পবিত্র বেদের বিজ্ঞান তত্ত্ব পর্ব : ২


▪️ Solar eclipse - সূর্যগ্রহণ:

সূর্য গ্রহণ বা Solar eclipse ধরিত্রীবাসীর নিকট  সৌন্দর্য ও বিস্ময়ের এক মহাজাগতিক ঘটনা। আমরা প্রত্যেকে অবগত যে, চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময় কিছু সময়ের জন্য ধরিত্রী এবং সূর্যের মধ্যে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীতে বসবাসরত সকলের নিকট সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণ রুপে স্বল্প সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এই মহাজাগতিক ঘটনাকে সূর্য গ্রহণ বলে। প্রতিবছর সূর্যগ্রহণ বা Solar eclipse প্রত্যক্ষ করা হয়। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদ, স্যার আর্থার এডিংটন, আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য 29 মে, 1919 সালের সূর্যগ্রহণ তত্ত্ব ব্যবহার করেছিলেন।

সূর্য গ্রহণ সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে বহু কাল ধরে বিভিন্ন কল্পকাহিনী ও রোমাঞ্চ ছড়িয়ে আছে। যেমন প্রাচীন চাইনিজরা মনে করত যে আকাশে এক খারাপ ড্রাগনের বাস।সেই মাঝে মাঝে সূর্য ও চাঁদকে গিলে ফেলে এবং তখন ই গ্রহণ হয়।ভিয়েতনামিরা মনে করত বিশাল আকৃতির ব্যাঙ রয়েছে আকাশে যে সূর্যকে গিলে ফেলার কারনে সূর্যগ্রহণ হয়ে থাকে।মায়া সভ্যতার মানুষেরা মনে করতে বিরাট সাপরুপি এক রাক্ষস সূর্যকে গিলে ফেলে, অন্যদিকে হাঙ্গেরীয় দের কাছে বিরাট পাখীরুপী রাক্ষস, সাইবেরীয়দের কাছে ভাল্লুকরুপী রাক্ষস এবং কোরিয়ানদের কাছে কুকুররুপী রাক্ষসের সূর্যকে গিলে খাবার কারনেই এই গ্রহণ।ভাইকিংদের বিশ্বাসমতে, স্কোল নামের একটি নেকড়ে সূর্য চুরি করে। আর তখনই হয় সূর্যগ্রহণ। কিন্তু ওই নেকড়ে সূর্যকে বেশিক্ষণ রাখতে পারে না নিজের কাছে। কারণ গ্রহণের সময় ভাইকিংসরা নাকি প্রচুর কোলাহল করত। আর সে কোলাহলের শব্দে ভয় পেয়ে ওই নেকড়ে সূর্য ছাড়াই পালিয়ে যেত।আর এভাবেই নেকড়ের কাছ সূর্যকে উদ্ধারও করে অবশ্য ভাইকিংসরা। কিছু পুরাণ ও বৌদ্ধ মতেও কিছু এমন ধরনের গল্প শোনা যায়। কিন্তু অজ্ঞানতা অন্ধকারে আমরা এমনই নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছি যে সূর্য গ্রহণ সম্পর্কে সবচেয়ে আদর্শ ও বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্ব ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বেদ এ রয়েছে তা আমাদের অনেকরই অজানা।
Solar eclipse - সূর্যগ্রহণ:

"অত্রাহ গোরমন্বত নাম ত্বষ্টু রপীচ্যম্। ইত্থা চন্দ্রমসো গৃহে"।।  -ঋগ্বেদ ১/৮৪/১৫                                                                     

অর্থাৎ, গমনশীল চন্দ্রলোকে সূর্য্যের উজ্জ্বল জ্যোতি প্রতিফলিত হয়- এরূপ মানা হয়।

"সোমো বধুযুরভবোদশ্চিনাস্তামুভা চরা। সূর্যা যৎপত্যে সংশন্তো মনসা সবিতাদদাত"।।                                                       -ঋগ্বেদ ১০/৮৫/৯ 📖🌿

