ব্যতিব্যস্ত নয় বরং এ জগতের অজানাকে জানার চেষ্টায় সে সর্বদাই রত। ফলস্বরূপ, জ্ঞান-বিজ্ঞান এর উৎকর্ষ সাধনে মনুষ্য সমাজ আজ অগ্রগামী। 

এরুপ সাফল্য অর্জনে শুধু ক্ষুধা নিবারণের চিন্তায় নিমগ্ন থাকলে কখনো সম্ভবপর হতো না। জ্ঞান অর্জন এবং তাহার উৎকর্ষ সাধনের ফলে আজ বিজ্ঞান সাফল্যের শিখরে আরোহন করেছে। জ্ঞান অর্জন ও তাহার প্রতিপালন ব্যতীত ভিন্ন পন্থা নেই, মনুষ্য জাতির এরুপ উৎকর্ষতা সাধনে। 

বর্তমান সময়ে, আমরা যখন বৈদিক শাস্ত্র প্রচার ও প্রসারে সর্বাত্মক আত্মনিয়োগ করে চলেছি। সেখানে জনৈক ব্যক্তির নিকট বৈদিক শাস্ত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করার প্রয়াস করলে, তাহাদের এরুপ যুক্তি উপস্থাপিত হয় যে , 

"তোমার বৈদিক শাস্ত্র পড়লে আমরা পেটে ভাত পড়বে না বুঝলে! বাদ দাও তো এসব ধর্মজ্ঞান।"

এরুপ বাক্য শুনে আমরা স্তম্ভিত ও ব্যথিত হয়ে উঠি। কারণ, যে শাস্ত্র সমূহ পড়ে পাশ্চাত্য জগৎ আজ প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং আগ্রহের সঙ্গে বৈদিক শাস্ত্রসমূহ তারা নিজ মাতৃভাষায় অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং অর্জন করছে উৎকৃষ্টতার সর্বোচ্চ আসন। সেখানে, বৈদিক শাস্ত্রের এই অমৃত জ্ঞান এর আতুড়ঘর তথা প্রাচীন ঋষিদের উত্তরসূরী হয়ে আমাদের এ কেমন মূর্খতা? কেন সেই উপনিষদ অধ্যয়নে অনিহা যে উপনিষদ পড়ে শোপেনহাওয়ার বলে
"In the world there is no study so beneficial and so elevating as that of the Upanishads. They are the product of the highest wishdom."

[Ausgeht der hochsten weisheit LOC. (cit ll. Page 425]

অর্থাৎ, বিশ্বে এমন কোনো গবেষণা নেই যা উপনিষদগুলোর মতো কার্যকর এবং অগ্রগতির দিকে পরিচালিত করে।

কেন সেই প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ পড়তে অনিহা? যে বেদ পড়ে বিখ্যাত আমেরিকান দার্শনিক উইলিয়াম জেমস বলেছিলেন,

"বেদ হচ্ছে শল্যবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, প্রকৌশল, গণিত, সঙ্গীত, সংস্কৃতি সকল কিছুর মিলিত এক সমাবেশ, যেন এক জীবন্ত বিশ্বকোষ!"

কেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরণা দানকারী গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতা অধ্যয়নে অনিহা? যে শ্রীমদ্ভগবদগীতা  অধ্যয়ন করে Ralph Waldo Emerson বলেছিলেন, 

"I owed a magnificent day to the Bhagavad-Gita. It was as if an empire spoke to us, nothing small or unworthy, but large, serene, consistent,the voice of an old intelligence which in another age and climate had pondered and thus disposed of the same questions which exercise us."

অর্থাৎ, আমি শ্রীমদ্ভগবদগীতার নিকট একটি অসাধারণ দিনের জন্য ঋণী। এ যেন এক সাম্রাজ্য আমাদের সাথে কথা বলে, ছোট বা অযোগ্য কিছুই নয়, বরং বিশাল, নির্মল, সামঞ্জস্যপূর্ণ, এক অতীত বুদ্ধির কণ্ঠস্বর যা অন্য যুগে এবং জলবায়ুতে চিন্তাভাবনা করেছিল এবং এইভাবে একই প্রশ্নগুলির নিষ্পত্তি করেছিল যা আমাদের অনুশীলন করে। 

জ্ঞান এর প্রাধিকার সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে সর্বাগ্রে। ইহার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, বেদ শব্দের উৎপত্তি লক্ষ্য করলে উপলব্ধি হয়। বেদ শব্দটি "বিদ্" ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। "বিদ্" ধাতুর অর্থ - জানা। সেইজন্য বেদ শব্দের ধাতুগত অর্থ - জ্ঞান বা বিদ্যা দুই প্রকার পরা এবং অপরা। অলৌকিক জ্ঞান - পরাবিদ্যা। জাগতিক বিষয় সম্বন্ধীয় যাবতীয় লৌকিক জ্ঞান - অপরা বিদ্যা। পরা ও অপরা এই দুই বিদ্যাই স্থান পেয়েছে সেই জন্য বেদকে সর্ব জ্ঞানের ভান্ডার বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেদের বেদত্ব ওই পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা প্রকাশের জন্য।পরাবিদ্যাই শ্রেষ্ঠ বিদ্যা ।

