"শ্রেষ্ঠ সন্তান সর্বদা, পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল"


"শ্রেষ্ঠ সন্তান সর্বদা, 
পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল"

▪️এই মানবজন্মে নিঃস্বার্থ ভাবে সত্যিকারের ভালোবাসে পিতা-মাতা। জীবনের একমাত্র সম্পর্ক যা আমরা জন্মমাত্র লাভ করে থাকি। অর্থাৎ, পিতা-মাতা আমাদের কাছে ঈশ্বরের দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। সন্তানকে শৈশব থেকে জীবনের শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত ভালোবাসা এবং কল্যাণ কামনার অনন্য দৃষ্টান্ত একমাত্র মাতাপিতার নিকটই পাওয়া যায়। এজন্য বাংলা অভিধানে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, যার পিতামাতা রয়েছে, সে কখনো দরিদ্র হতে পারে নাহ। 

▪️সেজন্য, ধর্মশাস্ত্রে পিতাকে স্বর্গ স্বরুপ বলা হয়েছে এবং মাতাকে বলা হয়েছে দশ উপাধ্যায় হতে সর্বোত্তম। পিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং মাতার প্রতি মর্যাদাবোধ ধারণ করা সন্তানের উত্তম গুণ। সেজন্য, পিতামাতার সেবা করা সন্তানের একান্ত কর্তব্য। কিন্তু সে সেবা দ্বারা কখনো সন্তানের এরুপ ধারণা করা উচিত নয় যে, সে তার পিতামাতার ঋণ পরিশোধ করছে। কারণ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, 

"যংমাতাপিতরৌ ক্লেশং সহতে সম্ভবে নৃণাম্ ।
ন তস্য নিষ্কৃতিঃ শক্যা কর্তুং বর্ষশতৈরপি।।"
- মনুসংহিতা, ২/২২৭

অর্থাৎ, সন্তান জননে পিতামাতা যে ক্লেশ সহ্য করেন পুত্র শত শত বৎসরে, শত শত জন্মেও সেই ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ নয়।

▪️বাবা-মা আমাদের সর্বদা আমাদের আগলে রাখেন, ভালোবাসেন এবং স্নেহ করেন। ধর্মশাস্ত্রে পিতা-মাতার মর্যাদাকে সর্বদা মহিমান্বিত করা হয়েছে।

🔅মাতৃমর্যাদা: 

▪️মা শব্দ অতি মধুর। মায়ের তুলনা শুধু মা হয়। পৃথিবীতে মায়ের স্থান সর্বোচ্চ মহান ঈশ্বরের পরে। প্রত্যেক মহাপুরুষ মায়ের প্রতি জানিয়েছেন তাদের শ্রেষ্ঠতম সম্মান। সেজন্য মনুস্মৃতিতে উল্লেখ রয়েছে, 

"উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচার্য্যণাং শতং পিতা ।
সহস্রন্ত্ত পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে ।।"

 -মনুসংহিতা, ২/১৪৫

অর্থাৎ,  দশজন উপাধ্যায় থেকে একজন আচার্যের গৌরব বেশি । একশত আচার্যের থেকে পিতার গৌরব বেশি এবং সহস্র পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানিত।

"ইমং লোকং মাতৃভক্ত্যা" - মনুসংহিতা, ২/২৩৩

অর্থাৎ, মানুষ মাতৃভক্তি দ্বারা এই ভূলোক জয় করতে পারে ।

▪️মা আমাদের নিকট এক পরম আশ্রয়। সেজন্য, আমরা প্রকৃতি, ভূমি, নদী, স্বদেশ সবকিছুকে মাতৃমূর্তি হিসেবে সম্বোধন করি। কারণ, মা অপেক্ষা কেউ এমন পরম আশ্রয়ে আমাদের রাখতে সক্ষম নয়। 

"নাস্তি মাতৃসমাচ্ছায় নাস্তি মাতৃসমা গতিঃ
নাস্তি মাতৃসমৎ তাণৎ নাস্তি মাতৃসমা প্রিয়।।"
- মহাভারত শান্তিপর্ব ২০৬/৩১

অর্থাৎ মাতার তুল্য আশ্রয় নাই, মাতার সমান উপায় নেই, মাতার ন্যায় রক্ষক নেই, এবং মাতা সদৃশ্য প্রিয় আর কেউ নেই।

