"ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি পরমতসহিষ্ণুতা"
নমস্কার সকল অমৃতের সন্তানগণ! কদাপি স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, "ধর্ম এমন একটি ভাব, যা পশুকে মনুষ্যত্বে ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে" অর্থাৎ, স্বামীজী ধর্মকে সার্বজনীন অর্থে এক উত্তম স্থানে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। যা প্রতিটি মনুষ্য, প্রাণী, তথা সৃষ্টির এক ঐশ্বরিক আদর্শকে প্রতিফলিত করে। বর্তমান সময়ের যে ধর্মের ব্যাখ্যা, সেরূপ ব্যাখ্যা সনাতন ধর্মশাস্ত্রে ধর্মের যে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে তদরুপ নয়। বরং, বর্তমান সময়ের ধর্ম বলতে মনুষ্য মাত্র তাহার বিশ্বাস অর্থে প্রয়োগ করা হয়।
কিন্তু মহর্ষি কণাদ প্রণীত বৈশেষিক দর্শনে ধর্মের পরিভাষা করা হয়েছে যে-
"যতোহভ্যুদয়নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ"।। (বৈশেষিক দর্শন– ১/১/২)
সূত্রার্থঃ- (যতঃ) যা দ্বারা (অভ্যুদয়) এই সংসারের [বিশ্বের] উন্নতি এবং (নিঃশ্রেয়স) মোক্ষ (সিদ্ধিঃ) সিদ্ধি হয় (স ধর্মঃ) তাকে ধর্ম বলা হয়।
অর্থাৎ যা দ্বারা বিশ্বের উন্নতির সহির শান্তি এবং উত্তম আনন্দ প্রাপ্তি হয় তাহাই ধর্ম। কেহ যদি মনুষ্য শরীর প্রাপ্ত হয়েও পশুত্ব ধারণপূর্বক হিংসা, বিদ্বেষ আদি করে তাহলে সে নিজ ধর্ম হইতে বিচ্যুত হইলো এবং নরকে ধাবিত হইলো।
উপরোক্ত ধারণা বিশ্লেষণ করে উপলব্ধি হয়, মনুষ্য মাত্রই তাহার ধর্ম এক, পদার্থ মাত্রই তাহার ধর্ম এক। একাধিক ধর্মের ধারণা সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে গৃহীত নয়। কিন্তু ধর্ম এক হলেও সত্যকে জানার চেষ্টায় মনিষীগণ যে চিন্তা, ধারণা প্রদান করেছিলেন তাহার থেকে যাত্রা শুরু করে বিবিধ দর্শন। সে দর্শন এর অনুসরণ করে বহুবিধ অনুসারী। যারা সেই দর্শনকে করেছে সমৃদ্ধ ও অগ্রসরমান। যাহার থেকে সৃষ্টি হয়েছে বহুবিধ মার্গ বা সম্প্রদায়ের।
তবে পরস্পর বিরোধ থাকলেও, সে বিরোধ ছিল শুধুমাত্র সত্য উদঘাটন, মিথ্যার খন্ডন ও বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণণের উদ্দেশ্যে। সেজন্য, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে এরুপ বিভিন্ন মত বা পথের দৃষ্টান্ত রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সেই মত বেদবিরুদ্ধ অবস্থান পর্যন্ত হয়েছে, যা নাস্তিক্য দর্শন হিসেবে সুপরিচিত।
এত বিরোধ সত্ত্বেও, এমন মার্গ বা মতের অনুসারীদের পরস্পরের প্রতি ছিল সহিষ্ণুতা। যা সমোধিক পরিচিত "পরমতসহিষ্ণুতা" হিসেবে। অর্থাৎ, ইহা প্রকাশ্য দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, পরমতসহিষ্ণুতা সনাতনীদের অতীব প্রাচীন ঐতিহ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় মূলনীতি হিসেবে "ধর্মনিরপেক্ষতা" ধারণার প্রয়োগ করা হয় বিভিন্ন রাষ্ট্রে। নিকোলা ম্যাকিয়াভেলি তার আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রথম "ধর্মনিরপেক্ষতা বা Secularism" ধারণা প্রদান করেন। যার অর্থ, রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকার ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে।
তবে ধর্মনিরপেক্ষতা আধুনিক হলেও সনাতনীদের ইতিহাসে পরমতসহিষ্ণুতা সুপ্রাচীন এবং Secularism থেকেও অধিক বাস্তবসম্মত। কারণ, সনাতন ধর্ম শাস্ত্র অনুসারে ধর্ম এক ও অদ্বিতীয়। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা কি করে হতে পারে? কিন্তু মত বা দর্শন একাধিক হওয়ার কারণে পরমতসহিষ্ণুতা অধিক প্রয়োগযোগ্য। এই ধৈর্য, উদারতা সনাতনীরা বহুদিন ধরে লালন করে আসছে। কিন্তু আধুনিক প্রগতিশীলদের নিকট থেকে জানতে হয়, সনাতনীরা নাকি উদার নাহ, সহিষ্ণু নয় কিংবা সেকুলারিজমকে ধারণ করে না। দূর্ভাগ্যবশত, তার ভুলে যায় পরমতসহিষ্ণুতা সনাতন সংস্কৃতিরই দান। তাই সনাতনীদের নতুন করে সেকুলার হওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ ইহার চেয়ে অধিক বাস্তবসম্মত ধারণার ধারক তারা।
তাই কেউ যদি বলে, সনাতনীরা সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ কি না? তবে আমাদের সদুত্তর! নাহ সনাতনীরা আধুনিক ছদ্মবেশী সেকুলার নয় বরং তারা পরমতসহিষ্ণু।
প্রচারে : VEDA