যজ্ঞ কী ⁉️


যজ্ঞ কী ⁉️

জগৎ পিতা-সৃষ্টিকর্তা-পরব্রহ্ম চিন্তা করলেন যে, জীবদের মলমূত্র দ্বারা এই ভূমি, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্বারা এই বায়ুমণ্ডল এবং অন্যান্য দুর্গন্ধযুক্ত ক্রিয়াগুলির দ্বারা এবং জলকে বিভিন্ন ভাবে দূষিত করার ফলে জীবনের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অতএব, তিনি সৃষ্টির আদিতে অগ্নি-বায়ু-আদিত্য-অঙ্গিরা ঋষিদের মাধ্যমে মানবকল্যাণ হেতু বেদের অবতারণা করলেন যার মধ্যে যজ্ঞ নামক কর্মেরও উপদেশ দিলেন। সম্পূর্ণ জগতে ব্যাপক বিষ্ণুরূপ যজ্ঞ দ্বারা সৃষ্টির সমস্ত দেবতাদেরকে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত করার উপায় তিনি "যজ্ঞো বৈ বিষ্ণু” বাক্যাংশে বলে দিলেন। যজ্ঞ থেকে উত্থিত সুগন্ধিত ধোঁয়া অন্তরিক্ষের উপরে দ্যুলোক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই ভেষজগুণযুক্ত ধোঁয়া বায়ু পরিশুদ্ধ করে মেঘের মাধ্যমে জলতে নির্মল করে দেয়। এই নির্মল বর্ষাজল পৃথিবীর মলকে ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয় এবং পর্জন্য পিতার বর্ষণ হেতু এই ভূমিমাতা শস্য শালিনী হয়ে বহুবিধ উদ্ভিদ ও জীবকে তার গর্ভ থেকে বাইরে প্রকাশ করে। এইজন্য অর্থব বেদে (১২/১/১২) ঋষি বলেছেন-

🌱"মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যাঃ। পর্জন্য পিতা সউ নঃ পিপর্তু।"🌱

"যজ্ঞ” শব্দটি ব্যাপক। ঋগ্বেদে এই শব্দ ৫৮০ বার, যজুবেদে ২৪৩ বার, সামবেদে ৬৩ বার এবং অর্থব বেদে ২৯৮ বার অর্থাৎ চার বেদে যজ্ঞ শব্দ মোট ১১৮৪ বার এসেছে।

যজ্ঞ শব্দ 'যজ্' ধাতু দিয়ে তৈরি। 'যজ্' ধাতুর তিনটি অর্থ-'যজ্ দেবপূজা সঙ্গতিকরণ দানেষু' অর্থাৎ ১। দেবপূজা ২। সঙ্গতিকরণ ও ৩। দান। সুতরাং যজ্ঞের বিভিন্ন প্রকার এইরূপ-দেবযজ্ঞ (অগ্নিহোত্র বা হবন), ব্রহ্মযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, বলিবৈশ্যদেবযজ্ঞ, অতিথিযজ্ঞ, অশ্বমেধযজ্ঞ ইত্যাদিতে যজ্ঞের প্রায় সমস্ত অর্থ নিহিত আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনাদি কাল থেকে যজ্ঞের প্রচলন ছিল যদিও আজ প্রদীপ, মোমবাতি, ধূপবাতি তার রূপ পরিগ্রহ করেছে।

⚡ যজ্ঞের পাঁচটি মুখ্য অঙ্গ :-  বৈদিক যজ্ঞের পাঁচটি মূখ্য অঙ্গ- (১) সমিধা (২) গোঘৃত ও ওষধি (৩) পাত্র (৪) মন্ত্র ও (৫) ভাবনা।

