পরমাত্মাকে কি সম্পূর্ণ রুপে জানা যায় ⁉️
পরমাত্মাকে কি সম্পূর্ণ রুপে জানা যায় ⁉️
পরমাত্মা সর্বজ্ঞানী, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশক্তিমান ও সর্বব্যাপী। এই জগতে এমন কোনো পদার্থ বিদ্যমান নেই, যা পরমাত্মার অসীম বৈশিষ্ট্যর তুল্য হতে পারে। আমরা সেই পরমব্রহ্মকে সর্বদা জানার প্রয়াস করি, তাহার মহিমা উপলব্ধির চেষ্টা করি। কারণ জগতের সকল শক্তি, জ্ঞান, গুণাবলির উৎস পরমেশ্বর। অগ্নি, বায়ু আদি প্রাকৃতিক শক্তির উৎস স্বয়ং পরমাত্মা। ঈশ্বর সার্মথ্য ব্যতীত অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হতে পারে নাহ, বায়ু গতিশীল হয় নাহ। উদাহরণস্বরূপ, আমরা এই সৌরজগতে স্বপ্রকাশ নক্ষত্র হিসেবে সূর্যকে উদ্ধৃত করি। কিন্তু সেই সূর্যের শক্তি কখনো শূন্য থেকে আসে না। বরং, সে সূর্যের শক্তির উৎস একমাত্র পরমাত্মা।
সেজন্য কঠোপনিষদে ঋষি বলছেন,
"তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি" - কঠ ২/২/১৫
অর্থাৎ, সেই পরমেশ্বরের প্রকাশ দ্বারাই সূর্যাদি প্রকাশিত হয়ে থাকে।
পরমাত্মা অন্তর্যামী এবং সর্বজ্ঞ। এই জগতের সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয় তিনি জানেন। আমরা সকলে তাহার প্রদানকৃত জ্ঞানেই নিজের জ্ঞান শূন্যতাকে পূরণ করার চেষ্টা করি। তবে সে সকল জ্ঞানের উৎস স্বরুপ পরমাত্মাকে আমরা কখনো সম্পূর্ণ রুপে জানতে সক্ষম নাহ৷ সে সত্যের উদ্ধৃতি দিয়ে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে,
"স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা" - শ্বেতা ৩/১৯
অর্থাৎ, ব্রহ্ম এই বিশ্বের সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয় জানেন, অথচ তাকে পূর্ণরুপে জানে এমন কেউ নেই।
কিন্তু কেন সে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ রুপে জানা যায় নাহ ⁉️ কারণ জীবাত্মা সে পরমাত্মার জ্ঞানেই জ্ঞানান্বিত হয়। পরমাত্মা বিদ্যা প্রদান করেছেন বলেই আমরা জ্ঞানী হতে পারি। তবে সে সর্ব জ্ঞানের উৎস স্বয়ং পরমাত্মাকে সম্পূর্ণরুপে জানা কদাপি সম্ভব হতে পারে? যজুর্বেদ এ বলা হয়েছে,
"পাদোহস্য বিশ্ব ভূতানি" - যজু ৩১/৩
অর্থাৎ, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তো ব্রহ্মের এক পাদ।
অতএব এই ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধেই আমাদের পূর্ণ জ্ঞান নেই, তাহলে সে মহান জগত স্রষ্টা ব্রহ্মের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান প্রাপ্ত করা সম্ভব নয়। এই সত্যকে আমাদের অকপটে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু কখনো দাম্ভিকতার সুরে এরুপ বলা উচিত হবে নাহ যে, আমি ব্রহ্মকে জানি। এরুপ ধারণা পোষণ করার মাধ্যমে আমরা অজ্ঞানতা ও দাম্ভিকতার গহ্বরে পতিত হই। যজুর্বেদ এ এই সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটে।
"ন তং বিদাথ য়হইমা জজানন্যদ্যুষ্মাকমন্তরং বভূব।
নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যা চাসুতৃপহউক্থশাসশ্চরন্তি।।"
- যজু ১৭/৩১
অর্থাৎ, হে মনুষ্য! যে ব্রহ্ম এই সমস্ত ভুবনের উৎপন্নকারী বিশ্বকর্মা, যিনি এই কার্য-কারণরুপ জগৎ ও জীব থেকে পৃথক হয়েও সবার মধ্যে বিরাজমান, সেই ব্রহ্মকে তুমি জানো না। অজ্ঞানরুপ অন্ধকারের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে, মিথ্যাবাদ ও নাস্তিকতার বৃথা তর্কে লিপ্ত হয়ে নিজ প্রাণ পোষণে সংলগ্ন ব্যক্তিগণ, যারা কেবল শব্দের আবৃত্তি করে, তারা এই সংসারে ইতস্তত ভ্রমণ করে, কিন্তু সেই ব্রহ্মকে জানতে পারে না।
তবে এই জগতের সমস্ত জ্ঞান ও শক্তির নিয়ন্তাকে কি জানা সম্ভব নয়? নাহ! এমন নয়। ব্রহ্মকে পূর্ণরুপে জানা যায় নাহ তবে ব্রহ্মকে জানার প্রয়াসের মাধ্যমে তাহার জ্ঞান হয়। দাম্ভিক হয়ে ব্রহ্মকে জানি এমন বলা উচিত নয়, কারণ তাকে পূর্ণরুপে জানা জীবাত্মা জন্য অসম্ভব। কিন্তু তাহাকে জানার প্রয়াস করতে করতে যখন এই উপলব্ধি হয় যে এই অসীম ব্রহ্মকে জানা যায় নাহ তখনই অবগত হওয়া সম্ভব যে, তাহার কিঞ্চিৎ জ্ঞান হয়েছে সেই পরমব্রহ্ম সম্বন্ধে।
য়স্যামতং তস্য মতং মতং য়স্য ন বেদ সঃ।
অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাম্ ॥
- কেন ২/৩
অর্থাৎ, ব্রহ্মকে পূর্ণরূপে জানা যায় না- এরূপ যাঁর মত, তাঁরই ব্রহ্ম সম্পর্কে জ্ঞান হয়েছে। যার এই গর্ব যে, তিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন, তিনি ব্রহ্মকে জানেন না। এভাবে যিনি ব্রহ্মজ্ঞানের অহংকার করেন, তার ব্রহ্ম সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান হয় না, আর যিনি ব্রহ্মজ্ঞানের অহংকার করেন না, তাঁরই ব্রহ্ম সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান হয়।।
ধারণাটি কিঞ্চিৎ গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস এর উক্তির মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব যে, "আমি অনেক কিছু জানি, তবে কিছুই জানি নাহ" সত্যিকার অর্থে যে প্রকৃত জ্ঞানী সে কখনো জ্ঞান এর দাম্ভিকতা দেখায় নাহ। বরং সে উপলব্ধি করে সে কিছুই জানে নাহ। এরুপই, যে প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী সে ব্রহ্মের সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন হওয়ার পরেও সে উপলব্ধি করে যে ব্রহ্মকে জানা যায় নাহ।
তবে কেন ব্রহ্মের সম্পর্কে জানা আবশ্যক? মানব জীবনের পরম পুরুষার্থ বা চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মোক্ষপ্রাপ্তি। যজুর্বেদ এ স্পষ্ট বলা, এই মনুষ্য দেহ প্রাপ্তির কারণ উত্তম কর্ম ও ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য।
"ইয়ং তে যজ্ঞিয়া তনুর" - যজুঃ ৪/১৩
অর্থাৎ হে মনুষ্য! তোমাদের এই শরীর যজ্ঞাদি উত্তম কর্মের এবং ঈশ্বর-প্রাপ্তি করার জন্য।
মোক্ষ অর্জনের পথে আমাদের বাধা দুঃখ, জন্ম, প্রবৃত্তি, দোষ ও মিথ্যাজ্ঞান। যা আমাদের কর্মের বন্ধন ও এই illusion বা মায়ায় জড়িয়ে রাখে।
"দুঃখজন্মপ্রবৃত্তিদোষ-মিথ্যাজ্ঞানানামুত্তরোত্তরাৎপায়ে তদনন্তরাপায়াদপবর্গঃ।" - ন্যায় ১১/২
অর্থাৎ, দুঃখ, জন্ম, প্রবৃত্তি, দোষ ও মিথ্যাজ্ঞান, এই পাঁচটির উত্তরোত্তর ক্ষীণ হওয়ার পর যে দুঃখের নাশ হয়, সেই দুঃখের অভাবের কারণে মোক্ষলাভ হয়।
ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা মনুষ্য এই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে। সেজন্য, আমাদের মোক্ষ অর্জনের জন্য পরমাত্মাকে জানা আবশ্যক।
"প্রতিবোধবিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।
আত্মনা বিন্দতে বীর্য়ং বিদ্যয়া বিন্দতে মৃতম্ ॥
- কেন ২/৪
অর্থাৎ, প্রতিবোধ দ্বারা প্রাপ্ত ব্রহ্মজ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান; এই ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা মুক্তিকামী মনুষ্য জীবন্মুক্ত দশা প্রাপ্ত হন। তিনি আত্মস্বরূপের জ্ঞান দ্বারা যোগবল লাভ করেন এবং ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা মোক্ষপ্রাপ্ত হন॥৪॥
প্রতিবোধ: "ইন্দ্রিয়সমূহকে নিজ-নিজ বিষয় থেকে নিরোধ করে অন্তঃকরণে ধারণা, ধ্যান, সমাধিরূপ সংযম দ্বারা যে জ্ঞানের তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, সেগুলো গ্রহণ করাকে 'প্রতিবোধ' বলা হয়।"
"ইহ চেদবেদীদথ সত্যমস্তি ন চেদিহাবেদীন্মহতী বিনষ্টিঃ।
ভূতেষু ভূতেষু বিচিত্য ধীরাঃ প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি॥" - কেন ২/৫
যদি এই মানব-জীবনে ব্রহ্মকে জানা যায় তবেই মানব-জন্ম সার্থক হয়। যদি এই জন্মে ব্রহ্মকে না জানা যায়, তবে অত্যন্ত দুর্গতি হয়। এজন্য ধ্যানশীল যোগিগণ সমস্ত চরাচর জগতে ব্রহ্মের চিন্তন করে এবং তাঁকে উপলব্ধি করে এই প্রত্যক্ষ সংসার থেকে প্রয়াণ (দেহত্যাগ) করে জন্ম-মৃত্যুরূপ দুঃখ থেকে মুক্ত হন অর্থাৎ মোক্ষলাভ করেন ॥৫॥
সেজন্য, হে অমৃতের সন্তানগণ! আমরা অল্পজ্ঞ। কিন্তু আমাদের সর্বদা সেই অসীম জ্ঞান এর ধারক পরমাত্মাকে জানার প্রয়াস করা উচিত। তবে আমরা এই দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে পরম-পদ প্রাপ্ত হতে পারি।
🔎run with #veda
মন্তব্যসমূহ