অর্থাৎ, এই মন্ত্রে বধুরুপী চন্দ্র এবং বররুপী সূর্যের উপমা দেয়া হচ্ছে যেখানে সবিতা চন্দ্ৰকে আলো উপহার দিচ্ছেন।অর্থাৎ চাঁদের আলো যে সূর্য থেকে প্রাপ্ত তার সুন্দর একটি উপমা সহকারে বর্ণনা পবিত্র বেদে দেয়া হয়েছে।

এখানে আমরা একটি বৈজ্ঞানিক সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি যে সূর্যের আলোয় চন্দ্র আলোকিত হয় এবং চন্দ্রিমার কোনো নিজস্ব আলো নেই। পরবর্তী মন্ত্র সূর্য গ্রহণ এর তত্ত্ব আরো উত্তম ধারণা পাওয়া যায়।
Solar eclipse - সূর্যগ্রহণ:

"যত্ত্বা সূর্য স্বর্ভানুস্তমসাবিধ্যদাসুরঃ ।
অক্ষেত্রবিদ্যথা মুগ্ধো ভুবনান্যদীধয়ুঃ"॥
- ঋগ্বেদ ৫/৪০/৫

[ পণ্ডিত জয়দেব বিদ্যালঙ্কার মীমাংসাতীর্থের ঋগ্বেদ ভাষ্য অনুসারে অনুবাদিত ]

অর্থাৎ, হে সূর্য যাকে তুমি তোমার নিজ আলো উপহার স্বরূপ প্রদান করেছ (চাঁদ), তাঁর দ্বারা যখন তুমি আচ্ছাদিত হয়ে যাও, তখন আকস্মিক অন্ধকারে পৃথিবী ভীত  হয়ে যায় ।

ভাবার্থ : চাঁদের নিজের আলো নেই, এটি সূর্যের আলো দ্বারা আলোকিত হয় । কিন্তু যখন এই চাঁদ পরিভ্রমণরত অবস্থায় পৃথিবীর সাপেক্ষে সেই সূর্যের সাথে একই রেখায় অবস্থান করে,তখন পৃথিবী হতে দেখা যায় চাঁদ তার অন্ধকার পৃষ্ঠ দ্বারা পুরো সূর্যকেই আবৃত করে ফেলছে । সেই সময়ে পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। ফলে তখন পৃথিবী থেকে অসময়ে অন্যান্য নক্ষত্র,যাদের আমরা তারা বলি, সেগুলোও দৃশ্যমান হয়ে যায় । যারা জ্যোতির্বিদ্যা জ্ঞানশূন্য তারা এরূপ সূর্যগ্রহণের মূল কারণ জানতে না পেরে আশ্চর্য হয়ে যায় ৷ অথচ সূর্যগ্রহণ হয় মূলত সেই সূর্যের আলোয় আলোকিত চাঁদেরই কারণে।

▪️ Seven Rays - সপ্তরশ্মি

ইতিহাসের মহানতম বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম যার বুদ্ধিদীপ্ত আবিষ্কার এর ফলে আমরা বর্তমান সময় সূর্যের সপ্ত  রশ্মি এর ধারণা পেয়েছি। বর্তমান সময়ে আমরা সকলে জানি সূর্যের আলো সাত রংয়ের রশ্মির সমন্নয়ে গঠিত। প্রিজমে আলোকরশ্মি ৭ টি ভাগে বিভক্ত হওয়াকে আলোর বিচ্ছুরণ বলে। উক্ত সপ্ত রশ্মির ধারণার উল্লেখও পবিত্র বেদ এ ধ্বনিত হয়েছে বহুবার,

"ত্রিমূর্ধানং সপ্তরশ্মি গৃণীষেহনূনমগ্নিং পিত্রোরুপস্থে।
নিষত্তমস্য চরতো ধ্রুবস্য বিশ্বা দিবো রোচনাপপ্রিবাংসম" ।। - ঋগ্বেদ১/১৪৬/১

অর্থাৎ, ত্রিজগত ব্যাপিত, সপ্তরশ্মিযুক্ত আলোকদাতা ও বিকলতারহিত অগ্নিরূপ পরমাত্মাকে আহ্বান করো । সর্বত্রগামী, অবিচলিত,দ্যোতমান এবং অভীষ্টবর্ষী অগ্নির তেজ চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হইতেছে!

উক্ত সপ্ত রশ্মির ধারণা পুনরায় রয়েছে,
Seven Rays - সপ্তরশ্মি

"সপ্তা ত্বা হরিতো রথে বহন্তি দেব সূর্য।শোচিষ্কেশং বিচক্ষনং"। -ঋগ্বেদ ১/৫০/৮

অর্থাৎ, হে দীপ্তিমান সূর্য হতিৎ নামক সপ্তরশ্নি তোমার জ্যাতিকে বহন করে। জ্যেতিই যেনো তোমার কেশ স্বরুপ।

"অয়ং দ্যাবপৃথিবী বি ষ্কপ্রায়দয়ং রথমযুনক্ সপ্তরশ্মিম্ । অয়ং গোষু শচ্যা পক্কমন্তঃ সোমো দাধার দশয়ন্ত্রমুৎসম্"।। -ঋগ্বেদ ৬/৪৪/২৪

অর্থাৎ, এ দিব্য শক্তি দ্যু ও পৃথিবী লোককে স্ব স্ব স্থানে সংস্থাপিত করিয়াছেন । এ দিব্য শক্তি সূর্যের সপ্তরশ্মিময় রথ যোজিত করিয়াছেন । এ দিব্যশক্তি স্বেচ্ছানুসারে ধেণুগনের মধ্যে পরিণত দুগ্ধের উৎস স্থাপন করিয়াছেন ।

আশ্চর্য হলেও সত্য সনাতন ধর্ম ও বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যপূর্ণতা। ধর্মই যেন বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয় এবং অনুপ্রেরণা।

▪️ Water Cycle - জলচক্র

জলচক্র বা Water Cycle হল প্রাকৃতিক প্রভাবে ক্রমাগত রূপান্তরের মাধ্যমে জল-এর চক্রাকারে তথা ক্রমাগত সঞ্চারণশীলতা। এই চক্রকে হাইড্রলজিক্যাল চক্র বা H2O চক্র বলা হয়। এই জলচক্রের জন্যেই পৃথিবীতে জলের সামঞ্জস্য ব্যাহত হয় না। জলচক্র আবিষ্কারক হিসেবে Bernard Palissy এর সবার অগ্রভাগে আসে। তিনি ১৫৮০ শতকে আধুনিক সময়ে জলচক্র ধারণা নিয়ে আসেন সবার সম্মুখে। তবে উক্ত জলচক্রের ধারণা পবিত্র অথর্ববেদ এর কান্ড ০৪, সুক্ত ১৫, মন্ত্র ০৫ এ বলা হয়েছে,

Water Cycle - জলচক্র:

"উদীরয়ত মরুতঃ সুমুদ্রেতস্ত্বেষো অর্কো নভ উত্পাংতয়াত। মহঋষভস্য নদেংতো নর্ভস্বতো বাশ্ত্রা আপঃ পৃথিবীং তর্পয়ন্তু"।। -অথর্ববেদ ৪/১৫/৫

অর্থাৎ, সূর্যের আলোতে বাষ্পীভূত হওয়া এই সমূদ্রের জল বাতাসের মাধ্যমে আকাশে উত্তোলিত হোক এবং গর্জনশীল মেঘ হতে ঘনিভূত হইয়া বৃষ্টির জল প্রবলভাবে বর্ষিত হয়ে পৃথিবীকে পরিতৃপ্ত করুক।