"সমর্থ বাসমর্থ বা কৃশং বাপ্যকৃশং তথা,
রক্ষত্যে সুতং মাতা নান্য পোষ্ট বিধানতঃ।।"
  - মহাভারত শান্তপর্ব ২৬৬/২৯

অর্থাৎ, সন্তান সমর্থ হোক বা অসমর্থ হোক,
দূর্বল হোক বা সফল হোক,মাতাই তাকে রক্ষা করেন।
  
▪️মা এমনই ব্যক্তিত্ব। যাকে প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন স্বয়ং পরমাত্মা। মাতৃ মর্যাদা এমনই সুউচ্চ যে, আমরা একমাত্র পরমাত্মার তুলনা মায়ের সাথে করতে পারি (গুণ-সাপেক্ষে)। পরমাত্মার পরে কোনো আচার্য নয়, কোনো ঋষি নয় বরং স্থান দেওয়া হয়েছে মাতাকে। কারণ, তিনি "মা"। 

"মাতা চ মে ছদয়থঃ সমা বসো বসুৎবনায় রাধসে।"
  - ঋগ্বেদ ৮/১/৬

অর্থাৎ,  পরমেশ্বরের তুলন শুধু মাত্র মায়ের সাথে করা যায়।কারণ পরমেশ্বর আর মাতা উভয় আমাদের ধারণ করেন,আমাদের পালন ও পোষণ করেন,এবং বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে সদগুণরূপ ধন ও ঐশ্বর্য প্রদান করে আমাদেরকো রক্ষা করেন।

" মা নো বধীঃ পিতরং মোত মাতরম্"
 -যজুর্বেদ ১৬/১৬

অর্থাৎ,  মাতার স্থান ঈশ্বরের পরেই।তিনি জগতের  মাতৃমতি দেবী।

🔅পিতৃমর্যাদা: 

▪️পিতা এক বটবৃক্ষের অপর নাম। সর্বদা নিরবে, নিঃশব্দে এই সংসারের ভার বহন করে, স্ত্রী ও সন্তানকে যোগ্য করে তুলতে পিতা সর্বদা দৃপ্ত পদচ্ছাপে কর্তব্য নির্বাহ করেন। কখনো নিজের সুখ-সমৃদ্ধির চিন্তা না করে, সর্বদা পরিবারের জন্য আড়ালে ত্যাগ স্বীকার করে যে ব্যক্তিটি তার নাম "পিতা"। সেজন্য প্রবাদপ্রতিম বাক্য রয়েছে, পৃথিবীতে হাজারো খারাপ মানুষ রয়েছে, কিন্তু কোনো খারাপ বাবা নেই। 

▪️পিতার প্রতি আমরা সর্বদা শ্রদ্ধাশীল হবো। কারণ, পিতা সেই নিরব ত্যাগকারী, যার অনুপস্থিতি ব্যতীত তার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায় নাহ। পিতার পরিচয় প্রদানে নিরুক্তে ও মহাভারতে এরুপ বলা হয়েছে যে, 

"পিতা পাতা বা পালয়িতা বা; ন পিতা গোপিতা"
 - নিরুক্ত: ৪।২১ ও ৬/১৫

অর্থাৎ, যিনি সন্তানকে সর্বদা বাঁচিয়ে রাখেন, পালন করেন ও রক্ষা করেন, তিনিই "পিতা"।

"শরীরকৃত্ প্রাণদাতা যস্য চান্নানি ভুংজতে, ক্রমোনেনে ত্রয়োৎযুক্তা পিতরে ধর্মশাসনে।" 
- মহাভারত: ১/৯৩/২৫

অর্থাৎ, যিনি আমাদের দেহে গঠনে অবদান রাখেন (গর্ভধারণ সংস্কার), যিনি আমাদের জীবন রক্ষা করেন (অভয়দানম্), এবং যিনি আমাদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করেন, তিনিই পিতা।

অথর্ববেদে পিতা এরুপ পালনকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে মেঘের সহিত উপমা প্রদান করে বলা হয়েছে, 

“মেঘ হলো পিতা। মেঘই বৃষ্টি বর্ষণ দ্বারা অন্নাদির উৎপাদন করেন। আমি এর দ্বারা পালিত, এর পুত্র”।
 
- অথর্ববেদ: ১২/১/১২

▪️মহাভারতে সে অটল বটবৃক্ষ স্বরুপ পিতার মর্যাদাকে দেবতা সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তার প্রীতিতে স্বয়ং ঈশ্বর প্রীত হয়ে থাকে। 