▪️সমিধা: সমিধার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গো বা গো বংশের শুষ্ক গোবর যাকে ঘুঁটা বলা হয়। যজ্ঞে ভৈষজগুণ উৎপন্ন করার জন্য আম, বট, ডুমুর, পলাশ, অশ্বত্থ ও বেল ইত্যাদির কাষ্ঠ কাজে লাগানো যেতে পারে। সমস্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গরুর গোবরের ভেষজ গুণের সমর্থন করে। বিশ্বের সব দেশের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নিবারণের জন্য গরুর গোবরের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। গরুর গোবরে মেন্থাল, অ্যামোনিয়া, ফিনাল, ইন্ডাল, নাইট্রোজেন (০.৩২%), ফসফরিস অ্যাসিড (০.২১%) ও পটাশ (০.১৬%) পাওয়া যায়। ইতালীর জনৈক বৈজ্ঞানিক ডঃ বিগ্রেড গবেষণা করে দেখেছেন যে, সদ্য গোবরের শুধু গন্ধে জ্বর ও ম্যালেরিয়া জীবাণু নষ্ট হয়ে যায়। নিউয়ার্ক টাইমস্ বলছে-পুষ্টিকর আহারে পালিত গাভির গোবরের মত কীটাণুনাশক শক্তি অন্য কিছুতে নেই। গরুর গোবর দ্বারা লেপিত বস্তু এবং ঘরের দেওয়ালগুলি পরমাণু বিস্ফোরণের মত মারাত্মক বিকিরণকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। তাছাড়া অন্তরিক্ষযানে উদ্ভুত ভীষণ তাপকে গরুর গোবর নিবারণ করতে পারে-একথা রাশিয়ার বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় প্রমাণিত। গরুর গোবরের শুষ্ক চূর্ণ ধুম্রপান করিয়ে হাঁপানি রোগ সারাতে পাশ্চাত্য দেশের চিকিৎসকরা সচেষ্ট হয়েছেন। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, গরুর গোবরের ঘুঁটের মধ্যে এবং সেটা জ্বালালে যে ধোঁয়া হয় তার মধ্যেও ভৈষজতত্ত্বের অস্তিত্ববিদ্যামান।

▪️গোঘৃত ও ওষধি: বৈদিক যজ্ঞে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বস্তু হলো-গোঘৃত। যদিও গোঘৃত সহ কস্তুরি, কেশর, অগরু তগরু, শ্বেতচন্দন, এলাচি, জায়ফল ও জয়ত্রী ইত্যাদি সুগন্ধদায়ক, দুধ, ফল, কন্দ, চাল, গম, মাষকলাই ইত্যাদি পুষ্টিকারক; চিনি, মধু, ছোহারা ইত্যাদি মিষ্ট এবং গুলঞ্চ ইত্যাদি ওষধিগুলি বিশেষ ফলপ্রদ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবুও শুধুমাত্র গব্যঘৃত হব্য হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। মোষ বা অন্য পশুর ঘৃত বা উদ্ভিদ হতে উৎপন্ন ঘি যজ্ঞে ব্যবহার করলে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায় অথচ গব্যঘৃত প্রয়োগে বায়ুদূষণ দূরীভূত হয়। এইজন্য অথর্ববেদে (২/১৩/১) শুদ্ধ গব্যঘৃত দ্বারা যজ্ঞ করলে আয়ু বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। গোঘৃত বা অন্য পদার্থগুলিসহ গোদুগ্ধও ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রার্থনা মন্ত্রে এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, গাভির দুধ-ঘির আহুতি দ্বারা হোম করলে আবহাওয়া শুদ্ধ হয় এবং চতুর্দশ ভুবনে আবহাওয়া সমরূপ হওয়ায় সব ভুবনের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়- চতুর্দশ ভুবন গাভির শরীরে তথা পরলোকে কল্যাণ করুক। যজ্ঞের বিভিন্নতা ও সর্বব্যাপকতা লক্ষ্য করে এমন মনে হয় যে, এই সৃষ্টি যজ্ঞের জন্য রচিত হয়েছে এবং যজ্ঞ সম্পাদন করার জন্য গাভির সৃষ্টি করা হয়েছে। সম্ভবত এইজন্য 'গাবো বিশ্বস্য-মাতরঃ' (গাভি বিশ্বের মাতা)' বাক্যের উদ্‌ঘাষ করা হয়েছে। গোঘৃত বা অন্য পদার্থগুলিসহ গোদুগ্ধও ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রার্থনা মন্ত্রে এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, গাভির দুধ-ঘির আহুতি দ্বারা হোম করলে আবহাওয়া শুদ্ধ হয় এবং চতুর্দশ ভুবনে আবহাওয়া সমরূপ হওয়ায় সব ভুবনের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়- চতুর্দশ ভুবন গাভির শরীরে তথা পরলোকে কল্যাণ করুক। যজ্ঞের বিভিন্নতা ও সর্বব্যাপকতা লক্ষ্য করে এমন মনে হয় যে, এই সৃষ্টি যজ্ঞের জন্য রচিত হয়েছে এবং যজ্ঞ সম্পাদন করার জন্য গাভির সৃষ্টি করা হয়েছে। সম্ভবত এইজন্য 'গাবো বিশ্বস্য-মাতরঃ' (গাভি বিশ্বের মাতা)' বাক্যের উদ্‌ঘাষ করা হয়েছে।
গোঘৃত মধ্যে কী কী পদার্থ আছে এখনও পর্যন্ত এটা সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। তবে এ যাবৎ গবেষণা করে গোঘৃতে এগারোটি অ্যাসিড, বারোটি ধাতু, দুটি ল্যাকটোজ এবং চারটি গ্যাস পদার্থ পাওয়া গেছে।
গরুর ঘি চালের সঙ্গে মিশ্রিত করে মন্ত্রোচ্চারণ সহ যখন অগ্নিহোত্র আহুতি প্রদান করা হয় তখন সেই আহুতি দহনের ফলে যে গ্যাস উৎপন্ন হয় তার মধ্যে চারটি গ্যাস এখন পর্যন্ত জানা গেছে।- (১) এথিলীন অক্সাইড (২) প্রোপিলীন অক্সাইড (৩) ফার্মাল্ডিহাইড্ এবং (৪) বীটা-প্রোপিও ল্যাকটোন। গোঘৃত দহনে উৎপন্ন এই গ্যাসগুলির মধ্যে কয়েকটি রোগ ও মানসিক চাপ দূর করার বিলক্ষণ সামর্থ লক্ষিত হয়।
চালে বারো প্রতিশত আর্দ্রতা এবং অবশিষ্ট শ্বেতসার থাকে। চালের কঠিন খোলসে তৈলদ্রব্য থাকে। এর মধ্যে যথেষ্ট মাত্রায় ওলীন এবং এলবুমিনস্ পদার্থ আছে। এই একমাত্র শস্য যা সমস্ত পৃথিবীতে উপলব্ধ ও ব্যবহৃত হয়। যজ্ঞ বিশ্বধর্ম। অতএব যজ্ঞের আহুতিতে চালের সমাবেশ স্বাভাবিক।

▪️পাত্র-যজ্ঞ করার জন্য ভূমিতে গর্ত খনন করা হোক বা লোহা তামা ইত্যাদি কোন ধাতুনির্মিত পাত্রে ব্যবহার করা হোক প্রতিটি অবস্থায় পাত্রের আভ্যন্তরিক অংশের বিশেষ আকৃতি পরিলক্ষিত হয়। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মতে হোমকুন্ডের উপরের মাপ ১৬×১৬ আঙুল, নিম্নের মাপ ৪×৪ আঙুল এবং গভীরতা ১৬ আঙুল হবে। যজ্ঞকুন্ড ছোট বা বড় করতে হলে উপর, নিম্ন ও গভীর অংশের অনুপাতের কোনো পরিবর্তন হবেনা। যজ্ঞপাত্র যে কোনো বস্তু দ্বারা তৈরি করা যেতে পারে কিন্তু তামা ধাতু তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই ধাতব পদার্থের বিদ্যুৎ পরিবহণ ক্ষমতা সকলেই জানে। এইজন্য বিদ্যুৎ সরঞ্জামে এর ব্যবহার করা হয়। যুগোস্লাভিয়ার এক পরমাণু বিশেষজ্ঞের মতে-সব ধাতু পদার্থের মূল অণুগুলির আকার ভিন্ন ভিন্ন। তামা ধাতুর মূল অণুগুলির আকার পিরামিড সদৃশ অর্থাৎ যজ্ঞপাত্রের মত। এই গবেষণা দ্বারা প্রতিপন্ন হয় যে, তামা ধাতুর নির্মাণ যজ্ঞপাত্র হওয়ার জন্য হয়েছে।

▪️মন্ত্র- 'স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার'- এই ক্ষুদ্র বাক্যটি স্বাধীনতা প্রেমী প্রতিটি লোকের অন্তঃস্থলে জায়গা করে নিয়েছিল। সে সময়টি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়। সাধারণভাবে দেখলে ঐ কয়েকটি শব্দের মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না, কিন্তু জলদগম্ভীর স্বরে লোকমান্য তিলক যখন এই শব্দগুলি উচ্চারণ করেছিলেন তখন এই শব্দগুলির মধ্যে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের তপস্যা এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির উৎকট অভিলাষার বীজ রোপন করে দিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, সহজভাবে উচ্চারিত এই শব্দগুলি যার যার কান পৌঁছেছিল তার উপর মন্ত্রের মত কাজ করেছিল। ঋষিরা তাঁদের তপশ্চরণ দ্বারা মন্ত্ররূপী বর্ণমালা শব্দ বা শব্দ সমূহকে সংসিদ্ধ করেছেন। অতএব এই শব্দগুলিতে শক্তি নিহিত আছে। যদি তিলকের বাক্যের শক্তি আমরা অনুভব করতে পারি তাহলে ঋষিদের দ্বারা সংসিদ্ধ শব্দগুলির শক্তি স্বীকার করব নাকেন? শব্দ দুই প্রকার- (১) নিত্য শব্দ ও (২) কার্য শব্দ। যে শব্দ নিত্য বা যার দ্বারা সৃষ্ট কম্পন নিত্যস্বভাবের হয় তাকে নিত্য শব্দ বলে। কার্য শব্দের উদাহরণ লোকমান্য তিলকের উক্ত শব্দগুলি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে উক্ত শব্দগুলিতে সেই চৈতন্য শক্তি নেই যা স্বাধীনতার আগে ছিল। বেদের শব্দ নিত্য হওয়ায় সহস্র বৎসর পূর্বে এর মধ্যে যে শক্তি ছিল আজও তা বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও তা থাকবে। এমন নিত্য ও সামর্থ্যসম্পন্ন শব্দকেই মন্ত্র বলা হয়। বেদ সংস্কৃত ভাষায় রচিত। সংস্কৃত ভাষা বিশ্বের সমস্ত ভাষার জননী। এর বিশিষ্ট শব্দ থেকে বিশিষ্ট ধ্বনি নির্গত হয় এবং বায়ুমন্ডলের উপর তার বিশিষ্ট প্রভাব পড়ে। যদি শব্দে পরিবর্তন হয়, তাহলে ধ্বনিতে পরিবর্তন হবে। একই অর্থসম্পন্ন বিভিন্ন শব্দগুলির দ্বারা সৃষ্ট ধ্বনি-কম্পন ও বিভিন্ন হবে এবং তার পরিণামও বিভিন্ন হবে। সমান অর্থের দুটি শব্দ হলেও একের পরিবর্তে অন্যটির ব্যবহার সঙ্গত হয় না। যেমন- 'অগ্নয়ে স্বাহা'-র স্থানে 'পাবকায় স্বাহা' বলা ঠিক হবে না। নিদ্বির্ধায় বলা যেতে পারে যে, যজ্ঞমন্ত্রের অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করার প্রশ্নই আসেনা। যজ্ঞের মন্ত্রে আগত 'অগ্নি', 'সূর্য', 'প্রজাপতি' শব্দ ঈশ্বরবাচক এবং এক ঈশ্বরশক্তির নানাবিধ তেজগুণের বর্ণনা করে। এই মন্ত্রগুলির অর্থ এইরূপ-আমি অগ্নি, বায়ু, সূর্য ও প্রজাপতিকে আহুতি প্রদান করছি। সেই হবি এখন অগ্নি, সূর্য ও প্রজাপতির, আমার নয়। যদিও এই তিনটি শব্দের অর্থ একই কিন্তু এর দ্বারা উৎপন্ন ধ্বনি-কম্পন শরীর, মন ও প্রাণের উপর বিভিন্ন রকম প্রভাব সৃষ্টি করে। অগ্নিহোত্রের এই মন্ত্রগুলি সূর্য থেকে প্রাপ্ত প্রকাশরূপী কিরণগুলির ধ্বনিময় সারবস্তু। অগ্নিহোত্রের মন্ত্রের ঠিক সময় মত উচ্চারণে আবহাওয়া দূষণমুক্ত হয়। এই সব মন্ত্রগুলির অনুবাদে সেই শুদ্ধিকারক শক্তির উন্মেষ সম্ভব নয়। এই ধ্বনির উচ্চারণে বর্ণ ও ধ্বনির কম্পন আবহাওয়ায় পরিব্যপ্ত হয়। সুতরাং মন্ত্রের অশুদ্ধ উচ্চারণে অভীষ্ট ধ্বনি-কম্পন সৃষ্ট হয় না। পরিণামে বক্তা মন্ত্রের লাভ থেকে বঞ্চিত রয়ে যায়। বর্ণ শব্দের দুটি অর্থ ধ্বনি ও রং। কম্পন দ্বারা শক্তি উৎপন্ন হয়। সৃষ্টির উৎপত্তি কম্পনরূপে শক্তি দ্বারা হয়েছে-এরকম ধারণা বর্তমান পদার্থ বিজ্ঞানীরা পোষণ করেন। ধ্বনি সম্বন্ধে বলা যেতে পারে যে, ধ্বনি কম্পনের ভালমন্দ পরিণাম বিজ্ঞানীরা জানেন, যেমন-সঙ্গীত শুনে গাভি বেশি দুধ দেয়, গাছপালার বৃদ্ধির হার বেড়ে যায়। পুলের উপর চলার সময় সৈনিকদেরকে একতালে না চলার আদেশ দেওয়া হয় কেননা তাল বদ্ধ সঞ্চালনে উৎপন্ন কম্পনে পুল ভেঙ্গে পড়ার উদাহরণও আছে। সুমধুর ধ্বনি (নাদ) শরীর ও মনের উপর সুন্দর প্রভাব ফেলে। আজকাল এই ধ্বনি (পরাশ্রব্য) তরঙ্গ সমুদ্রের গভীরতা মাপতে, সংবেদশীল শল্যক্রিয়া এবং ক্যানসারের চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা হচ্ছে। অগ্নিহোত্রের মন্ত্রে ধ্বনি চিকিৎসার (ভাইব্রেশান থেরাপী) গুণ কী রকম নিহিত, তাহা উল্লেখিত বিবেচনায় পরিষ্কার বোঝা যায় বর্ণের একটি অর্থ হল- রং। রং চিকিৎসা (ক্রোমোপ্যাথী) আধুনিক চিকিৎসায় একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ভিন্ন ভিন্ন গতি সম্পন্ন তরঙ্গ, ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব উৎপন্ন করে। আধুনিক বিজ্ঞান প্রকাশ বা আলোককে তরঙ্গ রূপে স্বীকার করে। ভিন্ন ভিন্ন রঙের আলোকের ভিন্ন ভিন্ন স্পন্দন (ফ্রিকোয়েন্সী) হয়। আলোকের রং গাঢ় বা হালকা, সেই রঙের আলোক-তরঙ্গের তীব্রতার (ইনটেনসিটি) উপর নির্ভর করে। মন্ত্রশাস্ত্র মতে দেবনাগরী বর্ণমালা সাদা, লাল, হলুদ ও নীল রঙে বিভক্ত, প্রতিটি রঙের নিজস্ব বিশেষ গুণ-প্রভাব আছে। অতএব ভিন্ন ভিন্ন রঙের চিকিৎসার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রঙের আলো কাজ লাগানো হয়। যেমন-লাল রঙের আলো উষ্ণতা প্রদান করে, তাই কিছু চর্ম ও রক্ত পীড়ায় এটা সুফল দিয়েছে। লাল রঙের আলো মানসিক শক্তি যোগায়। সব সময় উদাসীন এবং পরিস্থিতির শিকার নিরাশাবাদীর পক্ষে এটা ভাল কাজ দেয়। চক্ষু অপারেশনের পরে চোখে সবুজ রঙের পট্টী বেঁধে দেওয়া হয়। ধাতু বিল্ডিঙের কাজ করার সময় তা থেকে উদ্ভূত তীব্র আলো থেকে চক্ষু রক্ষা করতে বেগুনী রঙের কাঁচের প্লেট ব্যবহার করা হয়। এইরূপ প্রতিটি রঙের এটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। যজ্ঞদ্বারা আবহাওয়ায় অনুকূল ও পুষ্টিকর তত্ত্ব বিস্তার করার সময় মন্ত্রোচারণ দ্বারা চতুপার্শ্বের বায়ুমণ্ডলে সূক্ষ্ম কম্পন-ধ্বনি প্রসারিত করা হয় এবং সেই সঙ্গে আহুতিও প্রদান করা হয়। আহুতির দহনে উৎপন্ন অগ্নির লাল-নীল-হলুদ রংয়ের সঙ্গেও যজ্ঞ মন্ত্রের অদ্ভুৎ সামঞ্জস্য আছে। এইভাবে এই মন্ত্র সমূহে যজ্ঞ চিকিৎসার গুণও সন্নিবেশিত রয়েছে। যজ্ঞে মন্ত্র উচ্চারণ করার সময় এটা লক্ষ্য রাখতে হয় যে, মন্ত্রগুলি অস্ফুষ্টভাবে বা চিৎকার করে বলা না হয়। প্রতিটি মন্ত্রের বিশিষ্ট স্বর (তীব্রতা ও বারম্বারতা) সহ মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। মলাহার রাগিনীতে বর্ষা হওয়া এবং দীপক রাগিনীতে আগুন ধরে যাওয়ার উদাহরণ ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়। মন্ত্র সহ স্বর-লয়-মাত্রার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই দিক দিয়ে যজ্ঞে মন্ত্রোচ্চারণের সময় আজকাল ব্যবহৃত লাউড স্পীকার, ধ্বনি তরঙ্গের তীব্রতা পরিবর্তন করে দেওয়ার কারণ হিসাবে মন্ত্র ধ্বনির পরিপ্রেক্ষিত উপযুক্ত নয়। যজ্ঞে উচ্চারিত মন্ত্র সদ্ভাবে উৎপন্ন কারী অক্ষর সমূহ; তদনুরূপ তার উচ্চারণ হওয়া উচিত। এরফলে পরিবেশ দূষণ মুক্ত করতে সাহায্য পাওয়া যায়। নিয়ম বিরুদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণে লাভের বদলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।

▪️ভাবনা- একজন চিকিৎসক প্রয়োজন বোধে অস্ত্র দ্বারা কোনো রোগীর অঙ্গচ্ছেদ করে, একজন ডাকাত অস্ত্র দ্বারা কোনো লোকের অঙ্গহানি করে। ক্রিয়া দুটি সমান হলেও দুটি ব্যক্তির (চিকিৎসক ও ডাকাত) চিন্তাধারা বা ভাবনা পৃথক হওয়ায় ক্রিয়া ফলও ভিন্ন হয়। যজ্ঞে উচ্চ সাত্ত্বিক ভাব থাকা অতি প্রয়োজন। যজ্ঞে স্বার্থ নয়, বরঞ্চ পরমার্থ চিন্তা থাকা দরকার। অগ্নি, সূর্য, প্রজাপতি ইত্যাদিকে আহুতি প্রদান করার পর "ইদন্ন মম” শব্দের উচ্চারণ করা হয়। যাজ্ঞিক বা যজ্ঞকারীর ভাবনা কেমন হবে? এই তথ্য ইদন্ন মম শব্দের ভাবার্থে নিহিত আছে। যাজ্ঞিক তার অর্থ-দ্রব্য -শ্রম নিযুক্ত করে যজ্ঞ করল। এর ফলে তার মধ্যে অহংকার আসতে পারে। এটা আমার জন্য নয়, এটা আমার জন্য নয় বলার সঙ্গে সঙ্গেই সেই অহংভাবের পরিসমাপ্তি ঘটে। বৈদিক যজ্ঞের এই ভাবনা পরিত্যাগ করার ফলে তান্ত্রিক-যজ্ঞ ও পশুহিংসা যজ্ঞের প্রচলন হয়েছে। এই প্রকার অসদ্ভাবযুক্ত যজ্ঞ অভিষ্ট সিদ্ধি প্রদানে সক্ষম। অর্থব বেদে (১২/৫/৫৬) বলা আছে- "যে মনুষ্য বৈদিক নিয়মের অবহেলনা করে অগ্নিহোত্র, বেদাধ্যয়ন ইত্যাদি কপট মন নিয়ে সম্পাদন করে, তার কোনো সম ইষ্ট-সিদ্ধি হয় না।" প্রকৃতিতে সঙ্ঘটিত পরিবর্তনের সঙ্গে মনুষ্য শরীর-সম্পর্কীয় ক্রিয়াকলাপের ছন্দ বজার রাখার জন্য আলো ও অন্ধকারের সন্ধিকাল প্রাতঃকাল বা সূর্যোদয় এবং সায়ংকাল বা সূর্যাস্তকালে যজ্ঞ বিশেষ ফলদায়ী হয়। অতএব সকাল সন্ধ্যা যজ্ঞ করার বিধান আছে। এর ফলে দূষিত আবহাওয়া শুদ্ধহয়। 

প্রচারে :- Veda 
সোর্স :- যজ্ঞ ও বিজ্ঞান।  

🔎Run with #veda

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

🔸সনাতন ধর্ম ও নারী 💐

সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️

▪️একাদশী" কি শাস্ত্র সম্মত ❓