"আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশনা"


"আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশনা"
"চলো গড়ি স্বদেশ"
"আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশনা"

🖋️ রাষ্ট্র! আধুনিক সময়ে এসে সমগ্র বিশ্বে রাষ্ট্র গঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে কয়েক শতক পূর্বে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল থেকে আধুনিক সময়ের নিকোলা ম্যাকিয়াভেলি, রুশো বা প্রাচ্যের চাণক্যসহ সকলে প্রচেষ্টা করেছেন একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে। সে আধুনিক রাষ্ট্রকে কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার আহবান ছিলো সকলের অভিমত। 

🖋️ একটি রাষ্ট্র গঠনের মূল স্তম্ভ তাহার জনগণ। জনগণই রাষ্ট্রের কাঠামো, প্রগতি এবং নীতি নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে শুধু জনগণের নিজস্ব অভিমতই যথেষ্ট নয়, বরং সার্বজনীন মানদণ্ড নির্ধারণ এবং সে অনুসারে দেশকে পরিচালনা করার মাধ্যমে কল্যাণ বা জনবান্ধব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। 

📜🖋️ বেদ সকল জ্ঞানের আধার স্বরুপ। সেজন্য বেদে যেমন পরমাত্মার স্বরুপ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে, তেমনি মনুষ্য সভ্যতার কল্যাণে রয়েছে বিবিধ উপদেশ। সেজন্য বেদ এর মধ্যে রাষ্ট্র সম্পর্কিত বহুবিধ উপদেশ রয়েছে। রাষ্ট্রের কাঠামো, আদর্শ শাসক, প্রজার কর্তব্য, রাষ্ট্র ধ্বংসের কারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে রয়েছে দিকনির্দেশনা। 

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের জানা আবশ্যক যে, একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে বৈদিক শাস্ত্র সমূহের দিকনির্দেশনা।  

➡️ আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণে শাসকের ভূমিকা: 

রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনায় শাসকের রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা। একজন নেতৃত্বদানকারী শাসকই রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু সে শাসক কখনো স্বৈরাচারী হতে পারে না কারণ শাসক প্রজাকতৃক নির্বাচিত হয়ে থাকে। তাই শাসককে হতে জনগণের সেবক বা নেতা। 

"আ ত্বাহার্ষমন্তরেধি ধ্রুবস্তিষ্ঠা বিচাচলিঃ 
বিশ্বস্ত্বা সর্বা বাঞ্ছংতু মা ত্বদ্রাষ্ট্রমধিভ্রশৎ"  
-ঋগ্বেদ ১০/১৭৩/১

অর্থাৎ, হে রাজন! তোমাকে আনিয়াছি, আমাদের মধ্যে এসো, স্থির থাকো, চঞ্চল হয়ো না।  তোমাকে সব প্রজারা চাহিতেছে। তোমার দ্বারা রাষ্ট্র যেন পতিত না হয়।

"ত্বাং বিশো বৃণতাং রাজ্যায় তামিমাঃ প্রদিশঃ পঞ্চ দেবীঃ।
বর্ম্মন্ রাষ্ট্রস্য ককুদি শ্রয়স্ব ততো ন উগ্রো বি ভজা বসুনি"।।  অথর্ববেদ ৩/৪/২

অর্থাৎ, হে রাজন্! প্রজাগণ এবং পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর -দক্ষিণ-উর্ধ্ব এই পাঁচ দিকের সামন্তরাজগণ 
রাজ্যের জন্য তোমাকে নির্বাচন করিতেছে। তুমি রাষ্ট্রের ঐশ্বর্যময় উৎকৃষ্ট স্থানে আশ্রয় গ্রহণ কর এবং বীরত্বের সহিত আমাদের ধন বিভাগ কর।


➡️ আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণে শাসকের গুণাবলী:

একজন শাসকের গুণাবলি রাষ্ট্রের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। শাসকের গুণাবলির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো চেয়েছিলেন একজন দার্শনিক রাজা, অপরদিকে নিকোলাস ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, শাসককে হতে হবে শৃগালের মতো ধূর্ত এবং সিংহের মতো বলবান। কিন্তু বৈদিক শাস্ত্রে শাসকের গুণাবলি সম্পর্কে রয়েছে ভিন্ন ও অতি উচ্চতর ধারণা। 

"তাহি শ্রেষ্ঠ বর্চসা রাজানা দীর্ঘশ্রুত্তমা।
তা সৎ পতী ঋতাবৃধ ঋতাবানা জনে জনে"।।
-ঋগ্বেদ ৫/৬৫/২

অর্থাৎ, শাসককে মহা তেজস্বী, অত্যন্ত জ্ঞানী, সুরক্ষক, সত্যের সহিত বর্ধ্বনশীল এবং প্রত্যেক সংঘে সত্যের প্রতিপালক হইতে হবে"। 

"ধৃতব্রতাঃ ক্ষত্রিয়া যজ্ঞ নিষ্কৃতো বৃহদ্বিবা অধ্বুরাণামভিশ্রিয়:।
অগ্নিহোতার ঋতসাপো অদ্রুহোহপো অসৃজন্ননু বৃত্রতূর্যে"।। - ঋগ্বেদ ১০/৬৬/৮

অর্থাৎ, ব্রতনিষ্ঠ, যজ্ঞকর্তা, অত্যন্ত তেজস্বী, অহিংস কর্মা, অগ্নিহোত্রী, সত্যনিষ্ঠা, শঠতাহীন ক্ষত্রিয়রাই সম্মুখ সংগ্রামে কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করিতে পারে। 
 
➡️ আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণে শাসকের পরামর্শদাতা:
স্বদেশকে যারা পরিচালনা করবেন তারা ইহা অবশ্যই জ্ঞাত থাকবেন তাদের কর্তব্য পালনের বিষয়টি নিয়ে। রাজস্ব, সৈন্যবল, দেশকে প্রগতিশীল, দুঃস্থদের সহায়তা দান করা রাষ্ট্রের তথা রাষ্ট্র পরিচালনাকারীর কর্তব্য। 

"শগ্ধি পুর্ধি প্রযংসি চ শিশীহি প্রাস্যুদরম্। 
পুষন্নিহ ক্রতুং বিদঃ"।। - ঋগ্বেদ ১/৪২/৯

অর্থাৎ, হে পোষক বীর! কর্ম ও বুদ্ধিকে লাভ কর, দেশোন্নতি করিতে সমর্থ হও, রাজকোষ পূর্ণ কর, অভাবগ্রস্থকে দান কর, অস্ত্রকে তীক্ষ্ণ কর এবং প্রজাদের উদর পূরণের ব্যবস্থা কর।

রাষ্ট্র গঠনে দেশের অমাত্য শ্রেণীর ভূমিকা পালন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নীতি নির্ধারণে তারাই রাষ্ট্রশাসককে সহায়তা প্রদান করে। সেজন্য, শাসককে৷ দেশ পরিচালনায় সুযোগ্যদের স্থান দিতে হবে। 

"সভ্য চ মা সমিতিশ্চাবতাং প্রজাপতের্দুহিতরৌ সংবিধানে। 
যেনা সংগচ্ছা উপমাস শিক্ষাচ্চারু বদানি পিতরঃ সংগতেষু"।। অথর্ববেদ ৭/২১/১

অর্থাৎ, লোকসভা ও রাষ্ট্রপরিষদ প্রজারক্ষক রাজার দুই দুহিতা সদৃশ। উভয় আমাকে রক্ষা করুক। উভয় সভাতেই প্রজার সম্মতির মিলন সংগঠিত হয়। রাজা এই দুই সভার সদস্যদের নিকট হইতে প্রজাদের সম্মতি জানিতে পারেন। হে প্রজারক্ষক সভাসদবৃন্দ!আমরা সকলে পক্ষপাতহীন বাক্য উচ্চারণ করিব। 

"সপত্নক্ষয়ণো বৃষাভিরাষ্ট্রো বিষাসহিঃ।  
যথাহমেষাং বীরাণং বিরাজানি জনস্য চ"।।
অথর্ববেদ ১/২১/৬

অর্থাৎ, যাহাতে শত্রুর বিনাশ করিয়া, বলবান হইয়া, সর্বদা বিজয়ী হইয়া রাষ্ট্রের সেবা করিতে পারি, বীর বৃন্দের মধ্যে এবং জনসাধারণের মধ্যে যাহাতে শির উচ্চ করিয়া থাকিতে পারি তাহার যত্ন করিব। 

➡️ শাসকের ভূল সিদ্ধান্তের ফল: 

রাষ্ট্র পরিচালনায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, তার একটি ভূল সিদ্ধান্ত সমগ্র দেশবাসীর জন্য নিয়ে আসতে পারে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। 

"মা ত্বদ্রাষ্ট্রমধিভ্রশৎ"  -যজুর্বেদঃ ১২/১১

অর্থাৎ, হে শাসক! তোমার মাধ্যমে যেন দেশের ক্ষতি না হয়।

➡️ শাসক স্বৈরাচারী হবে না: 

 রাষ্ট্র পরিচালকদের জবাবদিহির ব্যবস্থা প্রয়োজন। কারণ শাসক যদি স্বৈরাচারী হয়ে উঠে তখন সে রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত না রেখে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতেই চেষ্টা করে। ফলে বিদ্বানের পরিবর্তে সভায় স্থান হয় অযোগ্য চাটুকারের, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির। ফলে রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যায়। 

"রক্ষা মা কির্নো অঘশংস ঈশত মা নো দুশংস ঈশত।
মানো অদ্য গবাং স্তেনো মাহবীনাং বৃক ঈশত"।।
- অথর্ববেদ ১৯/৪৭/৬

অর্থাৎ, হে প্রভু! আমাকে রক্ষা কর। কোন দুষ্ট পাপী আমার উপর যেন শাসনকার্য না চালায়। কোনো দুরাচারী যেন আমার উপর প্রভুত্ব করিতে না পারে। নিরীহ দরিদ্রদের উপর রাজা যেন ব্যগ্র না হয়। 

"যো নঃ পুষন্নঘো বৃকো দুঃশেব আদিদেশতি।
অপ স্ম তং পর্থো জহি"।। -ঋগ্বেদ ১/৪২/২

অর্থাৎ, হে পুষ্টিদাতা প্রভু! যে ক্রুর সেবার অযোগ্য পাপী আমাদের উপর শাসনকার্য চালায় তাকে বহিষ্কার করো।

➡️ শাসকের স্বৈরাচারে রাষ্ট্রের পরিণতি: উত্তম শাসকের কর্ম যেমন স্বদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে, তেমনি শাসকের দম্ভোক্তি এবং স্বৈরাচারী আচরণ রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসতে পারে। 

"তদ্বৈ রাষ্ট্রমাস্রবতি নাবং ভিন্নামিবোদকম্। 
ব্রাহ্মণং যত্র হংসন্তি তদ্রাষ্ট্রং হন্তি দুচ্ছুনাং"।।
- অথর্ববেদ ৫/১৮/৮

অর্থাৎ, রাজার(শাসক) অত্যাচার রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে যেমন জল জীর্ণ নৌকাকে নষ্ট করে। যেখানে জ্ঞানীদের উপর অত্যাচার হয় সে রাষ্ট্র  দুর্গতি প্রাপ্ত হইয়া বিনষ্ট হয়।

➡️ আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণে নাগরিক কর্তব্য:

আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে প্রজা তথা জনগণের ভূমিকাও যথেষ্ট। কারণ জনসাধারণ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন না করে তবে আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণ অসম্ভব। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় প্রজার ভূমিকাকে নাগরিক কর্তব্য হিসেবে সম্বোধিত করা হয়। 
বেদে সেই নাগরিক বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, 

"ও৩ম্ তা নঃ প্রজাঃ সং দুহ্রতাং সমগ্রা বাচো মধু পৃথিবী ধেহি মহ্যম্" ৷৷ -অথর্ব্ববেদ ১২|১|১৬|

অর্থাৎ, হে মাতৃভুমি! আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে বাণীর মধুরতা দান কর। আমরা ইহার সাহায্যে সকল প্রজা মিলিত ভাবে পূৰ্ণতা প্রাপ্ত হইব। 

➡️ আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণে ঐক্যবদ্ধতা:

আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে গণ্য করা হয় জনসাধারণের মাঝে বিভেদ বা ঐক্যের অভাব। ঐক্যহীন সমাজ কখনো শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্মাণ করতে পারে না। সেজন্য আমাদের নাগরিকদের মধ্যে সর্বদা ধারণ করতে হবে বেদের সেই অমোঘ সংগঠন সুক্তের আদর্শ। 

"সমানী প্রপা সহ বোঽন্নভাগঃ সমানে যোক্ত্রে সহ বো যুনজ্মি। সম্যঞ্চোঽগ্নিং সপর্যতারা নাভিমিবাভিতঃ"।। 
-অথর্ববেদ ৩/৩০/৬

অর্থাৎ, হে মনুষ্য ! তোমাদের জলের পান একসাথে এক হোক, খাদ্য গ্রহণ একসাথে এক হোক। তোমাদের সকলকে একই মন্ত্রে (বেদবাণীতে) যুক্ত করেছি, তোমাদের অগ্নিহোত্র একসাথে হোক ঠিক যেভাবে রথচক্রের কেন্দ্রের চারপাশে অর সজ্জিত থাকে।

"সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং ব্রতং সহ চিত্তমেষাম্।
সমানেন বো হবিষা জুহোমি সমানং চেতো অভিসংবিশধ্বম্ "॥ -অথর্ববেদ ৬/৬৪/২

অর্থাৎ, তোমাদের চিন্তা-চেতনা এক হোক, তোমাদের মন এক হোক, তোমাদের সম্মেলন, আধ্যাত্মিকতা এক হোক, পান, ভোজন একসাথে হোক, সকলের লক্ষ্য এক হোক।

🪷 হে সুনাগরিকবৃন্দ, বেদ আমাদের সুখী সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের পথনির্দেশ প্রদান করে। দ্বিধাবিভক্ত সমাজে আমাদের প্রয়োজন ঐক্যের, সে ঐক্যবদ্ধ সমাজের প্রয়োজন একজন উৎকৃষ্ট শাসকের, সেই শাসকের প্রয়োজন সর্বোত্তম অমাত্য বা সহায়কবৃন্দের, সেই সমগ্র ব্যবস্থা প্রয়োজন এক দায়িত্বশীল প্রজা তথা নাগরিক। শাসক যেন নিজেকে কখনো প্রভু মনে না করে, কারণ বেদে স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে যে শাসককে প্রজাগণ এনেছে। তাই শাসক হিসেবে নয় নিজেকে সেবক হিসেবে দেশ ও জাতির কল্যাণে উৎসর্গ করা শাসকের কর্তব্য।

▪️প্রচারে: VEDA

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন