মনুষ্য কি ধর্মহীন হতে পারে?



নমস্কার সকল অমৃতের সন্তানগণ।

জগৎ পরমাত্মার অপরুপ সৃজন। সমগ্র জগৎ পরমাত্মার দ্বারা আচ্ছাদিত, অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিতে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশক্তিমান, বিভু, নিরাকার পরমেশ্বরের অবস্থান। এই জগৎ এর সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাই প্রমাণ করে এই সৃষ্টির একজন নিমিত্ত কারণ এর উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবীভাবে রয়েছে। এই সমগ্র জগৎকে পরমাত্মা এক শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় নিয়মে সৃষ্টি ও পরিচালনা করেছেন। যা ধর্ম বলে স্বীকৃত। সেহেতু, পদার্থ মাত্রই তাহার ধর্ম বিদ্যমান। 

প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশে ও জ্ঞান অর্জনের তৃষ্ণায় মানবসভ্যতা আজ জ্ঞান বিজ্ঞানের জগৎে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে। মানবদৃষ্টি যে দূরত্বে অবস্থিত গ্রহ উপগ্রহকে দেখতে পারেনি, সে অদেখা বস্তুকে দৃশ্যপটে নিয়ে এসেছে মানবনির্মিত হাবল বা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। সৌরজগৎ পেরিয়ে মনুষ্য এখন আলোকবর্ষ দূরের অজানা জগৎকে অনুধাবন ও পর্যবেক্ষণে লিপ্ত। 

তবে সে প্রগতিবাদী চিন্তার বিকাশে কিছু বিবিধ ব্যক্তি জ্ঞান দৈন্যতার হেতু স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং ধর্মকে অস্বীকার করতে উদ্যত হয়েছে। সেজন্য, বর্তমান সময়ে এসে মনুষ্য সৃষ্ট মতবাদকে ধর্ম হিসেবে ভেবে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী, ধর্মহীন হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী। 

কিন্তু মনুষ্য কি সত্যি ধর্মহীন হতে পারে ⁉️

ধর্মের পরিভাষা: —সংস্কৃত ‘ধৃ’ ধাতুর সঙ্গে ‘মন্’ প্রত্যয় যোগ করে ‘ধর্ম’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘ধৃ’ ধাতু দ্বারা নির্মিত হওয়ায় ধর্ম শব্দের অর্থ ‘ধারণ করা’। জগতে অস্তিত্বশীল প্রত্যেক বস্তু তার নিজ নিয়মে, তার স্বভাব-নিয়মে চলে, যা তার স্বধর্ম। আগুনের স্বভাব যেরুপ উত্তাপ বিকিরণ করা, সেরুপ জলের ধর্ম তারল্য, সেটিই তার স্বধর্ম। অর্থাৎ, বস্তুর নিজ যে স্বভাবজাত গুণ ও বৈশিষ্ট্য, যা বস্তুর অস্তিত্বশীল হওয়ার জন্য আবশ্যক তাকে সনাতন শাস্ত্রে ধর্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে। সেজন্য, বৈশেষিক দর্শনে বলা হয়েছে, 

"যতোহভ্যুদয়নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধৰ্মঃ"॥
- বৈশেষিক দর্শন ১/১/২

পদার্থঃ (যতোঃ) যা দ্বারা (অভ্যুদয়ঃ) অভ্যুদয় (নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ) [ ভাষ্যকারঃ আচার্য উদয়বীর শাস্ত্রী, আর্যসমাজ ] নিঃশ্রেয়স সিদ্ধি হয় (সঃ ধর্মঃ) তা-ই ধর্ম।

অর্থাৎ, যা দ্বারা পদার্থ সমূহের যথাযথ জ্ঞান ও তার প্রয়োগ দ্বারা উন্নতি সিদ্ধ হয় তাই ধর্ম। 

ধর্মের শাশ্বত লক্ষণ সমূহে এই জ্ঞান অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে। 
মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে, 

"ধৃতিঃ ক্ষমা দমোহস্তেয়ং
শৌচমিন্দ্রিয়-নিগ্রহঃ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো
দশকম্ ধর্মলক্ষণম্"৷।  -মনুসংহিতা, ৬/৯২

অর্থাত্‍, সহিষ্ণুতা,ক্ষমা ,চুরি না করা ,শুচিতা ,ইন্দ্রিয়সংযম,শুদ্ধ বুদ্ধি,জ্ঞান,সত্য এবং ক্রোধহীনতা-এইটি দশটি ধর্মের লক্ষণ।

জগৎ এ প্রতিটি পদার্থের ধর্ম একাধিক হওয়া নিতান্তই অমূলক। সেজন্য একই পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক। যারা নিজেদের ধর্মহীন প্রগতিশীল চিন্তার ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় প্রদান করেন তারা কি উপরিউক্ত লক্ষণ সমূহকে অস্বীকার করতে পারেন। যদি আপনার সুদত্তর 'না' হয়ে থাকে তাহলে আপনি কিভাবে ধর্মহীন হতে পারেন ⁉️ 

এক্ষেত্রে ধর্মহীন দাবিকৃত ব্যক্তিদের অভিযোগ জগৎে এত ধর্ম, যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি করলেও তারা একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত, বিজ্ঞানকে তারা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াকে সমীচীন মনে করে, কুসংস্কার এর বেড়াজালে তারা আটকে রাখতে চায় সমগ্র মানবসভ্যতাকে। 

সত্যিকার অর্থে, এরুপ ধারণা আমাদের মনে অজ্ঞতার কারণে তৈরি হয়ে থাকে। ধর্ম ও রিলিজিয়ন এক বিষয় নয়। সংস্কৃত পরিভাষায় উদ্ধৃত ধর্মের সাথে প্রচলিত Religion, ism কিংবা মতাদর্শের রয়েছে আলোকবর্ষ দূরত্ব ও বিস্তৃত পার্থক্য। পৃথিবীতে আমরা যে সব প্রচলিত Religion, ism কিংবা মতাদর্শ দেখি সেগুলো ধর্ম নয়। সেগুলো নির্দিষ্ট কিছু আচার অনুষ্ঠান নিয়ম কানুনের সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ। যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের আদর্শের কারণে তৈরি যা বহু ক্ষেত্রে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি দ্বারা প্রভাবিত।  Religion শব্দের সংস্কৃত অর্থ ধর্ম নয়, Religion শব্দের সংস্কৃত অর্থ মার্গ বা পথ । ধর্ম শব্দের প্রয়োগ Religion এর বাংলা হিসেবে আমরা প্রচলিত ভুল অর্থে বা Misnomer হিসেবে ব্যবহার করি।

এরুপ সংশয় নিবারণ এর পরবর্তী সময়ে প্রগতিশীল মহাত্মাদের আরোপিত অযৌক্তিক দাবি উত্থাপিত হয় যে, জগৎ এ ধর্ম এক ও অদ্বিতীয় হলে তার নাম কিভাবে সম্ভব? 

সত্যিকার অর্থে, ধর্মের কোনো নাম হয় না। ধর্ম মাত্রই সনাতন বা চিরন্তন। অর্থাৎ, যা ছিল আছে থাকবে। যার শুরু নেই বা বিনাশ নেই। যা পরিবর্তন করা যায় না। তাহাই সনাতন বা চিরন্তন। এজন্য, মত বা পথ পরিবর্তন করা সম্ভব, তবে ধর্ম পরিবর্তন বা ধর্মহীন হওয়া সম্ভব নয়। সত্য যেমন সত্যই, ন্যায় যেমন ন্যায়, তেমনি ধর্মই ধর্ম তাহার আলাদা নামের প্রয়োজন নেই। 
এরুপ শব্দ সমূহের উপমা সূচক শব্দ হয়, যেমন সত্য-পরমসত্য, ধর্ম-সনাতনধর্ম এবং সে উপমা দ্বারা পরমাত্মাকেও নিত্য সনাতন বলা হয়েছে। 

এরুপ স্থলে, মনুস্মৃতির ৪র্থ অধ্যায়ের ১৩৮ শ্লোকের উদ্ধৃতি দেওয়া আবশ্যক। সেখানে বলা হয়েছে, 

"প্রিয়ং চ নানৃতং ব্রুয়াদেষ ধর্ম্মঃ সনাতনঃ"।।
- মনুস্মৃতি ৪/১৩৮

অর্থাৎ,  অপরের হিতকর প্রিয় সত্য কথা বলিবে, অপ্রিয় সত্য কথা কখনো বলিবে না যাহা লোকের মর্মভেদ করে, অপরকে প্রসন্ন করার নিমিত্তেও আবার মিথ্যা বলিবে না, ইহাই বেদবিহিত সনাতন ধর্ম।

আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় বিজ্ঞানের অবদান অনন্য। বিজ্ঞানের কারণে মনুষ্য আজ আলোকবর্ষ দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহসিক অভিযানে নিবেদিত। কিন্তু ধর্মহীন দাবিকৃত ব্যক্তিগণ বিজ্ঞান ও ধর্মকে বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু ধর্ম ও বিজ্ঞান কি পরস্পর বিরোধী নাকি সহযোগী? 

আলোচনা সাপেক্ষে, ধর্ম কি তা আমরা ইতোমধ্যে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। সেজন্য, বিজ্ঞান যে ধর্মের বিরুদ্ধে নয় এটা স্বচ্ছ আলোর মতো স্পষ্ট। ব্যাকরণ যেমন ভাষার গঠন ও এর নিয়ম কিংবা বিবিধ দিক বিশ্লেষণ করে এবং নতুন কিছু আবিষ্কার করে তার প্রয়োগ করে, যার ফলে ভাষা হয়ে উঠে আরো মনোমুগ্ধকর। সেরুপ, বিজ্ঞান পরমাত্মার এই সৃষ্ট জগৎ যে শাশ্বত সনাতন নিয়ম দ্বারা আবদ্ধ ও পরিচালিত সে ধর্ম সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে এবং আমাদেরকে জগৎ সম্পর্কে জানতে আরো উদ্যমী করে তোলে। সনাতনধর্মে  বিজ্ঞান বিরোধী কোনো অবস্থান ছিলো না। সেজন্য, পবিত্র বেদ এর মাঝে আমরা খুঁজে পাই বিগব্যাং থিওরি, জলচক্র, সালোকসংশ্লেষণ, বিমানবিদ্যা, অনু-পরমাণুর ধারণাসহ বিবিধ জ্ঞান ও বিজ্ঞান তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। সনাতনধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ এর প্রতি আস্থা রেখে, প্রাচীন ঋষিগণ দিয়েছেন বিজ্ঞানের বহু কালজয়ী তত্ত্ব। মহর্ষি কণাদ কর্তৃক Gravity, অনু-পরমাণুর ধারণা, ব্রহ্মগুপ্ত আর্যভট্ট, বরাহ মিহির সহ বহু গণিতবিদ, চিকিৎসা শাস্ত্রে মহর্ষি সুশ্রুত, চরক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় মহর্ষি মনু কর্তৃক মনুস্মৃতি, মহর্ষি ভাস্করাচার্য কর্তৃক বিমানবিদ্যার ধারণা সহ বিবিধ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়েছে। ধর্মের আশ্রয়ে বিজ্ঞান অগ্রসর হয়েছে বলে এরুপ জ্ঞান এর আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। 

"ধর্ম সমগ্র জগৎকে ধারণ করে, বিজ্ঞান জগৎকে অনুধাবন করার প্রয়াস করে" 

সনাতন ধর্ম কোনো ভৌগোলিক মতাদর্শের কোনো অধিকারী নয় বরং ইহা শাশ্বত, সার্বজনীন ও দেশ-সমাজ নির্বিশেষে সমগ্র জগৎে সমভাবে প্রযোজ্য। 
জলের ধর্ম যেমন তারল্য, অগ্নির ধর্ম যেমন দগ্ধ করা, তেমনি মনুষ্য মাত্রেরই ধর্ম মনুষ্যত্ব ও মনুসংহিতায় বর্ণিত সে ১০টি গুণ বা লক্ষণ ধারণ। সমগ্র জগৎের কল্যাণ কামনা করা এবং প্রকৃত মানুষ হওয়ার আদর্শ ধারণ করা। 

"মনুর্ভব জনয়া দৈবং জনম্"
 - ঋগ্বেদ, ১০/৫৩/৬।

অর্থাৎ, প্রকৃত মানুষ হও এবং অন্যকেও মানুষ হিসেবে গড়ে তোল।

➡️ সেহেতু, উপরিউক্ত বিশ্লেষণ থেকে উপলব্ধি করার প্রয়াস করি, নিজেকে ধর্মহীন দাবিকৃত ব্যক্তিগণ কি সত্যি ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে পারে ⁉️

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