এরুপ জলচক্রের পূর্ণ ধারণা ঋগ্বেদ ১ম মন্ডল, ২৩তম সুক্তের ১৭নং মন্ত্রেও রয়েছে,

"ॐ अ॒मूर्या उप॒ सूर्ये॒ याभि॑र्वा॒ सूर्यः॑ स॒ह।
ता नो॑ हिन्वन्त्वध्व॒रम्॥"

"ও৩ম্ অমূর্য়া উপ সূর্য়ে য়াথির্বা সূর্য়্যঃ সহ।
তা নো হিন্বন্ত্বধ্বরম্।।" ঋগ্বেদ ১/২৩/১৭

সরলার্থ: যে জল দৃষ্টিগোচর হয় না, সূর্য বা ইহার প্রকাশের মাধ্যমে বর্তমান অথবা যে জলের সহিত সূর্যলোকে বর্তমান তাহা আমাদের হিংসারহিত সুখরুপ যজ্ঞকে প্রত্যক্ষ সিদ্ধ করেন।

ভাবার্থ: যে জল পৃথিবী আদি মূর্তিমান পদার্থ হইতে সূর্য কিরণ পড়িয়া ছিন্ন ভিন্ন অর্থাৎ ক্ষুদ্র বিন্দু বিন্দু হইয়া সূর্যের ন্যায় উর্ধ্বে বিচরণ করেন, সেই বাষ্প হইতে বৃষ্টি হইয়া ভূমিতে পতিত হইয়া পান আদি ব্যবহার বা বিমান আদি যানে যথার্থ প্রকার সংযুক্ত করিয়া সুখ বৃদ্ধি করেন।

উপরিউক্ত মন্ত্র বিশ্লেষণ করে আমরা উপলব্ধি করতে পারি ইহাই সে জলচক্রের ধারণা যা Bernard Palissy আধুনিক সময়ে এসে পুনঃ ধারণা দেন।


তাই হে অমৃতের সন্তানগণ। পবিত্র বেদ সমগ্র জগতের জ্ঞানের আধার। আমরা যদি সেই বেদ অধ্যয়ন করে জ্ঞান প্রাপ্ত করি তাহা আমাদেরই শ্রেষ্ঠ করে তুলবে। তাই আসুন অধ্যয়ন করি বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র।


▪️"বেদ ও বিমানবিদ্যা"

মনুষ্য এ জগতে বিচরণ খুব প্রাচীন নয়। পৃথিবী সৃষ্টির বহু পরে বিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মনুষ্যের ক্রমবিকাশ হয়েছে। মনুষ্যের পূর্ণবিকাশ লাভের পর আদিম বর্বর বন্যদশা থেকে সভ্যতার দিকে অগ্রসরমান হয়েছে। অজানাকে জানার অদম্য মনোভাব মনুষ্যকে সর্বদা তাড়না দিয়েছে। ফলস্বরূপ, একদা শিকারী হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতি হিসেবে সুপরিচিত মনুষ্য সমাজ স্থান করে নিয়েছে জ্ঞান, বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের ধারক, প্রাণীকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে। মহাবিশ্বের বিশালতা থেকে সমুদ্র অতল গহ্বরে লুকায়িত রহস্য উন্মোচন করে চলেছে প্রতিনিয়ত। যন্ত্রচালিত যানবাহন যেমন নির্মাণ করে এনেছে শিল্প বিপ্লব, তেমনি মহাবিশ্বের পথে পাড়ি দিয়ে করেছে অসম্ভবকে সম্ভব।

বিজ্ঞানে জয়যাত্রায় বহু আবিষ্কার এনেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন, জীবনকে করেছে সহজ ও আধুনিক। সেই সকল আধুনিক আবিষ্কার এর মধ্যে বিমান আবিষ্কার সবথেকে অনবদ্য আবিষ্কার হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বর্তমান সূত্র অনুসারে, রাইট ভ্রাতৃদ্বয় এর মাধ্যমে আধুনিক বিশ্ব বিমান যাত্রার যুগে প্রবেশ করে
অরভিল রাইট এবং উইলবার  ছিলেন দু'জন মার্কিন প্রকৌশলী ভ্রাতার যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম নিয়ন্ত্রিত, শক্তিসম্পন্ন এবং বাতাসের চাইতে ভারী সুস্থিত মানুষ-বহনযোগ্য উড়োজাহাজ তৈরি করেন।

কিন্তু বিমান চালনার ইতিহাস রাইট ব্রাদার্স এর চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন ও সুগভীর। পরাধীন ভারতে ১৮৬৪ সালে মহারাষ্ট্রের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এ অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তি। নাম তার শিবকর বাপুজী তালপাড়ে। তিনি  জামশেদজী জিজিভাই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তার  শিক্ষক চিরঞ্জীলাল ভার্মার দ্বারা পবিত্র বেদ ও বৈদিক শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত হয় এবং এর নিমিত্তে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বেদ ভাষ্য দ্বারা প্রভাবিত হন এবং প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নে প্রয়াস করেন। তিনি ঋষি ভরদ্বাজের লিখিত বিমান শাস্ত্র অধ্যয়ন শুরু করেন এবং বৈদিক সংস্কৃতও শেখেন। পরবর্তীতে বহু প্রচেষ্টার ফলে ১৮৯৫সালে তৈরি করেন বিমান, নাম দেন " মরুতসখা "। 

কিন্তু বিমানবিদ্যার ইতিহাস এর চেয়ে প্রাচীন ও সুসংবদ্ধ। "বিমান" শব্দের উল্লেখ বৈদিক সংস্কৃত মন্ত্রেই বিদ্যমান। আমাদের প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ বাল্মিকী রামায়ণে আমরা "পুষ্পক বিমান" এর উল্লেখ পাই, এছাড়াও মহাভারতের শান্তিপর্বেও আকাশযান এর উল্লেখ রয়েছে,

তত্ সুপর্ণাকরিথমাস্থিতৎ বৈষ্ণবৎ পদম্। ভাভিরপ্রতিমৎ ভাতি ত্রৈলোক্যমবভীসয়ত্।।
- মহাভারত, শান্তিপর্ব-২২৮/১৩

অর্থাৎ, সেই প্রভাপুঞ্জ ভগবান বিষ্ণুর [মহর্ষি বিষ্ণুর] একটি বিমান ছিল, যা নিজ দিব্য প্রভা দ্বারা তিন লোককেই প্রকাশিত করার ন্যায় অনুপম যাতায়াত করতে পারতো। সূর্য এবং গড়ুর যে আকাশ মার্গে চলে, সেই আকাশ মার্গে সেই বিমানটিও চলতো।

বিমানবিদ্যা শুধুমাত্র ঐতিহাসিক গ্রন্থ সমূহে সীমাবদ্ধ নয় বরং প্রাচীন ঋষিগণ বিমানবিদ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ও বিবিধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ঋষি ভরদ্বাজ সেই বিমানবিদ্যার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। তার রচিত "বৈমানিক শাস্ত্র" ও "যন্ত্র সর্বস্ব" গ্রন্থদ্বয়ে বিবিধ প্রকারের বিমান, তাহার জ্বালানি সম্পর্কে আলোচনা করেন।

অর্থাৎ বিমানবিদ্যার সহিত সনাতনধর্ম শাস্ত্রের সম্পর্ক যথেষ্ট প্রাচীন ও সুগভীর। কিন্তু এই সুগভীরতা লাভ করেছে, কারণ সনাতনধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ সেই বিজ্ঞানের সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী গ্রন্থ। সৃষ্টিতত্ত্ব, সালোকসংশ্লেষণ, জলচক্র, সপ্ত রশ্মির মতো বিমানবিদ্যা স্থান পেয়েছে বেদমন্ত্র এর মধ্যে। বেদের সেই অমৃত জ্ঞান জানার প্রয়াস করি তবে,

ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ২২তম সুক্তের ২য় মন্ত্রে বলা হয়েছে,

"ও৩ম্ যা সুরথা রথীতমোভা দেবা দিবিস্পৃশা।
  অশ্বীনা তা হবামহে।।" - ঋগ্বেদ ১/২২/২

অর্থাৎ, পরমাত্মা উত্তম রথের নির্মাতা! তিনি জল ও অগ্নীর ন্যায় পবিত্র। তাঁকে যজ্ঞে আহ্বান করি। যিনি প্রশংশনীয় রথ নির্মাতা মনুষ্যগণকে সৃষ্ট করেছেন। তারা এমন রথ নির্মাণ করে যা আকাশ মার্গ দ্বারা এক স্থান  হতে অন্য স্থানে শীঘ্র গমনশীল।

ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ২২তম সুক্তের ১৪তম মন্ত্রে পুনরায় বলা হয়েছে,

"ও৩ম্ তয়োরিদ্ ঘৃতবত্পয়ো বিপ্রা রিহন্তি ধীতিভিঃ। গন্ধর্বস্য ধ্রুবে পদে।।" - ঋগ্বেদ ১/২২/১৪

অর্থাৎ, যে বুদ্ধিমান পুরুষ যাহা হইতে প্রশংশনীয় হয়, সেই প্রকাশময় এবং অপ্রকাশময় লোককে ধারণ এবং আকর্ষণ আদি গুন দ্বারা পৃথিবীর ধারণকারী বায়ু যে সর্বত্র বিদ্যমান নিশ্চল অন্তরিক্ষ স্থান আছে, তাহাতে বিমান আদি যানে গমনাগমন করেন এবং প্রশংসিত হইয়া উক্ত লোকেই আশ্রয় লইয়া প্রশংশনীয় জলময় রসাদি পদার্থকে গ্রহণ করেন।

ভাবার্থ: বিদ্বানের পৃথিবী আদি পদার্থ দ্বারা বিমান আদি যান নির্মাণ করিয়া তাহার কৌশলে জল এবং অগ্নীর প্রয়োগ দ্বারা ভূমি, সমুদ্র এবং আকাশে যাওয়া আসা করা উচিত।

ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ১৮৩তম সুক্তের ১ম মন্ত্রেও বিমান সম্পর্কে বলা হয়েছে,

"ত্বং যুঞ্জাথাং মনোসো যো জবীয়ান ত্রিবন্ধরো বৃষণা যস্ত্রিচক্র।
যেনোপয়াথঃ সুকৃতাদুরোনাং ত্রিধাতুনা পতোযো বির্ণ পণৈঃ।।" - ঋগ্বেদ ১/১৮৩/১

অর্থাৎ, হে শিল্পবিদ্যা মনুষ্যগণ! যে রথ মনের গতি অপেক্ষাও অধিক গতিশীল, যার তিনটি বন্ধুর ন্যায় চক্র আছে। যা সুফলদায়ী ও তিনপ্রকার ধাতু বিশিষ্ট, পক্ষি স্বরূপ পক্ষ বলে আকাশপথে এখান হইতে ওখানে যাতায়াত করতে পারে। সে রথে আরোহণ করে তোমরা সেইরূপ অতিদ্রুততার সহিত সুকৃতকারীর গৃহে যাও। সে রথ যোজনা কর।

ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ৩৮তম সুক্তের ১২তম মন্ত্রে পুনরায় বলা হয়েছে,

"ও৩ম্ স্থিরা বঃ সন্তু নেময়ো রথা অশ্বাস এষাম্।
সুসংস্কৃতা অভীশবঃ।।" - ঋগ্বেদ ১/৩৮/১২

