অথত্রিবিধদুঃখ্যাত্যন্তনিবৃত্তিরত্যন্তপুরুষার্থঃ॥"
[সাংখ্য দর্শন ১/১]
পদ পাঠ—
"অথ । ত্রিবিধদুঃখ্যাত্যন্তনিবৃত্তিঃ । অত্যন্তপুরুষার্থ"
অর্থাৎ তিন প্রকাররের দুঃখ অত্যন্তভাবে নিবৃত্তি হয়ে যাওয়া প্রাণীমাত্রের মূল উদ্দেশ্য৷
জীব ফল ভোগ করার জন্য পরতন্ত্র।অর্থাৎ কর্ম আমাদের অধীন কিন্তু ফলপ্রাপ্তি ঈশ্বরাধীন।নিজস্ব সামর্থের অনুকূল কর্ম করতে জীব সতন্ত্র কিন্ত যখন সে পাপ করে থাকে তখন ঈশ্বরের ব্যবস্থাতে পরাধীন হয়ে পাপের ফলকে ভোগ করে।মানুষ কর্ম করলে সেই ফল কিভাবে পাবে?একটি কর্মের ফল অপর কর্মের ফলকে বাঁধা দিয়ে নীট ফলাফল শূন্য করে কি না এধরণের প্রশ্ন সর্বদা আমাদের মনে উদয় হয়।কর্মফল বিষয়ক উপর্যুক্ত প্রশ্ন গুলোর বিষয়ে মহর্ষি জৈমিনি তাঁর বিখ্যাত দর্শন গ্রন্থ মীমাংসা দর্শনে বলেছেন–
🌿"নিয়মো বা তন্নিমিত্তত্বাৎ কর্তুস্তৎকারণং স্যাৎ॥"
[মীমাংসা দর্শন ৬/২/১৫]
সরলার্থ— জীবের ভোগ (ফল) পূর্ব কর্ম অনুসারে প্রাপ্ত হয়।কিন্তু জীব কর্ম করায় স্বতন্ত্র হয়ে থাকে।এরূপ নিয়ম অর্থাৎ ব্যবস্থা রয়েছে।বর্তমানে ক্রিয়ামান কর্ম পূর্ব কর্ম ভোগ করার নিমিত্তে হতে পারে।তাই পূর্ব কর্মের ভোগ ক্রিয়ামান কর্মের বাধক হয় না।
অর্থাৎ মহর্ষি জৈমিনির উক্ত সূত্র থেকে আমরা নিম্নোক্ত কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি কর্ম দুই প্রকার।পূর্ব কর্ম ও ক্রিয়ামান কর্ম।কর্ম করার ক্ষেত্রে জীব স্বাধীন।বর্তমান কর্ম পূর্ব কর্ম ভোগের নিমিত্ত "হতে পারে" অর্থাৎ বর্তমান কর্ম সর্বাদাই যে পূর্ব কর্মের নিমিত্ত,তা নয়।কিন্তু হঠাৎ কোনো বর্তমান কর্ম পূর্ব কর্মের নিমিত্ত রূপে কাজ করতে পারে।পূর্ব কর্মের ফল বর্তমান কর্মকে বা তার ফলকে বাধা দেয় না অর্থাৎ বর্তমান কর্মের ফল দ্বারা পূর্ব কর্মের ফল নাশ হয়ে নিউট্রাল হয় না।এগুলোকেও কোনো একসময় পূর্বকর্মের ফল হিসেবে ভোগ করতে হয় অর্থাৎ সারাজীবন পাপ করে শুধু মাত্র একটি তওবা বা প্রায়শ্চিত্ত আপনাকে সেইসব পাপ কর্মের হাত থেকে বাঁচাবে না।যদি বাঁচাতো তবে একটি কর্ম অপর কর্মের বাধক হয়ে যেত৷বৈদিক সিদ্ধান্ত হলো সৃষ্টি কার্যক্রম প্রবাহরূপ অনাদি।সৃষ্টির পূর্বে প্রলয় ও প্রলয়ের পশ্চাৎ সৃষ্টি— এই ক্রম অনাদি।পরমাত্মার এই সৃষ্টির নিয়মও সেটাই যেটা পূর্বকল্পগুলিতে ছিলো।ঈশ্বর তার ব্যবস্থাকে ভঙ্গ করেন না।কেননা সত্য অনাদি চিরন্তন।
🌿বেদ বলছে—
🌿 সত্যধর্মা"
অথর্ববেদ ৭/২৪/১]
অর্থ—পরমাত্মা সত্যের ধারক।
🌿
"সূর্যাচন্দ্রমসৌ ধাতা যথাপূর্বমকল্পয়ৎ।
দিবং চ পৃথিবীং চান্তরিক্ষমথো স্বঃ।।"
[ঋগ্বেদ ১০/১৯০/৩]
অর্থ— যেভাবে পূর্বকল্পে সূর্য,দ্যুলোক,পৃথিবী এবং অন্তরীক্ষ তথা লোক লোকান্তর রচিত হয়েছে তেমনি এই কল্পেও রচিত হয়েছে।
🌿ঋতং চ সত্যং চাভীদ্ধাত্তপসোঽধ্যাজায়ত"
ঋগ্বেদ ১০/১৯০/১]
অর্থ— সত্য এবং ব্যবস্থার আবির্ভাব সেই সর্বজ্ঞ ও ক্রিয়াশীল পরমাত্মা কর্তৃক।
ঈশ্বরের অটল নিয়মে বিশ্বাসই মানুষকে আশাবাদী,উত্তরবাদী,সাহসী ও প্রগতীশীল করতে পারে।যদি এটা মেনে নেয়া হয় কর্মফল মিথ্যা বা ঈশ্বর চাইলে এই নিয়ম ভেঙ্গে ফেলতে পারেন তাহলে তা ঈশ্বরের স্বভাববিরুদ্ধ।যদি সৃষ্টির নিয়মই পরিবর্তন হয়ে যায় তাহলে কর্তার কর্মফল অনিশ্চিত হয়ে যাবে। সুকর্মকারী ব্যক্তি হতাশ,নিরাস ও উদাস হয়ে যাবে একইসাথে দুষ্কর্মকারী পরিস্থিতির আড়ালে পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ঘোর থেকে ঘোরতর অত্যাচারী হয়ে উঠবে।যেখানে অন্তঃস্থিতি বলবতী হয় সেখানে সুখ ও শান্তি নিবাস করে,যেখানে পরিস্থিতি বলবতী হয় সেখানে অন্যায়,অত্যাচার ও দুঃখ নিবাস করে।
বেদ বলছে—
"সূর্যং চক্ষুর্গচ্ছতু বাতমাত্মা দ্যাং চ গচ্ছ পৃথিবীং চ ধর্মণা।
অপো বা গচ্ছ যদি তত্র তে হিতমোষধীষু প্রতি তিষ্ঠা শরীরৈঃ।।"[ঋগ্বেদ ১০/১৬/৩]
25fcপদ পাঠ—
"সূর্যম্ । চক্ষুঃ । গচ্ছতু । বাতম্ । আত্মা । দ্যাম্ । চ । গচ্ছ । পৃথিবীম্ । চ । ধর্মণা । অপঃ । বা । গচ্ছ । যদি । তত্র । তে । হিতম্ । ওষধীষু । প্রতি । তিষ্ঠ । শরীরৈঃ ।।"
পদার্থ— হে মনুষ্য! মৃত্যুর পর (চক্ষুঃ) চক্ষু (সূর্যম্) সূর্যকে অর্থাৎ সূর্যের উজ্জ্বল জ্যোতিস্বরূপ দিব্যগুণযুক্ত রশ্মিকে (আত্মা) এবং আত্মা (বাতম্) প্রাণবায়ুকে (গচ্ছতু) প্রাপ্ত হয়ে (ধর্মণা) কৃত কর্মানুসারে (শরীরৈঃ) শরীর ধারণপূর্বক কেউ (দ্যাম্ চ) দ্যুলোক তথা ভিনগ্রহ এবং কেউ (পৃথিবীম্) পৃথিবীলোক (গচ্ছ) প্রাপ্ত হয়। (অপঃ বা) জলজ স্থান অথবা (ওষধীষু) ঔষধি ও বৃক্ষাদি (গচ্ছ) প্রাপ্ত হয়ে (প্রতি তিষ্ঠ) স্থিতি লাভ করে (যদি) যদি (তত্র) সেই স্থান প্রাপ্তিই (তে) তার (হিতম্) কর্মফল হয়ে থাকে।
অনুবাদ— হে মনুষ্য! মৃত্যুর পর চক্ষু সূর্যকে অর্থাৎ সূর্যের উজ্জ্বল জ্যোতিস্বরূপ দিব্যগুণযুক্ত রশ্মিকে এবং আত্মা প্রাণবায়ুকে প্রাপ্ত হয়ে কৃত কর্মানুসারে শরীর ধারণপূর্বক কেউ দ্যুলোক তথা ভিনগ্রহ এবং কেউ পৃথিবীলোক প্রাপ্ত হয়,জলজ স্থান অথবা ঔষধি ও বৃক্ষাদি প্রাপ্ত হয়ে স্থিতি লাভ করে যদি সেই স্থান প্রাপ্তিই তার কর্মফল হয়ে থাকে।
জীব কর্মফল অনুযায়ী দেহধারণ করে প্রাণবায়ুকে প্রাপ্ত হয়।কেউ কেউ পৃথিবীতে শরীর ধারণ পূর্বক জন্ম নেয় আবার কেউ কেউ দ্যুলোক তথা অন্য কোনো গ্রহে শরীর ধারণপূর্বক জন্ম নেয়।কেউ জলজ প্রাণীরূপে আবার কেউ ঔষধি ও বৃক্ষাদিরূপে শরীর ধারণপূর্বক জন্ম নেন।এই সবই কর্মফল মাত্র।
সং— কর্মের ফলভোগের জন্য দেহ সকলের সমান হওয়া উচিত কিন্তু ভেদ কেন?
🌿"ত্রিধা ত্রয়ানাং ব্যবস্থা কর্মদেহোপভোগদেহভয়দেহাঃ॥"
[সাংখ্য দর্শন ৫/১২৪]
🌿পদ পাঠ—
"ত্রিধা ত্রয়ানাং । ব্যবস্থা । দ কর্মদেহোপভোগদেহভয়দেহাঃ॥"
সরলার্থ— কর্মদেহ,ভোগদেহ,কর্ম ও ভোগ উভয় দেহ এই তিন প্রকার স্থূল শরীরে কর্মের এবং ভোগের ব্যবস্থা আছে।এরা উত্তম,মধ্যম ও অধমভেদে তিন ভাগে বিভক্ত।যা উত্তম তা কেবল কর্মদেহ— যে দেহে জীব কর্ম করে কিন্তু বৃত্তীয়রহিত হওয়ায় ও বাসনা না থাকায় সে কর্মে লিপ্ত হয় না ও তার কর্মফলও প্রস্তুত হয় না।যেমন মুক্ত জীবাত্মার সাংকল্পিক শরীর তাই কর্মদেহ।মুক্ত পুরুষ ধর্ম স্থাপনের জন্য ও অধর্মের নাশের জন্য জন্মের নিয়ম অনুযায়ী শরীর ধারণ করেন কিন্তু তার পূর্ব পূর্বজন্মের বুত্থান সংস্কার না থাকা হেতু কোনো কর্মই তার সকাম নয় এবং ফল উৎপাদন করে বন্ধনের কারণ উৎপন্ন করে না।তিনি স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী নিষ্কাম কর্ম করে থাকেন এবং ইচ্ছা করলেই মুক্তির অবস্থানে যেতে পারেন কারণ মুক্ত অবস্থায় তার জ্ঞানের বিভৃতি স্থির থাকায় এবং কোনরূপ বৃত্তি না থাকায় কোনো কর্মই তাকে লিপ্ত করতে পারে না।যা মধ্যম দেহ তা কর্ম ও ভোগ দেহ— যেমন সাধারণ মানুষের শরীর— যেখানে বুত্থান সংস্কার বজায় থাকায় কর্ম ও কর্মফলের সৃষ্টি এবং ভোগ হয়ে থাকে।যা অধম দেহ তা কেবলই ভোগ দেহ যেমন পশু আদি ইতর প্রাণীদের দেহ যেখানে জ্ঞানের কোনো বিকাশ না থাকায় জ্ঞানের অভাব প্রযুক্ত সহজাত সংস্কারের দ্বারা চালিত হয়ে জীব কর্ম করে বলে তার ভালোমন্দ কোনো কর্মফলের সৃষ্টি হয় না কেবল পূর্ব পূর্বজন্মের কর্মফল ভোগ হয়ে থাকে।
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