মুক্তিযুদ্ধ ও হিন্দু ইতিহাস: ০১


"আশালতা বৈদ্য ও মুক্তিযুদ্ধ"

মুক্তি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে অকৃত্রিম প্রাণজুড়নো আনন্দ। প্রত্যেক প্রাণী মাত্রই পেতে চায় মুক্তির অনাবিল সুখ। মনুষ্য জাতির ইতিহাস হাজারো বছরের কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়ে মনুষ্য জাতি কখনো কখনো হয়েছে পদানত, কিংবা কখনো সেই পদাবনত অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য করেছে সংগ্রাম। ভারতবর্ষ, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাতিন আমেরিকা কিংবা শোষণ-নিপীড়নে নিষ্পেষিত আফ্রিকা সেই সকল পরাধীন ভূখণ্ড সমূহের মানুষগণ সর্বদাই সংগ্রামে নিজেদের করেছে নিয়োজিত। এই লড়াই মুক্তির লড়াই, এই লড়াই স্বাধীনতার লড়াই। 

সেই সুপ্রসিদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ স্থান করে নিয়েছে অনবদ্য ভূমিকায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল পূর্বপাকিস্তানের নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর লড়াই। ধর্মের নামে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এই সংগ্রামে সকলের একটাই পরিচয় ছিল আমরা শোষিত, আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশী, বাংলা মোদের মাতৃভাষা। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি সেই বহুল প্রতীক্ষিত মুক্তি তথা স্বাধীনতা। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে স্থান করে মোদের প্রিয় মাতৃভূমি "বাংলাদেশ"। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো বিশেষ জাতি কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীর লড়াই ছিলো না। বরং, এ লড়াই ছিল বাঙালি-অবাঙালি, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সকলের সংগ্রাম। কিছু বিশেষ গোষ্ঠী স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও সমগ্র বাংলা জুড়ে সকলের প্রাণের দাবি ছিল স্বাধীনতা। 

মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি বহু নারী ব্যক্তিত্ব এই মাতৃভূমির প্রতি নিজেদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতে সচেষ্ট ছিলেন। নারী যোদ্ধাদের জন্য  তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। গোবরা ক্যাম্পে মেয়েদের দেওয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং—১. সিভিল ডিফেন্স, ২. নার্সিং, ৩. অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। 

আশালতা বৈদ্য সেই নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন এমন নারীদের নাম বলতে গেলেই যাঁর নাম বিশেষভাবে আসে তিনি হলেন আশালতা বৈদ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় একমাত্র নারী হিসেবে তিনি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। পাকসেনার আক্রমণের মুখে তিনি দিয়েছেন সাহসিকতার পরিচয়।

➡️ পরিচয়: ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন আশালতা বৈদ্য। পিতা হরিপদ বৈদ্য ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং মা সরলাময়ী বৈদ্য ছিলেন গৃহিণী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ১৫ বছর। যুদ্ধ শুরু হলে একদিন রাজাকাররা তাঁর বাবা হরিপদ বৈদ্যর কাছে ছয় লক্ষ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয় তারা। হরিপদ বৈদ্য মেয়েদের বাঁচাতে সপরিবারে ভারতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

➡️ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ: তৎকালীন সময়ের হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রম আশালতার নিকট আসেন। তিনি হরিপদকে ভারতে যেতে নিষেধ করেন এবং আশালতাকে যুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। আশালতা এরূপ প্রস্তাবে সম্মত হয় এবং কোটালিপাড়ার লেবুবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ৪৫ জন নারীর সঙ্গে প্রথমে প্রশিক্ষণ নেন। 
শুরু হয় তাঁর প্রশিক্ষণ।  পরবর্তীতল কোটালিপাড়ার নারকেলবাড়ি হাইস্কুল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এবং তারপর গেরিলা প্রশিক্ষন নেন ভাঙ্গারহাট স্কুল প্রাঙ্গনে এবং  জহুরকান্দি স্কুলে সুইসাইড স্কোয়াড প্রশিক্ষণ নেন। সর্বমোট তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণে তিনি রাইফেল, পিস্তল, গ্রেনেড ও বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেন। তাছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য ফার্স্ট এইড প্রশিক্ষন, গোয়েন্দাবৃত্তির কৌশল এবং সুইসাইড স্কোয়াড সম্পর্কেও সব ধরনের প্রশিক্ষণ নেন তিনি।

কৃতিত্ব: প্রশিক্ষণ পর্ব সমাপ্ত করে তিনি আত্মনিয়োগ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ৩০০ জন মহিলাসহ মোট ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে দুঃসাহসিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন। বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে অংশ নিতে থাকেন এবং সাহসিকতার সাথে জয়ী হতে থাকেন। প্রতিটি অপারেশনেই আশালতা দুঃসাহসিকতা, সুনিপুণতা, দক্ষতার মাধ্যমে পাকসেনাদের প্রতিহত করেন। একদিন তার বাহিনীর হাতে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয় এবং বন্দি হয় ২৫ পাকিস্তানি সেনা। বন্দী ২৫ পাকিস্তানি সেনাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন আশালতা বৈদ্য।
 
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে জানা গেলো গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মা-বাবা তাদের নিজের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা বন্দি হয়ে আছেন। 
কয়েকদিন পরই তাদের উদ্ধারে অভিযান চালালো এক দুর্ধর্ষ গেরিলা দল। সেখানে থেকে তাদের উদ্ধার করে গেরিলা কামান্ডার তাকে নিয়ে গেলেন শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এবং নিজ উদ্যোগেই সেখানে তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। সেই দুর্ধর্ষ গেরিলা দলেরই কামান্ডার ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র নারী কামান্ডার আশালতা বৈদ্য

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন শেষে নারী উন্নয়নের লক্ষে গড়ে তোলেন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান সূর্যমুখী সংস্থা। সেবামূলক কাজের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বাছাই কমিটিতে মনোয়ন পেয়েছিলেন। তিনি শ্রেষ্ঠ মহিলা সমবায়ের প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক, রোকেয়া পদক, প্রশিকা মুক্তিযোদ্ধা পদকসহ অনেক পুরষ্কার লাভ করেছেন।
 
আশালতা বৈদ্য ছিলেন সত্যিকারের একজন অগ্নিকন্যা। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদাররা বারংবার নিজ মাতৃভূমি রক্ষায় ফিরে আসেন বারংবার আশালতা হয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সংগ্রাম। কিন্তু বর্তমানে কিছু স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এরুপ ধর্মীয় উসকানি প্রদানের উদ্দেশ্য এরুপ মন্তব্য উপস্থাপন ও প্রচার করে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু জনগোষ্ঠীর কোনো অবদান নেই। কিন্তু সত্যি কি হিন্দুরা মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্লিপ্ত ছিলো? অবশ্যই না! বহু হিন্দু সংগঠক হিসেবে কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজ মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মনিয়োগ করেছে। শ্রীমতি আশালতা বৈদ্য সেই স্কুল শিক্ষক হিন্দু হরিপদের মেয়ে।

তবে এটাও অনস্বীকার্য সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কর্তৃক পরিকল্পিত জেনোসাইড এর মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি হিন্দুজনগোষ্ঠী। যা ১৯৭১ সালের ১৩ জুন সানডে টাইমসে ‘হোয়াই দ্য রিফিউজিস ফ্লেড’ শিরোনামে প্রকাশিত অ্যান্টনি মাসকারেনহাসকে দেওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনে কর্মরত মেজর রাঠোরের সাক্ষাৎকার থেকে সুস্পষ্ট হয়। 

“অবশ্যই, আমরা শুধু হিন্দুদেরই হত্যা করছি। আমরা সৈনিকরা বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ নই। তারা আমাদের নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে”

কিন্তু এই মহান মুক্তিযুদ্ধ কখনো হিন্দু কিংবা বাঙালি এমন ধারণা থেকে সংগঠিত হয়নি। বরং, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। 

বিঃদ্রঃ উপরিউক্ত আর্টিকেল এর উদ্দেশ্য কোনো বিভেদ বা জাতিগত বিদ্বেষের প্রচার নয়। বরং বহুদিন ধরে প্রচলিত প্রোপাগাণ্ডার প্রত্যুত্তর। আমরা ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি, মহান মুক্তিযুদ্ধ সকল বাঙালি-অবাঙালি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ছিল।

⚡মুক্তিযুদ্ধ ও হিন্দু ইতিহাস: ০১

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন