" বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অবঃ) চিত্তরঞ্জন দত্ত ও মুক্তিযুদ্ধ"
➡️ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একমাত্র বাঙালি হিন্দু অফিসার, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার, সংগঠক, বাংলাদেশ রাইফেলস এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল।
✨ মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু ✨
একজন মনুষ্যকে তার উৎকৃষ্টতার রুপরেখা প্রদান করে ধর্মই। সেই উৎকৃষ্টতার সর্বোত্তম গুণ দেশপ্রেম। দেশপ্রেম একজন সুনাগরিকের ধর্ম। যে ভূমিতে জন্ম ও বেড়ে উঠা সেই মাতৃভূমির প্রতি প্রত্যেকের রয়েছে এক দায়িত্ববোধ। সেজন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
"বিশ্বস্বং মাতরমমোষাধীনাং ধ্রুবাং ভূমিং পৃথিবীং ধর্মণা ধৃতাম্। শিবাং স্যোনামনু চরেম বিশ্ব-হা"।।
-অথর্ববেদ ১২/১/১৭
অর্থাৎ, ওষুধি সমূহের মাতা, কল্যাণকারিণী ,
সুখদায়িনী, ধর্মকর্ত্তৃক ধৃতা এই স্থির ও বিস্তৃত
মাতৃভূমিকে সর্বস্ব অর্পণ করিয়া সর্বদা সেবা করিব।
বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি। সেই মাতৃভূমির প্রতি রয়েছে দায়িত্ব এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রয়েছে ত্যাগের ইতিহাস। এ ভূমির স্বাধীনতার ইতিহাস সুদীর্ঘ। বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম কিংবা বর্বর পাকিস্তানের দখলদারিত্বের শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে পুনরায় স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবময় ইতিহাস, ভূমিপুত্রদের ত্যাগ সর্বাত্মক। সেই ভূমিপুত্রদের একজন মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অবঃ) শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম।
✨ শৈশবকাল: ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত মেঘালয়ের শিলংয়ে পহেলা জানুয়ারি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্ত। পিতা উপেন্দ্রচন্দ্র দত্ত ছিলেন পুলিশ অফিসার। সেজন্য বাবার চাকরি সূত্রে শৈশব শিলংয়েই কাটে। চিত্তরঞ্জন দত্তের ডাকনাম ছিল রাখাল। শৈশব থেকেই অত্যন্ত প্রতিভাশালী ফুটবলার ছিলেন এবং সুবিখ্যাত মোহনবাগান দলের হয়েও খেলেছিলেন। শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্তের পৈতৃক ভিটা ছিল হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার মিরাশি গ্রামে । ঠাকুরদা ছিলেন চুনারুঘাট এলাকার এক খ্যাতিমান জমিদার।
✨ শিক্ষা জীবন: মেঘালয়ের শিলং থেকে এসে ভর্তি হন, হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে। ১৯৪৩ সালে এ স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিক (SSC) পাশ করেন। পরবর্তীতে ইন্টারমিডিয়েট (HSC) পড়তে কলকাতার বিখ্যাত আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তিনি পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। পরবর্তীতে এসে ভর্তি হন খুলনার দৌলতপুরে অবস্থিত ব্রজলাল কলেজে। ব্রজলাল কলেজ থেকেই পর্যায়ক্রমে আইএসসি ও বিএসসি পাস করেন।
✨ কর্মজীবন: শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্ত ১৯৫১ সালে তৎকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন৷ কিছুদিন পর 'সেকেন্ড লেফটেনেন্ট' পদে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন৷ সেই ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন এবং যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে৷ তিনি সেই সময়ে একমাত্র বাঙালি হিন্দু আর্মি অফিসার ছিলেন।
✨ মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত দূরদর্শী সেক্টর কমান্ডার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেব দায়িত্ব দেয়া হয় এম.এ.জি ওসমানীকে। বাংলাদশকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন৷ সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়স্তাগঞ্জ রেল লাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে ৪নং সেক্টর গঠন করা হয়। দেশপ্রেমের অগাধ চেতনা নিয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধে। ০৪ নং সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন চিত্তরঞ্জন দত্ত। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য তিনি 'বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত হন।
✨ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশসেবা: মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও তিনি দেশগঠনে অনন্য অবদান রাখেন। ১৯৭২ সালে তিনি রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন৷ সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন৷ বর্তমান সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এর সূত্রপাত হয়েছিলো চিত্তরঞ্জন দত্তের হাত ধরে। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার৷ এই বিষয়ে চিত্তরঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেয় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার৷ পরবর্তীতে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নামকরণ করেন বাংলাদেশ রাইফেলস। বর্তমানে যা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত। শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল। এছাড়াও ১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন৷ ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন৷
✨ প্রতিবাদ ও সংগ্রাম: ১৯৮৪ সালে তিনি বাধ্য হয়ে তার অনন্য কর্মজীবন থেকেঅবসর গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক পালাবদলে সেইসময়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি অনেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারা প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। তখন কোন কারণ ছাড়াই, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের গ্লাস ফ্যাক্টরি, কোকা-কোলার মত লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে। রাজনৈতিক ক্ষমতাশীল অনেক ধনী ব্যবসায়ীরা সে প্রতিষ্ঠানগুলো কিনতে বিভিন্ন চেষ্টা-তদবির শুরু করে। তবে মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত সে প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রিতে ঘোরতর বিরোধিতা করেন ; কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। ফলে সরকারের সাথে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের সময়ে আইনবহির্ভূতভাবে এলপিআর ছাড়াই তাকে অবসর নিতে হয়।
✨ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিষ্ঠা: ১৯৮৮ সালের ৯ জুন সামরিক শাসক এরশাদ সরকার বাংলাদেশের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। এ ঘটনাটি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মূলে এক ভয়াবহ কুঠারাঘাত। তৎকালীন সকল রাজনৈতিক দল সহ দেশের অধিকাংশ মানুষই এই রাষ্ট্রধর্মের ঘোষণার বিরোধিতা করেছিল। ১৯৮৮ সালের ৯ জুনকে কাল দিবস ঘোষণা করে, সেদিনই ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু সাংগঠনিক আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয় কিছু দিন পরে। বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করতে প্রতিষ্ঠিত হয় অরাজনৈতিক এ সংগঠনটি। মেজর জেনারেল (অবঃ) চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বেই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি একটি বটবৃক্ষের মত ছিলেন বলেই, তিনি সফলভাবে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
১৯৮৮ সালের ৯ জুন, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির কাউন্সিলে মেজর জেনারেল সি.আর দত্তকে সভাপতি ও এড. রানা দাশগুপ্তকে সাধারণ সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচিত করা হয়। মেজর জেনারেল(অবঃ) সি আর দত্ত ছিলেন বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি অসহায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রধান মুখ।
মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অবঃ) শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমী নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সংগ্রাম। কিন্তু বর্তমানে কিছু স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এরুপ ধর্মীয় উসকানি প্রদানের উদ্দেশ্য এরুপ মন্তব্য উপস্থাপন ও প্রচার করে, সুমহান মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু জনগোষ্ঠীর কোনো অবদান নেই, এ দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর কোনো অবদান নেই। কিন্তু সত্যি কি হিন্দুরা এ ভূমির ভূমিপুত্র হিসেবে সর্বদা নির্লিপ্ত ছিলো? অবশ্যই না! বহু হিন্দু সংগঠক হিসেবে কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজ মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মনিয়োগ করেছে বা কখনো নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এ ভূমির কল্যাণে। মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অবঃ) শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম সেই আত্মত্যাগকারীদেরই একজন।
⚠️ বিঃদ্রঃ উপরিউক্ত আর্টিকেল এর উদ্দেশ্য কোনো বিভেদ বা জাতিগত বিদ্বেষের প্রচার নয়। বরং বহুদিন ধরে প্রচলিত প্রোপাগাণ্ডার প্রত্যুত্তর। আমরা ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি, মহান মুক্তিযুদ্ধ সকল বাঙালি-অবাঙালি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ছিল।
⚡মুক্তিযুদ্ধ ও হিন্দু ইতিহাস: ০৪
#veda #BangladeshFreedomFighter #hindu