"পিতা ধর্ম্মঃ পিতা স্বর্গঃ পিতাহি পরমান্তপঃ। 
পিতরি প্রীতিমাপন্নে সর্বাঃ প্রীয়ন্তি দেবতাঃ।।"

- মহাভারত শান্তিপর্ব ২৬৬/২১ 

অর্থাৎ, পিতা ধর্ম স্বরূপ, পিতা স্বর্গ স্বরূপ এবং পিতাই পরম তপস্যা স্বরূপ। সুতরাং পিতার প্রীতি লাভ করলেই সমস্ত দেবতাই প্রীত হন।

ধর্মপরায়ণ পিতা সন্তানের প্রথম আদর্শ হয়ে থাকে। পিতা তাদের নিকট একজন সুপার হিরো হিসেবে আবির্ভূত হোন। কখনো ভয়ে, কখনো দ্বিধায় পিতা এক সমাধান, এক অকুতোভয় বীর। সে পিতার আদেশ ধর্মাত্মা সন্তানের নিকট পরম কর্তব্য। যেরুপ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম পিতৃসত্য পালনার্থে ১৪ বছরের বনবাসকেও গ্রহণ করে নিতে দ্বিধাবোধ করেন নাহ। 

"পিতা হি দৈবতং তাত দেবতানামপি স্মৃতম্। 
তস্মাদ দৈবতমিত্যেব করিষ্যামি পিতুর্বাচ:।।"
- রামায়ণ: অযোধ্যাকাণ্ড ৩৪/৫২

অর্থাৎ,হে পিতা! পিতা দেবতাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, দেবতা বলে মান্য। অতএব, পিতৃবাক্যকে দেববাক্য হিসেবে পালন করবো।

"স মা পিতা যথা শাস্তি সত্যধর্মপথে স্থিত:। 
তথা বর্তিতুমিচ্ছামি সহি ধর্ম: সনাতন:।।"
- রামায়ণ:অযোধ্যাকাণ্ড ৩০/৩৮

অর্থাৎ, সত্য ও ধর্মপথে অবস্থিত পিতা আমাকে যা আদেশ করেন, আমি তদানুসারেই চলতে চাই। এটাই সনাতন ধর্ম।

▪️পরিশেষে এতটুকু বলার রয়েছে, পিতা-মাতা আমাদের নিকট থাকা এক ঐশ্বরিক উপহার। সে পিতামাতার সেবা করা সন্তানের পরম কর্তব্য। যা সনাতন ধর্মের পঞ্চ মহাযজ্ঞের অন্যতম - পিতৃযজ্ঞ।

উর্জং বহন্তীরমৃতং ঘৃতং পয়ঃ কীলালং পরিশ্রুতম্।
স্বধাস্থ তর্পয়ত মে পিতৃন্।। - যজুর্বেদ ২/৩৪ 

অর্থাৎ, আমরা প্রত্যেকে জীবিত পিতা মাতা, গুরুজন ও বিদ্বান পুরুষদিগকে উত্তম রস, সুস্বাদু জল, সুমিষ্ট রোগনাশক পদার্থ, দুগ্ধ, ঘৃত, সুরন্ধিত অন্ন ও সুপক্ব রসাল ফল দ্বারা তৃপ্ত করিবব। পরধনে লোভ না করিয়া নিজধনে তৃপ্ত থাকিব। 

সে পিতৃযজ্ঞ পালন করার মাধ্যমে আমরা নিজেরা যেমন ধার্মিকতাকে লালন করবো, তেমনি পরবর্তী প্রজন্মকেও এই অমৃত কর্মে যোগদানের জন্য অনুপ্রাণিত করবো। আমাদের এই সুন্দর, সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে উঠেছে আমাদের ধর্মের  আদর্শের কারণে। বহির্বিশ্বের পরিবারহীন, বৃদ্ধাশ্রম কিংবা চাইল্ড কেয়ার হোম ভিত্তিক ব্যবস্থা কখনো আমাদের জন্য আদর্শিক সমাজ গড়তে সহায়ক নয় বরং বিপরীত ভূমিকা পালন করবে। সেজন্য, সকলে নিজ পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহমর্মিতা অনুভব করি। কারণ, সে পিতামাতা আমাদের শ্রেষ্ঠ ঐশ্বরিক উপহার।

🔎Run with #veda 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

🔸সনাতন ধর্ম ও নারী 💐

সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️

▪️একাদশী" কি শাস্ত্র সম্মত ❓