"বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবনারায়ণ দাস ও মুক্তিযুদ্ধ"
✨ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রথম ও মূল নকশার, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রনেতা, সমাজসেবক।
✨ মাতৃভূমি সর্বোপরি ✨
এ মাতৃভূমি প্রাণের চেয়ে প্রিয়, স্বর্গের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, পরম পবিত্র। এ পৃথিবীতে প্রাণত্যাগ করার বহুবিধ কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সেই সকল কারণের মধ্যে জন্মভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মত্যাগ সর্বোপরি। কারণ শাস্ত্রই আমাদের শিক্ষা দেয়,
"ইলা সরসতী মহী তিস্রো দেবীর্ময়োভুবঃ।
বহিঃ সীধন্ত্বস্রিধঃ"।। - ঋগ্বেদ ১/১৩/৯
অর্থাৎ, মাতৃভাষা, মাতৃসভ্যতা ও মাতৃভূমি এই তিনদেবী কল্যাণ দান করেন। এই তিন দেবতা আমাদের অন্তঃকরণে স্থায়ীভাবে অবস্থান করুন।
মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিটি জাতি বদ্ধপরিকর। দেশমাতৃকার সেবায় তার ভূমিপুত্রদের ত্যাগ সর্বাগ্রে। এ স্বদেশ ব্রতের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে জীবন-যৌবন ত্যাগ করেন দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা। সেই স্বদেশ ব্রতের সেবার নিজের সর্বস্ব ত্যাগকারী এক অকুতোভয় সংগ্রামী চেতনার নাম " বীর মুক্তিযোদ্ধা
শ্রী শিবনারায়ণ দাস।
শৈশব: ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, টঙ্গিবাড়িতে (বর্তমানে টঙ্গীবাড়ী, বাংলাদেশ) পিতা সতীশচন্দ্র দাশ ও যোগমায়া দাশের গৃহে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ - এ জন্মগ্রহণ করেন দেশপ্রেমিক শ্রী শিবনারায়ণ দাস। পিতা কুমিল্লা কুমিল্লাতে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করতেন। শ্রী শিবনারায়ণ দাসকে শিবুদা বলে সম্বোধন করতেন সবাই।
রাজনৈতিক জীবন: শিব নারায়ণ দাশ প্রথম ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। সেই সূত্রে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন। পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতির এক পর্যায়ে কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিব নারায়ন দাশ হয়ে উঠেন।
পতাকার নকশাকার: ৭০এর দশকের উত্তাল সময়ে শিবনারায়ণ দাস ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি "জয়বাংলা বাহিনী", মতান্তরে 'ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী' গঠন করা হয়। ফলস্বরূপ, ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।
সেই লক্ষ্যে অনুষ্টানের পূ্র্বে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন ইকবাল হল) সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিব নারায়ন দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন। সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ ভূমির উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনলেন; এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)-এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শিব নারায়ণ দাস পরিশেষে তার নিপুন হাতে মানচিত্রটি আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে, এমনি করে রচিত হলো 'ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী'র পতাকা। যা কিছুদিন পর বাংলাদেশের প্রথম পতাকা হিসেবে স্বীকৃত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ: বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু হলে এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ ০৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর তার জন্মদিবসে তাহার প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হয়, বিজয়ের রক্তিম সূর্য উদিত হয় আকাশে। তার সহধর্মিণী শ্রীমতি গীতশ্রী চৌধুরীও এক জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেই স্বাধীনতা এলো কিন্তু তিনি হারালেন তার দেবতুল্য পিতাকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদাররা পিতা সতীশচন্দ্র দাশকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
২০২৪ সালের ১৯ এপ্রিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালে এই মহান মুক্তিযোদ্ধা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু দেহত্যাগ করেও অপরের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন। তিনি তার চোখের কর্নিয়া ও মরণোত্তর দেহ দান করেন।
এ দেশ শুধু ভূমির টুকরো নয়। বরং হাজারে শিবুদার ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বর্গের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভূমি। সেই ভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শিবনারায়ণ বারংবার জন্মগ্রহণ করেন। নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করে মাতৃভূমির সেবায় নিয়োজিত থাকেন আমৃত্যু।
বিঃদ্রঃ উপরিউক্ত আর্টিকেল এর উদ্দেশ্য কোনো বিভেদ বা জাতিগত বিদ্বেষের প্রচার নয়। বরং বহুদিন ধরে প্রচলিত প্রোপাগাণ্ডার প্রত্যুত্তর। আমরা ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি, মহান মুক্তিযুদ্ধ সকল বাঙালি-অবাঙালি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ছিল।
⚡মুক্তিযুদ্ধ ও হিন্দু ইতিহাস: ০৫
#veda #BangladeshFreedomFighter #hindumythology