অর্থাৎ, হে বিদ্বান! তোমাদের এই পবনের নিকট হইতে উত্তম শিল্পবিদ্যা দ্বারা সংস্কার হইয়া কলা চক্রযুক্ত (রথাঃ) বিমান আদি রথ, মার্গে (পথে) ব্যাপ্তকারী অগ্নি আদি বা অশ্বের সদৃশ দৃঢ় বলযুক্ত হইবে (শত্রুদের দূর্বল বা পরাজিত করতে)।

ঋগ্বেদ এ আরো মন্ত্রে আমরা বিমান সম্পর্কে ধারণা লাভ করি,

"অনশ্বো জাতো অনভিশু রকথ্যে রথস্ত্রিচক্রঃ
পরিবর্তে রজঃ মহত্তদ্বো দেবস্য প্রবাচনং
দ্যামৃভবঃ পৃথিবীং যচ্ছ পূষ্যথ।।" - ঋগ্বেদ ৪।৩৬।১

অর্থাৎ, হে রথ নির্মাতা মনুষ্যগণ! তোমাদের নির্মিত প্রশংসনীয় রথ অশ্ববিহীন, লাগামহীন, তিনচক্র বিশিষ্ট এবং আকাশে ভ্রমণকারী।তোমাদের এই দিব্য সুখ্যাতিযোগ্য মহান কর্মদ্বারা অন্তরিক্ষ ও পৃথিবী উভয়ই পুষ্ট হয়।

শুধু ঋগ্বেদে নয়, বরং সামবেদে বিমানবিদ্যা সম্পর্কে বলা,

"প্রতি প্রিয়তমং রথং বৃষণং বসুবাহনম্‌॥
স্তোতা বামশ্বিনাবৃষিঃ স্তোমেভির্ভূষতি প্রতি মাধ্বী মম শ্রুতং হবম্‌॥" -সামবেদ ৪১৮

অর্থাৎ, হে রথের নির্মাতা আর চালক শিল্পীজন! অতিশয় প্রিয়, শত্রুসেনার ওপর শস্ত্রাস্ত্রসমূহের বর্ষণের সাধনভূত, ধন ধান্য ইত্যাদিকে দেশান্তরে পৌঁছে দেয়া বিমানাদি যানকে তোমাদের প্রশংসক বিদ্বান মানব দেশান্তরে নিয়ে যাওয়াকারী পদার্থসমূহ দ্বারা অলঙ্কৃত করেন। হে মধুর গতিবিদ্যা জানা শিল্পীগণ! তোমরা আমার বিমানাদি যানের নির্মাণ করা তথা এগুলোকে চালানোর বিষয়ক আহ্বানকে পূর্ণ করো ॥

ভাবার্থঃ সকল মানবের এমন কর্ম করা উচিত, যাতে পুনর্জন্মে মানবশরীরই প্রাপ্ত হয়। এভাবেই রাষ্ট্রে শিল্পবিদ্যার উন্নতি দ্বারা বেগবান্ ভূমি সম্বন্ধ, জলযান আর অন্তরিক্ষ্যান বানানো উচিত আর দেশান্তরগমন, ব্যাপার, যুদ্ধ ইত্যাদিতে প্রয়োগ করা
উচিত ॥

আরো বহুবিধ মন্ত্র রয়েছে যেখানে বিমানবিদ্যার উল্লেখ রয়েছে।

হে অমৃতের সন্তানগণ! বেদ অপার জ্ঞানের ভান্ডার। আমরা আমাদের শিকড় থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলে বেদের অমৃত জ্ঞান থেকে দূরে। বেদে সকল প্রকার জ্ঞানের উপস্থিতি রয়েছে। তাই আমাদের সকলের উচিত সেই অমৃত জ্ঞান অর্জন করে পুনরায় জগতে জৌতি ছড়িয়ে দেওয়া।

✍️ প্রচারে : VEDA 

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন