সনাতন ধর্ম ও জন্মান্তরবাদ
➡️ সনাতন ধর্ম তাহাই মান্যতা দেয় যা সত্য এবং যথোপযুক্ত। অযৌক্তিক কিংবা বিচারবিহীন ভাবে কোনো কিছু অধ্যয়ন, গ্রহণ, পালন এর উপদেশ সনাতন শাস্ত্র সমূহে নেই। একমাত্র সনাতনধর্মে ঈশ্বর মনুষ্যের উদ্দেশ্যে বিচার-বিশ্লেষণ পূর্বক সত্যকে গ্রহণের উপদেশ প্রদান করেছেন। অথর্ববেদে সেজন্য বলা হয়েছে,
प॒दोर॑स्या अधि॒ष्ठाना॑द्वि॒क्लिन्दु॒र्नाम॑ विन्दति। अ॑नाम॒नात्सं शी॑र्यन्ते॒ या मुखे॑नोप॒जिघ्र॑ति ॥
=[]অথর্ববেদ ১২।৪।৫[]=
“যিনি বেদবাণীকে যথার্থ বিচারপূর্বক গ্রহণ করেন তিনিই সুখ ভোগ করেন আর যিনি তার বিপরীত কাজ করেন তিনি দুঃখ ভোগ করেন।”
ऊ॒र्जे त्वा॒ बला॑य॒ त्वौज॑से॒ सह॑से त्वा। अ॑भि॒भूया॑य त्वा राष्ट्र॒भृत्या॑य॒ पर्यू॑हामि श॒तशा॑रदाय ॥
=[]অথর্ববেদ ১৯।৩৭।৩[]=
“ঈশ্বরকে তর্ক দ্বারা নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করেই গ্রহণ করো।”
➡️ সনাতন ধর্মে ত্রৈতবাদ, কর্মফল এর মতো জন্মান্তরবাদ বা পুনর্জন্মের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বীয় কর্মফল ভোগের জন্য পুনরায় দেহ ধারণ করাকে পুনর্জন্ম বলা হয়। বর্তমান সময়ে জন্মান্তরবাদ নিয়ে কিছু সংশয় এর উত্থান ঘটেছে। যা সাধারণ মনুষ্যের নিকট জন্মান্তরবাদ বা পুনর্জন্মের ধারণাকে অবাস্তব এবং অগ্রহণযোগ্য করে তুলছে। যে সকল অপপ্রচারকারী পুনর্জন্মের সত্যতা অস্বীকার করে তারা কিছু সংশয় প্রকাশ করে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
🌼 সনাতন শাস্ত্রে পুনর্জন্মের উল্লেখ রয়েছে কি?
🌼 পুনর্জন্মের যৌক্তিক প্রমাণ কি?
সনাতন শাস্ত্র ও জন্মান্তরবাদ:
সনাতন শাস্ত্রসমূহ আমাদের নিকট কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ণয়ের প্রধান নিয়ামক। যাহা শাস্ত্র বিরুদ্ধ তা পালন কিংবা অনুসরণ ব্যক্তির জন্য মোক্ষ অর্জনের পথে সহায়ক নয়। এরুপ তত্ত্বের উল্লেখ যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় করেছেন,
"যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ। নস সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্" ॥ ২৩
"তস্মাচ্ছাস্ত্ৰং প্রমাণং তে কাৰ্যাকার্যব্যবস্থিতৌ। জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কৰ্ম কতুমিহাহসি" ॥ ২৪
গীতা =[১৬/২৩-২৪]=
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া কর্মে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না, তাহার শান্তি-সুখও হয় না, মোক্ষলাভও হয় না। অতএব কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ, সুতরাং তুমি শাস্ত্রোক্ত ব্যবস্থা জানিয়া যথাধিকার কর্ম করিতে প্রবৃত্ত হও।
সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বেদ এবং সকল শাস্ত্র সিধান্তের ভিত্তি হিসেবে সর্বদা অলঙ্ঘনীয়। পবিত্র বেদ এর বহু স্থানে পরমেশ্বর অমৃতের সন্তানদের উদ্দেশ্য ঋষিদের মাধ্যমে পুনর্জন্মের বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করেছেন। তাই পবিত্র বেদ থেকে পুনর্জন্মের উল্লেখ আবশ্যক।
=পবিত্র বেদ=
অথর্ববেদ এর ১১তম কান্ডের, ৪র্থ সুক্তের ১৪তম মন্ত্রে বলা হয়েছে,
"অপানতি প্রাণতি পুরুষো গর্ভে অন্তরা।
যদা ত্বং প্রাণ জিম্বস্যথ স জায়তে পুনঃ" ।।
=[অথর্ববেদ ১১/৪/১৪]=
পদার্থঃ- (পুরুষঃ) মনুষ্য (গর্ভে অন্তরা) গর্ভের মধ্যে (প্র অনতি) শ্বাস গ্রহণ করে (অপ অনতি) প্রশ্বাস ত্যাগ করে (যদা) যখন (ত্বং) তুমি (জিম্বসি) প্রেরণা দাও (অর্থ) তখনই (সঃ) সে (পুনঃ জায়তে) পুনরায় জন্ম গ্রহণ করে।
অর্থাৎ, মনুষ্য গর্ভের মধ্যে শ্বাস গ্রহণ করে ও প্রশ্বাস ত্যাগ করে। হে প্রাণ। যখন তুমি প্রেরণা দান করো তখনই সে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে।
পুনর্জন্মের উল্লেখ পুনরায় যজুর্বেদ এ রয়েছে,
"প্রসদ্ধ ভস্মনা যোনিমপশ্চ পৃথিবীমগ্নে। সংসৃজ্য মাতৃভিষ্ট্বং জ্যোতিষ্মান্ পুনরাসদঃ"।।
=[যজুর্বেদ১২/৩৮]=
পদার্থ -(অগ্নে) হে জীবনের প্রকাশকারী (জ্যোতিষ্মান) জ্যোতির্ময় জীবাত্মা (ভস্মনা) এই জড় শরীর ভস্মের পশ্চাৎ (ত্বম্) তুমি (পৃথিবীম্) ভূমি (চ) ও (অপঃ) জলের মধ্যে (যোনিম্) কোনো জীবযোনিকে (প্রসদ্ধ) প্রাপ্ত হও।(মাতৃভিঃ) মাতৃগর্ভে (সংসৃজ্য) সংযুক্ত হয়ে তুমি (পুনঃ) পুনরায় (আসদঃ) এই জগতে ফিরে আসো।
অর্থাৎ, হে জীবনের প্রকাশকারী জ্যোতির্ময় জীবাত্মা এই জড় শরীর ভস্মের পশ্চাৎ তুমি ভূমি ও জলের মধ্যে কোনো জীবযোনিকে প্রাপ্ত হও। মাতৃগর্ভে সংযুক্ত হয়ে তুমি পুনরায় এই জগতে ফিরে আসো।
"ও৩ম্ অসুণীতে পুনরস্মাসু চক্ষু পুনঃ প্রাণমিহ নো ধেহি ভোগ্যম্। জ্যোক্ পশ্যেম সূর্যমু্চ্চরন্তমনুমতে মুড়য়া ন স্বস্তি।।
ও৩ম্ পুনর্ন অংসু পৃথিবী দদাতৃপুনর্দৌর্দেরী পুনরন্তরিক্ষম্। পুনর্নঃ সোমস্তন্বং দদাতু পুনঃ পুষা পথ্যাং যা স্বস্তিঃ"।।
=[]ঋগ্বেদ ৮।১।২৩।৬-৭[]=
অর্থাৎ, হে সুখদায়ক পরমেশ্বর। আপনি কৃপা পূর্বক আমাদের পুনর্জন্মে উত্তম নেত্রাদি সমগ্র ইন্দ্রিয় স্থাপন করিবেন। আমরা পুনর্জন্মে প্রাণশক্তি মন বুদ্ধি চিত্ত অহংকার পরাক্রম যুক্ত শরীর যেন প্রাপ্ত হই। হে জগদীশ্বর এই জন্মে এবং পর জন্মে আমরা যেন নিরন্তর উত্তম উত্তম ভোগ প্রাপ্ত হই। হে ভগবান আপনার কৃপায় আমরা যেন সূর্য দিল আপনার বিজ্ঞান ও প্রেম সদা দর্শন উপলব্ধি করতে পারি। হে প্রভু আমাদের সমস্ত জন্মে আপনি আমাদের সুখে রাখুন আমাদের কল্যাণ হয়। ভেজ সর্বশক্তিমান! আমরা যেন পূর্ণ পূর্ণ পৃথিবী চক্ষু এবং অন্তরীক্ষ আদি সমস্ত উত্তম পদার্থ এবং পুষ্টি কারক উত্তম শরীরের অনুকূল সোম অর্থাৎ পরশুদিন প্রাপ্ত হয়। হে পুষ্টিদাতা পরমেশ্বর আমাদের সমস্ত জন্ম আমাদিগকে দুঃখ নিবারক পথ্যরূপ সুখ দান করুন।
পবিত্র বেদ জ্ঞানের আধার। ধর্মের সকল সিদ্ধান্ত ও শাস্ত্রীয় ভিত্তি হলো পবিত্র বেদ। সেই অমৃত জ্ঞানের ভান্ডারে পুনর্জন্মের জ্ঞান উল্লেখিত রয়েছে।
উপনিষদ
উপনিষদ সনাতন ধর্ম শাস্ত্র সমূহের মধ্যে অন্যতম। গুরু ও শিষ্যের মাঝে ধর্ম সিদ্ধান্ত বিষয়ক আলোচনা উপনিষদের মাঝে স্থান পেয়েছে। সেই উপনিষদের মাঝে জন্মান্তরবাদ এর ধারণার উল্লেখ রয়েছে।
"যোনিমন্যে প্রপদন্তে শরীরত্বায় দেহিনঃ"
=[]কঠ উপনিষদ ৫/৭[]=
অর্থাৎ, জীব ভোগার্থ অন্যযোনী বা পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হয়।
স বা অয়ং পুরুষো জায়মানঃ শরীরমভিসম্পদ্যমানঃ পাপ্ম্যভিঃ সংসৃজ্যতে। স উৎক্রমান্ ম্রিয়মানঃ পাপমনো বিজহাতি।।
=[]বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৩/৮[]=
অর্থাৎ, জীব জন্ম লইয়া শরীর প্রাপ্ত হয় এবং পাপভোগ করে এবং মোক্ষ অবস্থায় পাপের ভোগ হইতে মুক্ত হয়।
" তং বিদ্যাকর্মণী সমম্বারভেতে পূর্ব প্রজ্ঞা চ"
=[]বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৪/২[]=
অর্থাৎ, জীবাত্মা শরীর ত্যাগ করিয়া যাইবার সময় তাহার বিদ্যা, কর্ম এবং পূর্ব প্রজ্ঞা তাহার সহিত অনুগমন করে=
শ্রীমদ্ভগবদগীতা=
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে দ্বিধান্বিত অর্জুনকে যে অমৃত দর্শনের জ্ঞান প্রদান করেছিলেন তা আজ গীতা হিসেবে পরিচিত এবং বহু দার্শনিক থেকে সাধারণ মানুষের নিকট নন্দিত গ্রন্থ। শ্রীমদ্ভগবদগীতা যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বহুবার উল্লেখ করেছেন। সেই স্মৃতি শাস্ত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে মৃত্যু একটি চিরন্তন সত্য। কিন্তু জীবাত্মা কখনো বিনাশ প্রাপ্ত হয় না। এরুপ বাক্য শ্রীমদ্ভগবদগীতার যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ২য় অধ্যায়ের সাংখ্যযোগ এর ২০তম শ্লোকে বলেছেন,
"ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে"।।
=[]গীতা: ২/২০[]=
অর্থাৎ, আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। তিনি জন্মরহিতশাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।
সেজন্য জীবাত্মা শুধু পুরাতন জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। এরুপ বাক্য শ্রীমদ্ভগবদগীতার ২য় অধ্যায়ের সাংখ্যযোগ এর ২২তম শ্লোকে উল্লেখ রয়েছে,
"বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি ।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য- ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী" ॥
=[]গীতা: ২/২২[]=
অর্থাৎ, মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে , দেহীও তেমনই দেহত্যাগ করে নতুন দেহধারণ করে ।
এই নশ্বর দেহের যেমন সৃষ্টি হয়েছে তেমনি প্রকৃতি নিয়ম অনুসারে জীবাত্মা এই দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহে প্রবেশ করবে। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ২য় অধ্যায়ের ২৭তম শ্লোকের যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
"জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি"।।
=[]গীতা: ২/২৭[]=
অর্থাৎ, যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী।
অতএব অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করার সময় তোমার শোক করা উচিত নয়।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাহার পুনর্জন্মের উল্লেখ করেছেন গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের (জ্ঞানযোগ) ৫ম শ্লোকে।
"বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ"।।
=[]গীতা: ৪/৫[]=
অর্থাৎ, হে পরন্তপ অর্জুন!আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্বরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পারো না।
জীবাত্মা অনাদি তাহার না সৃষ্টি হয়েছে না কখনো ধ্বংস হবে। সকাম কর্মজনিত মোহের কারণে সে সকল কর্মের ফল ভোগের জন্য জীবাত্মা বারংবার এই জড় জগৎে ফিরে আসে। যখন সে কর্ম ফলের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায় তখন তাহার কাঙ্ক্ষিত মোক্ষ প্রাপ্তি হয়।
উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে আমরা সকলে উপলব্ধি করতে পারি কর্মফল, অনাদি তত্ত্বের মতো জন্মান্তরবাদ সনাতন ধর্ম শাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ইহা শাস্ত্র সম্মত। তাই কোনো অপপ্রচারকারী যদি এরুপ প্রলাপ করে থাকে যে সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে জন্মান্তরবাদ এর ধারণা নেই তাহলে ইহা তাহার অজ্ঞতা কিংবা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
আলোচনার ২য় পর্যায়ে সকলের নিকট এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে পুনর্জন্মের যৌক্তিক ব্যাখ্যা কি? এরুপ সংশয় নিবারণ এর প্রয়াস করবো।
জন্মান্তরবাদের যৌক্তিকতা
➡️ মনুষ্য এই ঐশ্বর্যপূর্ণ পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে এবং বৃদ্ধি লাভ করে৷ কিন্তু সে ধীরে ধীরে সংশয়ের আধারে নিমজ্জিত হয় এবং ভাবে সে এখানে কেন এসেছে, তার এই মনুষ্য জন্মের কারণই বা কি (কার্যকারণ তত্ত্ব)? তাহার জীবনের উদ্দেশ্য কি? সে কেন এত ধনী কিংবা এত দরিদ্র কিংবা দুঃখ কষ্ট কেন পাচ্ছে?
আমরা সকলে জানি ঈশ্বর পক্ষপাত করেন না কিংবা আমাদের কর্ম করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করেন না। আমরা যেরুপ কর্ম করবো তাহার ফল শুধু তিনি প্রদান করেন। সেজন্য শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে,
"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি"।।
=[] গীতা: ২/৪৭[]=
অর্থাৎ, কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে তোমার কোনো অধিকার নেই। কর্মফল যেন তোমার কর্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয়, কর্ম ত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।
আমরা যেরুপ কর্ম করবো সেরুপ ফল প্রাপ্ত হবো। কিন্তু আমরা অনেক সময় দেখি বহু ব্যক্তি সারাজীবন খারাপ কর্ম করেও কেউ ধনী এবং সে ক্ষমতাশালী হয়ে দিন নির্বাহ করছে। তাহলে সে পাপী বা অন্যায়কারী কি রেহাই পেয়ে যাবেন? অবশ্যই না! অন্যায়কারীর কর্মের ফল তার দিকে পুনরায় ফিরে আসে। এজন্য পবিত্র বেদ এ বলা হয়েছে,
"इष्वा॒ ऋजी॑यः पततु॒ द्यावा॑पृथिवी॒ तं प्रति॑।सा तं मृ॒गमि॑व गृह्णातु कृ॒त्या कृ॑त्या॒कृतं॒ पुनः॑॥" [अथर्ववेद ५/१४/१२]
"ইস্বা ঋজীয়ঃ পততু দ্যাবাপৃথিবী তং প্রতি।সা তং মৃগমিব গৃহ্নাতু কৃত্যা কৃত্যাকৃতং পুনঃ।।"
=[]অথর্ববেদ ৫/১৪/১২[]=
অর্থাৎ, দ্যুলোক ও পৃথিবীলোকে দুষ্টকর্ম ফল হয়ে ফেরত আসে কর্তার দিকে যেমন উপরে ছোঁড়া ধনুক নিচের দিকে দ্রুত তেড়ে আসে,যেমনটা আসে বাঘ হরিণের দিকে।
উপরোক্ত মন্ত্র থেকে ইহা বোধগম্য যে, মনুষ্যের কর্মের ফল সে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে। কিন্তু এটা বহুবারই দৃষ্টিগোচর হয় যে অপরাধী অপরাধ কিংবা পাপী পাপে প্রবৃত্ত হয়েও সে অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরের সৃষ্টি এরুপ হলে অনাচার, অবিচার এবং পক্ষপাত আচরণ দৃষ্ট হয়। এরুপ কি কখনো হতে পারে? না! পারে না। এ সংশয়ের সমাধান হলো পুনর্জন্ম। অর্থাৎ, ব্যক্তি তার স্বীয় কর্মের ফল ভোগ করার জন্য পরবর্তী জন্মে তা ভোগ করবে ইহাই সত্য।
মহর্ষি জৈমিনি তাঁর বিখ্যাত দর্শন গ্রন্থ মীমাংসা দর্শনে বলেছেন–
"নিয়মো বা তন্নিমিত্তত্বাৎ কর্তুস্তৎকারণং স্যাৎ"॥
=[]মীমাংসা দর্শন– ৬।২।১৫[]=
অর্থাৎ, জীবের ভোগ (ফল) পূর্ব কর্ম অনুসারে প্রাপ্ত হয় । কিন্তু জীব কর্ম করায় স্বতন্ত্র হয়ে থাকে।
অর্থাৎ, আমরা বর্তমানে যেসব দুঃখ কষ্ট পেয়ে থাকি তা বহু ক্ষেত্রে আমাদের পূর্ব জন্মের ফল। কিন্তু এরুপ ভাবা অনুচিত যে, এ জন্মের সকল কিছুই পূর্বের কর্মের ফল। আমাদের বর্তমান জন্মে বহু দুঃখ কষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত। সেজন্য সকল কিছুই পূর্ব জন্মের কর্মের ফল নয়। যদি তাই হতো তাহলে আমরা কাউকে নির্দোষ হলেও তার সাথে অন্যায় করলে সেটা পূর্ব জন্মের কর্মফল বলে মান্যতা দিতাম এবং এটা তোমার কর্মের ফল বলে নিজেকে নির্দোষ ঘোষণা করতে পারতাম। কিন্তু ঈশ্বর কতৃক প্রণীত সৃষ্টির নিয়মে এরুপ যথেচ্ছাচার এর সুযোগ নেই। তাহলে এসকল দুঃখকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? নিম্নে সে ব্যাখ্যা প্রদান করা হলো।
১. আধ্যাত্মিক দুঃখ । নিজের মনের অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ এসব পুষে রাখলে এসব দ্বারা মানুষ নিজেই দুঃখ-কষ্ট পায় । তাই এগুলো আধ্যাত্মিক দুঃখ ।
২. আধিদৈবিক দুঃখ ৷ প্রকৃতিক বস্তুসমূহ, যাদেরকে আমরা দেবতাও বলি, তাদের দ্বারা যেসব দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে সেগুলো আধিদৈবিক দুঃখ ৷ যেমন— ঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি ৷
৩. আধিভৌতিক দুঃখ । অন্যান্য প্রাণী, মানব দ্বারা আমরা যেসব দুঃখ-কষ্ট পাই সেগুলো আধিভৌতিক দুঃখ ।
এই দুঃখ সমূহ মূলত কর্মফলের সাথে সম্পর্কিত নয় । এগুলো মূলত ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির ফলে সংগঠিত হয়
। এগুলো কর্মফল হলে মানুষের মধ্যে মোক্ষ (দুঃখ হতে মুক্তি) লাভের ইচ্ছে থাকত না ৷ কর্মের ফলের অতিরিক্ত এই জগতে দুঃখ পেতে হয় বলে মানুষ এই দুঃখ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চায় । সেজন্য, মানুষ কর্ম ফলের বন্ধন ত্যাগ করে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস করে।
যদি পুনর্জন্মকে অস্বীকার করা হয় তাহলে আমাদের কেউ কেন ধনী, কেউ কেন ধার্মিক পরিবারে এবং কেউ কেন দারিদ্র্যতা কিংবা শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে? আবার কিছু প্রাণী কিংবা উদ্ভিদ কিংবা পোকামাকড় হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। ঈশ্বর কি তাহলে পক্ষপাত করে এরকম করেছেন? না! আমাদের পূর্ব জন্মের কর্ম অনুসারে আমরা উত্তম কিংবা অধম যোনিতে জন্ম গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করি। এরুপ সংশয় উথান হতে পারে যে, পৃথিবীতে এত মানুষ মারা যাচ্ছে কিংবা বৃক্ষ উজার হচ্ছে তাহলে এত মানুষ কোথায় জন্মগ্রহণ করছে? এটা তাদের মনে হয় যারা মনে করে এই ভূলোকে শুধু প্রাণীর বসবাস কিন্তু সনাতন ধর্মে ভূলোক দ্যূলোক উভয়ের উল্লেখ রয়েছে। এ গ্রহে কিংবা অন্য কোনো গ্রহে তাহার জন্ম হবেই।
অনেকে ভেবে থাকেন যে, জন্মান্তরবাদ থেকে নরক যন্ত্রণার ধারণা হয়তো যৌক্তিক হয়তো সঠিক। কিন্তু আমরা সকলে জানি যে দেহ নশ্বর এবং জীবাত্মা অমর, অজয়। তাহলে জীবাত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে তখন সে জাগতিক দুঃখ বেদনার অনুভব থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং অচেতন থাকে। সাংখ্য দর্শনে এর যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা রয়েছে,
"সম্প্রতি পরিমুক্তো স্বাভ্যাম্"।।
=[]সাংখ্য -৩/৬[]=
অর্থাৎ, মৃত্যুর পর হইতে পুনঃ জন্মগ্রহণ করিবার পূর্ব পর্যন্ত বা মৃত্যুর পর হইতে জন্মগ্রহণের মধ্য সময়ে জীবাত্মা সুখ দুঃখ কিছুই অনুভব করিতে পারে না—যেমন আমরা এখন চক্ষু গোলকের সাহায্য ব্যতীত সূক্ষ্ম দর্শন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেখিতে পাই না সেইরূপ সাধন শরীর বা স্থূল শরীরের সাহায্য বিনা সাধারণ জীবের কোন অনুভূতি হয় না ।
"ন কিঞ্চিদপ্যনুশয়িনঃ"।
=[]সাংখ্য -৫/১২৫[]=
"ন বুদ্ধ্যাদিনিত্যত্বমাশ্রয়বিশেষেহপিবিহ্নিবৎ"।
=[]সাংখ্য - ৫/১২৬[]=
"আশ্রয়াসিদ্ধেশ্চ"।
=[]সাংখ্য - ৫/১২৭[]=
অর্থাৎ যে আত্মা পূর্বতন শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর ধারণ হেতু যাত্রা করে তাকে অনুশয়ী আত্মা বলে। এই অনুশয়ী আত্মার কোন প্রকার চৈতন্য তথা সুখ দুখঃ ইত্যাদির জ্ঞান থাকে না । তাই আত্মা এই সম্পর্কে সম্পুর্ন অজ্ঞ থাকে যে সে কোথায় যাচ্ছে, কি হেতু গমন করছে।
তাহলে সে অনাদি সত্তাকে কিভাবে আগুনে পোড়ানো, কিংবা কাটা ছেঁড়া যায়? শ্রীমদ্ভগবদগীতায় যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টত বলেছেন,
"নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ"।।২৩
"অচ্ছেদ্যেহয়মদাহ্নোহয়মক্লোদ্যোহশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।
অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে"।।২৪
=[] গীতা: ২/২৩-২৪[]=
অর্থাৎ, শস্ত্র সকল ইহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নিতে দহন করিতে পারে না, জলে ভিজাইতে পারে না। এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেশ্য, অশোষ্য। ইনি নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল, সনাতন, অব্যক্ত, অচিন্ত্য অবিকার্য বলিয়া কথিত হন।
সেজন্য, হে মিত্র প্রমুখ! সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে জন্মান্তরবাদ এর ধারণা শাস্ত্রীয় ও যৌক্তিক ভাবে প্রমাণিত। ব্যক্তি কর্ম ফল ভোগের জন্য বারংবার জন্মগ্রহণ করেন এবং মনুষ্য জন্মে সে পরম সত্য তথা মোক্ষ অর্জনের প্রধান সুযোগ। পবিত্র বেদ, উপনিষদ ও শ্রীমদ্ভগবদগীতার সেই শ্বাশত বাণী পুনরাবৃত্তি ঘটেছে চাণক্যনীতি শাস্ত্রে। তিনি উদ্ধৃত করেছেন,
জীব স্বয়মই কর্ম করে, স্বয়মই সেই কর্মফল সুখ-দুঃখ ভোগ করে। জীব স্বয়ম্ সংসারে বিভিন্ন যোনিতে জন্মগ্রহণ করে এবং স্বয়ম্ পুরুষার্থ করে সংসার বন্ধন হইতে মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভ করে।
=[]চাণক্যনীতি ৬/৮[]=
তাই হে অমৃতের সন্তানগণ! আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হোক মোক্ষ অর্জনের পথে নিজেকে সমর্পিত করা এবং শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠা এই মনুষ্য জন্মে।
ও৩ম্ শান্তি শান্তি শান্তি
তাই হে অমৃতের সন্তানগণ! আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হোক মোক্ষ অর্জনের পথে নিজেকে সমর্পিত করা এবং শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠা এই মনুষ্য জন্মে।
মন্তব্যসমূহ