 "বিদ্‌" ধাতুর চারিপ্রকার অর্থ হয়

 বেত্তি বেদ বিদ্‌ জ্ঞানে,বিন্তে বিদ্‌ বিচারণে।
 বিদ্যতে বিদ্‌ সত্তায়াং, লাভে বিদন্তি বিন্দতে।।

এই চারিপ্রকার অর্থ হইতেছে - জানা, বিচার করা, অবস্থান করা ও লাভ করা। যাহা পাঠ করলে মানুষ সত্য জানিতে পারে, সত্য এবং অসত্যের বিচার করিতে পারে, প্রকৃত বিদ্বান হইতে পারে, প্রকৃত শান্তি এবং আনন্দ লাভ করিতে পারে, তাহার নাম বেদ। 

শ্রীমদ্ভগবদগীতায় জ্ঞানকে সবচেয়ে পবিত্র বলে বর্ণিত হয়েছে, 

न हि ज्ञानेन सदृशं पवित्रमिह विद्यते । तत्स्वयं योगसंसिद्धः कालेनात्मनि विन्दति ॥ ३८ 

"ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে। 
তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি ॥" 
- শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৪/৩৮ 

অর্থাৎ, এই জগতে জ্ঞানের সমান পবিত্রকারী নিঃসন্দেহে কিছুই নেই, উপযুক্ত সময়ে যোগসিদ্ধ মানুষ সেই জ্ঞানকে স্বয়ং নিজের মধ্যে অনুভব করেন।

পবিত্র জ্ঞানই আমাদের অন্ধকাররুপ পাপ থেকে উদ্ধার করে। তাহলে সেই জ্ঞান অর্জন ভিন্ন অপর পন্থা কি হতে পারে? অবশ্যই না! 

अपि चेदसि पापेभ्यः सर्वेभ्यः पापकृत्तमः । 
सर्वं ज्ञानप्लवेनैव वृजिनं सन्तरिष्यसि ॥ ३६ 

"অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ। 
সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি ৷৷"
- শ্রীমদ্ভগবদগীতা  ৪/৩৬

অর্থাৎ, যদি তুমি সকল পাপী থেকেও অধিক পাপকারী হও, তবুও জ্ঞানরূপ নৌকাদ্বারাই সমস্ত পাপরাশি উত্তীর্ণ হবে।

জ্ঞান অর্জন করে কি হবে? এরুপ সংশয়ের নিবারণে যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,

श्रद्धावान्लभते ज्ञानं तत्परः संयतेन्द्रियः। 
ज्ञानं लब्ध्वा परां शान्तिमचिरेणाधिगच्छति ॥ ३९

"শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ। 
জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি ॥"
 - শ্রীমদ্ভগবদগীতা  ৪/৩৯

অর্থাৎ,  সংযত ইন্দ্রিয়, তৎপরায়ণ এবং শ্রদ্ধাবান মানুষ জ্ঞানলাভ করেন, জ্ঞান লাভ করে অচিরেই পরম শান্তি প্রাপ্ত হন।

যাহারা জ্ঞানহীন তাহাদের কি শান্তি প্রাপ্তি হতে পারে? অবশ্যই না! শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে, 

"अज्ञश्चाश्रद्दधानश्च संशयात्मा विनश्यति । 
नायं लोकोऽस्ति न परो न सुखं संशयात्मनः॥" ४०

"অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি। নায়ং লোকোহস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ ॥"  - শ্রীমদ্ভগবদগীতা  ৪/৪০

অর্থাৎ, জ্ঞানহীন, শ্রদ্ধাহীন এবং সংশয়যুক্ত মানুষ পরমার্থ থেকে ভ্রষ্ট হয়; সংশয়যুক্ত মানুষের এই লোকও নেই, পরলোকও নেই এবং সুখও নেই। 

পরিশেষে হে অমৃতের সন্তানগণ! বৈদিক শাস্ত্র অমর জ্ঞানের ভান্ডার। সেই জ্ঞান অর্জন করে পাশ্চাত্য দার্শনিক, লেখক, সমাজবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানীসহ বহু ব্যক্তিত্ব হয়েছে মন্ত্রমুগ্ধ। কিন্তু সেই অমৃত জ্ঞানের ধারক হয়ে, আমরাই যদি সেই অমৃত জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত থাকি তবে আমাদের জন্য অধঃপতনের চূড়ান্ত পরিণতি অপেক্ষা করছে। জ্ঞানহীন কর্ম কখনো অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। মনুষ্য শুধু ক্ষুধা নিবারণের উদ্দেশ্য জন্মায়নি, বরং নিজ মেধা, জ্ঞান অর্জন করে সমগ্র জগতে আলোকদ্যুতি ছড়িয়ে দিতেই তাহার এই ক্ষুদ্র জীবনের পরম উদ্দেশ্য। 

তাই আসুন বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন করি! পুনঃপুন রচনা করি শ্রেষ্ঠত্বের জয়গান।

প্রচারে : VEDA 

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন