পঞ্চ মহাযজ্ঞ কি ⁉️


পঞ্চমহাযজ্ঞ :
যজ্ঞ শব্দের অর্থ ব্যাপক। সংস্কৃতে য়জ ধাতু থেকে যজ্ঞ শব্দ উৎপন্ন হয়। এর অর্থ হলো সংকল্প। যেকোনো শুভ কর্ম বা কল্যাণকামী কর্মের জন্য ব্রতী হওয়াকে যজ্ঞ বলা হয়। পবিত্র বেদ অনুসারে প্রত্যেক পাঁচটি মহাযজ্ঞের বিধান রয়েছে। যা প্রত্যেক মনুষ্য তথা বৈদিক বা আর্য জন্য অবশ্য পালনীয়। সে পঞ্চমহাযজ্ঞ গুলো হলো:
১. ব্রহ্মযজ্ঞ ২. দেবযজ্ঞ ৩. পিতৃযজ্ঞ ৪. নৃযজ্ঞ
৫. অতিথি যজ্ঞ

ব্রহ্মযজ্ঞ:- পবিত্র বেদ অনুসারে দ্বি সন্ধ্যা ঈশ্বরের উপাসনা করাই হলো ব্রহ্মযজ্ঞ। অর্থাৎ, প্রাতঃকালে এবং সন্ধ্যায় যে উপাসনা তাই ব্রহ্মযজ্ঞ। ব্রহ্মযজ্ঞ পালন বিষয়ে পবিত্র বেদ এ উল্লেখ রয়েছে যে,

"সায়ং সায়ং গৃহর্পতির্নো অগ্নিঃ প্রাতঃ প্রাতঃ সৌমনসস্য দাতা বসোর্বসোর্বসুসান এধিবয়ংত্বেন্ধানাস্তন্বং পুষেম"।। -অথর্ববেদ ১৯/৫৫/৩

অর্থাৎ, হে পরমাত্মা! সর্বদা আপনিই আমাদেরকে ধন ও উত্তম সুখ প্রদান করেন। সন্ধ্যা এবং প্রাতঃকালে আপনার স্তুতি করে আমরা নিজেদের কে পবিত্র ও শরীরকে পুষ্ট করি।

"যুঞ্জন্তি ব্রধ্মমরুষং চরন্তং পরিতস্থুষঃ। রোচন্তে রোচনা দিবি"।। - ঋগ্বেদ ১/৬/১

অর্থাৎ, বিদ্বানের ব্রহ্মযজ্ঞ বা উপাসনা যোগ দ্বারা স্বীয় আত্মাকে মহান, হিংসারহিত, সর্বজ্ঞ, সর্ব্বব্যাপী পরমাত্মার সহিত যুক্ত করেন। তাহাদের আত্মা অবিদ্যা অন্ধকার থেকে মুক্ত হইয়া জ্যোতির্ম্ময় পরমাত্মার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়।

দেবযজ্ঞ:- অগ্নিকুন্ডে ধুপ, ঘি ইত্যাদি উৎসর্গ করে প্রকৃতি এবং আবহাওয়া ও পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য ব্রত গ্রহন করাকে দেবযজ্ঞ বলা হয়। দেবযজ্ঞ এর অপরনাম অগ্নিহোত্র, হবন, যজ্ঞ।

"সমধাগ্নিং দুবস্যত ঘৃতৈর্বোধয়াতিথিম্।
অস্মিন্ হব্যা জুহোতন"।। - ঋগ্বেদ ৮/৪৪/১

অর্থাৎ, হে মনুষ্য! ঘৃতাদি শুদ্ধ দ্রব্যের সহিত কাষ্ঠ দ্বারা অগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত কর। এই অগ্নিতে পুষ্টি, মধুর সুগন্ধি, রোগনাশক পদার্থের বিশেষভাবে আহুতি প্রদান কর। এই দেবযজ্ঞ পালন কর।

পিতৃযজ্ঞ: জীবিতাবস্থায় পিতা-মাতা ও গুরুজনদের সেবা ও শ্রদ্ধা করা হলো পিতৃযজ্ঞ। পিতৃযজ্ঞ দুইভাগে বিভক্ত। যথা:- ১. তর্পন ২. শ্রাদ্ধ

তর্পন: যেসব কর্মদ্বারা বিদ্ধান্রুপ দেব, ঋষি, পিতর [পিতা-মাতা ও গুরুজন] কে সুখী ও সন্তুষ্ট করা হয় তাকেই তর্পন বলে।
"পিতৃযজ্ঞস্তু তর্পনং" - মনুসংহিতা ৩/৭০

শ্রাদ্ধ: সেই পুজ্য ব্যাক্তিদের শ্রদ্ধার সহিত সেবা করাকেই শ্রাদ্ধ বলে।

সংশয় নিবারণ: বর্তমান প্রচলিত সমাজে তর্পন ও শ্রাদ্ধ মৃত ব্যক্তিদের করা হয়। যা শাস্ত্র মতে গ্রহণীয় নয় কারণ মৃত্যুর পর জীবাত্মা সেবা গ্রহণ করতে পারে না। তাই  মৃত ব্যক্তির প্রতি তর্পন ও শ্রাদ্ধ প্রদান সম্ভব নয়। জীবিত অবস্থায় পিতা মাতা ও গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল চিত্তে সম্মান করা প্রত্যেক মনুষ্যের উচিত। এটা পিতৃযজ্ঞ।

উর্জং বহন্তীরমৃতং ঘৃতং পয়ঃ কীলালং পরিশ্রুতম্।
স্বধাস্থ তর্পয়ত মে পিতৃন্।। - যজুর্বেদ ২/৩৪

অর্থাৎ, আমরা প্রত্যেকে জীবিত পিতা মাতা, গুরুজন ও বিদ্বান পুরুষদিগকে উত্তম রস, সুস্বাদু জল, সুমিষ্ট রোগনাশক পদার্থ, দুগ্ধ, ঘৃত, সুরন্ধিত অন্ন ও সুপক্ব রসাল ফল দ্বারা তৃপ্ত করিবব। পরধনে লোভ না করিয়া নিজধনে তৃপ্ত থাকিব।

অতিথি যজ্ঞ: যিনি পূর্ন বিদ্ধান, পরোপকারী জিতেন্দ্রিয়,ধার্মিক, সত্যবাদী ছল-কপট রহিত,নিত্য ভ্রমনকারী মনুষ্য তাদের অতিথি বলা হয়। অতিথি গৃহে আসলে তাকে সম্মান প্রদর্শন করা এবং তার সেবা করা হলো অতিথি যজ্ঞ। সনাতনধর্মে এজন্য বহুল প্রচলিত একটি বাক্য রয়েছে, "অতিথি দেবঃ ভবঃ"।

" ইষ্টং চ বা এষ পূর্তং চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।।
পয়শ্চ বা এষ রসং চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।।
ঊর্জাং চ বা এষ স্ফাতিং চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।।
প্রজাং চ বা এষ পশুংশ্চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।।
কীর্তিং চ বা এষ যশশ্চগৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।।
শ্রিয়ং চ বা এষ সংবিদং চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।।
এষ বা অতিথির্যচ্ছ্রোত্রিয়স্তস্মাৎ পূর্বো নাশ্নীয়াৎ।।
অশিতাবত্যতিথাবশ্নীয়াদ্ যজ্ঞস্য সাত্মত্বায় যজ্ঞস্যাবিচ্ছেদায় তদ্ ব্রতম"।।-অথর্ববেদ ৯/৬/৩/১-৮

অর্থাৎ, যে গৃহস্থ অতিথির পূর্বে ভোজন করেন তিনি গৃহের ইষ্টসুখ, পূর্ণতা, দুগ্ধ, রস, পরাক্রম, বৃদ্ধি, সন,পশু, কীর্তি, যশ, শ্রী এবং জ্ঞান ভোজন করেন। যিনি বেদজ্ঞানী, তিনিই অতিথি। সুতরাং অতিথির পূর্বে ভোজন করিবে না। অতিথির ভোজনের পর তিনি ভোজন করিবেন। শুভ কর্মময় জীবনের জন্য এবং তাহা নিরন্তর চালাইবার জন্য ইহাই নিয়ম।

নৃযজ্ঞ: বিভিন্ন পশু পাখি বা প্রাণী , অত্যন্ত দরিদ্র ব্যক্তি, কুষ্ঠাদি ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীকে সহ ইত্যাদির জন্য খাদ্যদ্রব্যের ছয়ভাগের একভাগ করে দেওয়া ও সদা প্রসন্ন রাখায় হলো নৃযজ্ঞ। বিশ্ব প্রকৃতি, দরিদ্র সকল মানুষের প্রতি প্রেমের শিক্ষা দেয় পবিত্র বেদ। আর ইহা নৃযজ্ঞ।

"প্রজাভ্যঃ পুষ্টিং বিভজন্ত আসতে রয়িমিব পৃষ্ঠং প্রভবন্তমায়তে।
অসিন্বন্দংষ্ট্রৈঃ পিতুরত্তি ভোজনং যস্তাকৃণোঃ প্রথমং সাস্যুকথ্যঃ"।। - ঋগ্বেদ ২/১৩/৪

অর্থাৎ, যেমন গৃহে আগত সৎ পুরুষের জন্য ধারক ও পোষক ধনকে গৃহস্থ বিভাগ করিয়া দেন, পুত্র পিতৃগৃহে যেমন ভোজন করে তেমনি হে ভগবন্! গৃহমেধী ভক্তেরা তোমার প্রদত্ত পোষক ধনকে প্রজাদের মধ্যে পরস্পর বিভাগ করিয়া নিজ নিজ গৃহে সুখে বাস করেন। যিনি এই সুখকর কর্মের বিধান করিয়াছেন সেই তুমিই আমাদের একমাত্র উপাস্য দেব।

"পর্যস্তাং পৃথিবীং সর্বাং সাশ্বাং সরথকুঞ্জরাম্ ।
যোমোচয়েন্মৃত্যুপাশাৎপ্রাপ্নুয়াদ্ধর্মমুত্তমম্" ॥
- মহাভারত ৫/৯৩/৬

অর্থাৎ,  যে ব্যক্তি কাউকে প্রাণে রক্ষা করে, এমনকি পশুপাখির প্রাণও রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র পৃথিবীকে মৃত্যুপাশ থেকে মুক্ত করে উত্তম মর্যাদা লাভ করে।


পবিত্র বেদ অনুসারে আমাদের জীবনে অন্যতম পালনীয় কর্তব্য হলো পঞ্চ মহাযজ্ঞ। পঞ্চ মহাযজ্ঞ একজন বৈদিককে স্মরণ করিয়ে দেয় তার কি করণীয় ঈশ্বর, পিতামাতা, জীবকুল এবং অতিথির প্রতি। এমন মানবতাবোধ একজন মনুষ্য তথা বৈদিকের অবশ্যই পালনীয় বিধি। কারণ তা ঈশ্বর কতৃক পবিত্র বেদ এ উল্লেখ রয়েছে। আর যা পবিত্র বেদ এ রয়েছে তাহাই ধর্ম "বেদ অখিলো ধর্মমূলম"। এজন্য হে মনুষ্য! ফিরে এসো বেদ এর পথে। বেদ বানীতে উজ্জীবিত হয়ে ধর্মাচরন করো এবং হয়ে উঠো প্রকৃত মানুষ ও বৈদিক।

🔎Run with #veda 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

🔸সনাতন ধর্ম ও নারী 💐

সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️

▪️একাদশী" কি শাস্ত্র সম্মত ❓