আমাদের কেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা উচিত?


আমাদের কেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা উচিত? 

এ জগত সুন্দর, অদ্ভুত এবং জটিল। যেন কোনো সুনিপুণ কারিগরের অপরুপ নিখুঁত সৃষ্টি, যা অনুসরণ করে চলেছে এক শাশ্বত সুশৃঙ্খল নিয়ম। কোনো বিঘ্ন কিংবা বিশৃঙ্খলতার অবকাশ নেই। মহাবিশ্ব যেন ক্রমান্বয়ে তার পরিণতির দিকে অগ্রসরমান হয়ে চলছে। শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়ে পুনরায় সেই শূন্যে লীন হয়ে যায় এবং পুনঃপুন সৃষ্টি সংগঠিত হয়। 

সভ্যতার আদিকাল থেকেই এ জগত সম্পর্কে মনুষ্যের কৌতূহল সর্বোপরি। এ জগতের অজানাকে জানার জন্য, সৃষ্টি রহস্যকে ভেদ করার উদ্দেশ্য এবং জগতের জটিলতাকে জানতে সর্বদাই প্রচেষ্টারত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, দার্শনিকদের সুগভীর চিন্তা জগতের রহস্য উদঘাটনে অবদান রেখেছে এবং সেই চেষ্টা এখনো চলমান। সেই জন্য Mary Catherine Bateson বলেছিলেন, 

"We are not what we know but what we are willing to learn."

মনুষ্যের সুগভীর চিন্তা জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংশয় ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত ধারণা। এ সুবিশাল, নিখুঁত, জটিল, সুশৃঙ্খল জগতের কি কোনো স্রষ্টা, পরিচালক, সর্বময় কর্তা বিদ্যমান রয়েছে নাকি এ জগৎ সত্যি প্রকৃতির অন্তহীন সৃষ্টি চক্রের এক অংশবিশেষ মাত্র। 

সেই সংশয় নিবারণে কিছু যৌক্তিক, বৌদ্ধিক এবং বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা প্রয়োজন। 

ঈশ্বর এর অস্তিত্ব অবশ্যই রয়েছে। ইহার শাস্ত্রীয় প্রমাণ আমাদের নিকট উপলব্ধ কিন্তু কতিপয় ব্যক্তির নিকট এরুপ সত্য যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক উপাায়ে প্রমাণ করা আবশ্যক। 

শাস্ত্রীয় প্রমাণ:

সনাতনধর্মের শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রে পরমাত্মার সম্পর্কে রয়েছে বিবিধ আলোচনা এবং সংশয় নিবারণ এর প্রচেষ্টা। 

ঋগ্বেদ ১/১/৫ ও ঋগ্বেদ ১/১/৪ অনুসারে এ জগতের স্রষ্টা ও রক্ষক হিসেবে পরমাত্মাকে বলা হয়েছে।

যজুর্বেদ এ পরমাত্মার স্বরুপ সম্পর্কে বলা হয়েছে, 

"স পৰ্য্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্ কবিৰ্মনীষ। 
পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোহর্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ" ।। - যজুর্বেদ ৪০/৮

অর্থাৎ, পরমাত্মা সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান, শরীর রহিত, রোগ রহিত, জন্ম রহিত, শুদ্ধ, নিষ্পাপ, সর্বজ্ঞ, অন্তর্যামী, দুষ্টের দমন কর্তা ও অনাদি। তিনি তাহার শাশ্বত জীবের জন্য যথাযথ ফলের বিধান করেন।

যোগদর্শনে পরমাত্মাকে এই জড় জগত থেকে ভিন্ন এক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, 

যোগদর্শনে ঈশ্বর সম্পর্কে বলা হয়েছে 
"ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ"  -যোগদর্শন ১/২৪

অর্থাৎ, অবিদ্যাদি পঞ্চ ক্লেশ, শুভ, অশুভ ,মিশ্র কর্ম, বিপাক বা কর্মফল, আশয় বা সুখ-দুঃখ ভোগের সংস্কার; এই সকল হতে সম্বন্ধ রহিত এবং জীব হতে ভিন্ন স্বভাবযুক্ত চেতন সত্তা বিশেষকে 'ঈশ্বর' বলা হয়।

পরমাত্মার স্বরুপ ব্যাখ্যায় যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, 

"জ্যােতিষামপি তজ্জ্যােতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে।
জ্ঞানঃ জ্ঞায়ং জ্ঞানগ্যমং হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম্।।"
-গীতা ১৩/১৭ 

অর্থাৎ, তিনি ( ঈশ্বর) জ্যােতিঃসকলেরও জ্যােতি, তিনি অবিদ্যারুপ অন্ধকারের অতীত,তিনি বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রকাশমান জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয় তত্ত্ব, তিনি জ্ঞানের দ্বারা লভ্য, তিনি সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আছেন।

শাস্ত্রীয় বহু প্রমাণাদি দ্বারা পরমাত্মার অস্তিত্ব প্রতিপন্ন করা সম্ভবপর হলেও সংশয়ীদের প্রয়োজন যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ। সেজন্য আমরা তিনটি প্রচলিত সংশয় বা প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনা করবো।

➡️ পরমাত্মা কি করে এ জগৎ সৃষ্টি করলেন⁉️
➡️ কি থেকে সৃষ্টি এ জগৎ করলেন⁉️ 
➡️ কি উদ্দেশ্য এ জগৎ সৃষ্টি করলেন⁉️ 

ত্রিবিধ সংশয় নিরসনের পূর্বে আমাদের জানতে হবে জগতে বিদ্যমান অনাদি সত্তা সমূহ সম্পর্কে। 

এই জগতে তিনটি অনাদি সত্তা রয়েছে; (১) প্রকৃতি (২) জীবাত্মা এবং (৩) পরমাত্মা। এই তিনটি অনাদি সত্তার মধ্যে প্রকৃতি ভোগ্য(উপাদান কারণ), জীবাত্মা ভোক্তা (সাধারণ কারণ) এবং পরমাত্মা অভোক্তা (নিমিত্ত কারণ)। নিমিত্ত কারণ হল কর্তা (who) , উপাদান কারণ কর্ম (what), সাধারণ কারণ হল কার জন্য (why)।

এই ত্রিবিধ সত্তাকে স্বীকার করার কারণ বিদ্যমান ও আবশ্যক। জগত শূন্য হতে নির্মাণ হতে পারে না, জগত নিজে থেকে সৃষ্টি হতে পারে না, কার্যকারণ তত্ত্ব অনুসারে কোনো কারণ ব্যতীত কোনো কার্য হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, কুম্ভকার যেমন মৃত্তিকারূপ উপাদানের সাহায্যে ঘট নির্মাণ করেন, ঈশ্বরও তেমনি প্রকৃতি রুপ উপাদান কারণের সহায়তায় এ জগৎ সৃষ্টি করেন। কিন্তু পরমাত্মা কামনারহিত, পূর্ণ ও আনন্দের উৎস। এ জগতের নির্মাণ এর কেন যেহেতু তার কোনো অভাব নেই। সদুত্তর হলো, জীবাত্মার ভোগের উদ্দেশ্যে ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সহজভাবে বললে জীবের মোক্ষপ্রাপ্তির পথ সুগম করতেই ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ  অনাদি প্রকৃতিকে অনাদি জীবাত্মা ভোগ করে। সেজন্য, জীবাত্মাকে সাধারণ কারণ বলা হয়েছে। 

এরুপ ধারণাকে ভিত্তি প্রদান করা হয়েছে যোগদর্শনে, 

সূত্র - তদর্থ এব দৃশ্যস্যা ঽঽত্মা। (যোগ দর্শন ২।২১)

শব্দার্থ - (তদ্-অর্থঃ) ওই জীবাত্মার ভােগ এবং অপবর্গের জন্য (এব) অবশ্যই (দৃশ্যস্য) দৃশ্যের (আত্মা) স্বরূপ হয়।

সূত্ৰাৰ্থ - দৃশ্যের স্বরূপ জীবাত্মার ভােগ ও অপবর্গকে সিদ্ধ করার জন্য হয়।

ব্যাখ্যা - এই সূত্রে দৃশ্যের কী প্রয়ােজন; সেই বিষয়ে বলা হয়েছে এই দৃশ্যের রচনা ঈশ্বর, যাতে জীবাত্মা ভােগ এবং অপবর্গ রূপ প্রয়ােজনকে সিদ্ধ করতে পারে সেই জন্য করেছেন। এই সংসারে তিনটি পদার্থ রয়েছে ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি। ঈশ্বর সকল কামনা হতে রহিত; তাই তাঁর কাছে এই দৃশ্যের কোনাে প্রয়ােজন নাই। প্রকৃতি একটি জড়পদার্থ হওয়ায় সে নিজেকে স্বয়ং ভােগ করতে পারে না। কিন্তু জীবাত্মার নিজস্ব কোনাে আনন্দ না থাকায় সে এই দৃশ্যকে ভােগ করে। [যোগ দর্শন ভাষ্য- আচার্য কপিল আর্য]

উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, উপাদান ব্যতীত বস্তু নির্মাণ হতে পারে না, কর্তা ব্যতীত সেই উপাদান ব্যবহার করে বস্তু নির্মাণ হতে পারে না, উদ্দেশ্য ব্যতীত বস্তু নির্মাণ হতে পারে না। 

ইহা দ্বারা সিদ্ধ যে পরমাত্মাই এ জগৎ প্রকৃতি রুপ উপাদান কারণ হতে সৃষ্টি করেছেন, জীবাত্মার মোক্ষ অর্জনের পথ সুগম করার উদ্দেশ্যে। অতএব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার্য।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার ক্ষেত্রে সংশয়ীগণ এরুপ আরোপ করে থাকে যে, যাহা উপলব্ধি হয় না, নিরীক্ষণ করা সম্ভব নয় তাহার অস্তিত্ব স্বীকার করা অন্ধবিশ্বাস নয় কি ⁉️

আমাদের চক্ষু থাকিলে সবকিছু দেখতে পারি এমন নয়, কিংবা কর্ণ থাকলে শুনতে পারি এমনও নয়। অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়ের রয়েছে সীমাবদ্ধতা। অতি সুক্ষ বস্তু চক্ষু প্রত্যক্ষ করতে পারে না, তেমনি নির্দিষ্ট শব্দ সীমার নিচে কোনো শব্দ কর্ণ শুনতে পারে না। কিন্তু এমন নয় যে প্রত্যক্ষ না করতে পারলেই তার অস্তিত্ব নেই। 

তাহলে সেই অতীব, সুক্ষ, সর্বব্যাপী পরমাত্মার উপলব্ধি  এই স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন ইন্দ্রিয় দ্বারা কি করে সম্ভব ⁉️

যাহারা এরুপ ইন্দ্রিয় দ্বারা পরমাত্মার উপলব্ধি না করতে পেরে মনে নিরীশ্বরবাদী ধারণার বীজ বপন করেন তাদের উদ্দেশ্যে উপনিষদে ঋষি পূর্বেই বলেছেন,

"ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রুপমস্য ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনম্। হৃদা হৃদিস্থং  মনসা  য এনমেবং  বিদুরমৃতাস্তে  ভবন্তি।।" - শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/২০

অর্থাৎ, এই পরমেশ্বরের স্বরূপ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, কেহই ইঁহাকে চক্ষু দ্বারা দর্শন করিতে পারেনা। হৃদয়গুহায় অবস্থিত এই পরমেশ্বরকে যাঁহারা অনুভূতি ও মনন দ্বারা জানিতে পারেন, তাঁহারাই মোক্ষলাভ করেন।

যিনি সমগ্র জগৎকে দৃষ্টি প্রদান করেন, তাহাকে উপলব্ধি করতে চর্ম চক্ষু নয়, জ্ঞান চক্ষু প্রয়োজন। সেজন্য উপনিষদ বলেছে,

"য়চ্চক্ষুষা ন পশ্যতি য়েন চক্ষূংষি পশ্যতি।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে ॥"
-কেনোপনিষদ ১/৬

অর্থাৎ, যাঁকে চক্ষু দ্বারা কেউ দেখতে পারে না, বরং যাঁর সামর্থ্য দ্বারা সকল চক্ষু নিজ বিষয়সমূহ দেখে থাকে, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানো। এই যে চক্ষু দ্বারা দৃষ্ট মূর্ত-জগৎ, যাকে মানুষ উপাসনা করে; এটি ব্রহ্ম নয়।

তাই চক্ষু না থাকিলে যেমন আলো দৃষ্ট হয় না, তেমনি প্রমা(যথার্থ জ্ঞান) না থাকিলে পরমাত্মার উপলব্ধি হয় না।

"পরমাত্মা অধার্মিকের দৃষ্টি হইতে বহুদূরে এবং তিনিই ধার্মিকের দৃষ্টিতে অতি নিকটে" - যজুর্বেদ ৪০/৫

এরুপ বিশ্লেষণ এর পরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয় কোনো সংশয় অবশিষ্ট থাকতে পারে না। কিন্তু সংশয়ীদের সংশয় নিবারণ হলেও বিরোধিতা করার মনোবাঞ্ছা কখনো শেষ হওয়ার নয়। পরিশেষে এরুপ মন্তব্য উপস্থাপন করে থাকে যে, 

ঈশ্বরে বিশ্বাস করিবার প্রয়োজন কি? যেখানে ঈশ্বরের প্রতি কোনো রুপ আস্থা না রেখে মনুষ্য ভালো থাকতে পারে ⁉️

ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য সত্য। তাই কেউ যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে জেনেও তা অস্বীকার করে তবে তাহার এরুপ চিন্তা কি অধর্ম নয়? 

উদাহরণস্বরূপ, আমাদের গৃহে পিতা/মাতা আমাদের ভরণপোষণ, লালনপালন, সুরক্ষা প্রদান করেন। আমরা সেই সকল কিছু পিতা-মাতার নিকট থেকে প্রাপ্ত করেও যদি তাহাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করি তবে আমরা কি ন্যায় করবো নাকি অন্যায়? অবশ্যই নৈতিকতার মানদন্ড ইহা অন্যায়। তবে এই জগতের পালক,সৃষ্টির রচয়িতা, ব্রহ্মান্ডের পরিচালনাকারী, সর্বশক্তিমান পরমপিতা পরমেশ্বরকে অস্বীকার করি তবে আমরা কি নিজেদের ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করছি না ⁉️

তাই হে অমৃতের সন্তানগণ! এ জগতের রচয়িতা পরমাত্মা। তিনি আমাদের মোক্ষ অর্জনের নিমিত্তে এই জগতের নির্মাণ করেছেন। আমাদের উচিত সেই পরমাত্মার সান্নিধ্যে লাভের প্রয়াস করা এবং জীবনের অন্তিম লক্ষ্য মোক্ষ অর্জনের পথে অগ্রবর্তী হওয়া।

✍️VEDA

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন