"ঘরের শত্রু বিভীষণ নয়,
অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মাত্মা বিভীষণ"
রামায়ণ প্রত্যেক সনাতনীদের নিকট শুধু একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থই নয় বরং এর রয়েছে কিছু বিশেষত্ব। প্রাচীন বা মধ্যযুগ কিংবা বর্তমান সময়ে রামায়ণ সকলের কাছে ধর্মের এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, নীতিনৈতিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম সে সকল চরিত্র যেগুলো রামায়ণে কথিত হয় হয়েছে তার মধ্যে প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম। একজন রাজপুত্র ধর্মের নির্দেশ পালনে অটল, পিতৃসত্য পালনে নির্ভীক এবং একজন স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি আনুগত্য এসবই যেন শ্রীরামকে অনন্য করে তুলেছে। মাতা সীতাকে উদ্ধারে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর বীরোচিত আত্মত্যাগ এবং শৌর্য সকল বীরপুরুষের অনুপ্রেরণা। কিন্তু লঙ্কা বিজয় ও রাবণকে পরাজয়ে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম যেমন নন্দিত ও বীরের আসনে আসীন ঠিক তার বিপরীত আচরণ পরিলক্ষিত হয় ধর্ম পক্ষে অংশগ্রহণকারী লঙ্কারাজ রাবনের ভাই বিভীষণের। বর্তমান সমাজ তাকে দাড় করিয়েছে কাঠগড়ায়, কলঙ্কিত করেছে তা ধার্মিক চরিত্রকে এবং কুৎসিত প্রবাদ বাক্য প্রচলন করেছে, "ঘরের শত্রু বিভীষণ"। ইহা নিতান্তই মূর্খতার পরিচয়কেই নয় বরং একধরনের প্রোপাগাণ্ডার শিকার। যা বাংলার নন্দিত কবি, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃষ্ট মেঘনাদবধ কাব্য হতে সংগৃহীত বলে ধারণা করা হয়। যেখানে লম্পট রাবণকে আক্রান্ত, অসহায় রাজা এবং আক্রমণকারী হিসেবে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে, অধার্মিক রাবণের ভ্রাতা/ভাই বিভীষণকে দৃষ্ট করা হয়েছে বেঈমান এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে।
কিন্তু এরুপ প্রোপাগাণ্ডার সত্যতা কি ⁉️
বিভীষণ কি সত্যি বিশ্বাসঘাতক ছিলেন ⁉️
সত্যি কি বিভীষণ ঘরের শত্রু ⁉️
বিভীষণ এর চরিত্র এবং তার কার্যক্রম বুঝতে হলে আমাদের প্রয়োজন তার জীবনকে পর্যবেক্ষণের। কারণ বাল্মিকী রামায়ণ এ জানা যায় বিভীষণ ছিলেন একজন সত্যনিষ্ঠ, স্পষ্টভাষী এবং ধার্মিক ব্যক্তি। তিনি নিজে যেমন অন্যায় করতেন না, তেমনি কোনো অন্যায়কে সমর্থন বা সঙ্গ দেওয়া ছিল তার পক্ষে অসম্ভব।
সেজন্য তিনি লঙ্কাধিপতি রাবণের সামনেও নির্ভয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানান,
“ ঈদৃশৈস্ত্বং সমাচারৈর্যশোহর্থ কুলনাশনৈ:
ধর্ষণং প্রাণিনাং জ্ঞাত্বা স্বমতেন বিচষ্টসে । “
- বাল্মীকি রামায়ণ (৭।২৫।১৮)
অর্থাৎ, হে রাজণ স্ত্রী জাতির প্রতি আপনার এই অভিলাশ অত্যন্ত পীড়াদায়ক এতে ধর্মনাশ হয় তা জেনে ও আপনি এই কুলনাশক কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন ।
লঙ্কাধিপতি রাবণ যদিও জ্ঞানী ছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন অধার্মিক ও পাপাচারী। একজন ধার্মিক সদাচারী হিসেবে বিভীষণ কি করে রাবণের পক্ষপাত করতে পারেন? যদি নিজ আত্মীয় বন্ধু বা প্রিয়জন হওয়ার কারণে অধর্মকে অবলম্বন করতে হয় তাহলে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু থাকে?
মহাভারতে কর্ণ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা। যিনি দানবীর হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন জগৎ জুড়ে। কিন্তু যখন দ্যুতক্রীড়ার সময় তিনি পান্ডবদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে মৌন ছিলেন এবং যখন দ্রৌপদীর রাজসভায় অপদস্ত হেয় করার মতো ঘটনা সংগঠিত হচ্ছিল তখন তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। সেজন্য, কর্ণ কৃষ্ণ সংবাদে মহাভারতের কর্ণপর্বের ৯১ অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ণকে বলছেন ,
➡️ দুর্য্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনি তোমার মতানুসারে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে যে সভায় আনয়ন করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল?
➡️ যখন দুষ্ট শকুনি দুরভিসন্ধি-পরতন্ত্র হইয়া তোমার অনুমোদনে অক্ষক্রীড়ায় নিতান্ত অনভিজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠিরকে যে পরাজয় করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল?
➡️ যখন তুমি বারণাবতনগরে জতুগৃহমধ্যে প্রসুপ্ত পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিবার নিমিত্ত অগ্নি প্রদান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল?
৫। যখন তুমি সভামধ্যে দুঃশাসনের বশীভূতা” রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে, “হে কৃষ্ণে! পাণ্ডবগণ বিনষ্ট হইয়া শাশ্বত" নরকে গমন করিয়াছে, এক্ষণে তুমি অন্য পতিকে বরণ কর” এই কথা বলিয়া উপহাস করিয়াছিলে এবং অনার্য্য ব্যক্তিরা তাঁহাকে নিরপরাধে ক্লেশ প্রদান করিলে উপেক্ষা করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল?
➡️ যখন তুমি রাজ্যলোভে শকুনিকে আশ্রয়পূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে দ্যূতক্রীড়া করিবার নিমিত্ত আহ্বান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল?
➡️ যখন তুমি মহারথগণসমবেত হইয়া বালক অভিমন্যুকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক বিনাশ করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল?
উপরোক্ত প্রশ্ন সমূহ একজন ধার্মিকের বুদ্ধি বিবেকের প্রতি প্রশ্ন। যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ণকে করেছিলেন। কারণ কর্ণ ধর্মাচরণের সময় অধর্মের পক্ষে শস্ত্র ধরেছিলেন।
এরুপ অভিযোগ বিভীষণের প্রতিও আরোপিত হতো। যদি তিনি রাবণকে স্বীয় ধর্মকে স্মরণ না করিয়ে দিয়ে রাজপদের আশায় মৌন থাকতেন। কিন্তু ধর্মাত্মা বিভীষণ মাতা সীতাকে হরণকারী, দুষ্ট প্রকৃতির, শঠ, রাবণের পক্ষে নেওয়াকে অন্যায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। আজ বর্তমান প্রজন্ম সেই ধর্মাত্মা বিভীষণকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রতিপন্ন করছে।
সত্যি কি এরুপ অভিযোগ গ্রহণযোগ্য? নাকি সনাতনধর্মের পরম আরাধ্য মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর জীবনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এক অপপ্রয়াস মাত্র! বিভীষণের কি অন্যায় ছিল সে রাবণের পাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, ধর্মের পক্ষ নেওয়া, রাবণকে সুপথগামী হওয়ার জন্য আহ্বান করে বিতাড়িত হওয়া রাজ্য থেকে? ন্যায়ের পক্ষ নিয়ে, সত্যের ধ্বজাধারী হয়ে ধর্মাচরণ করা কখনো অন্যায় নয়, এবং সে জন্য বিভীষণ ঘরের শত্রু নয় বরং ধর্মের পক্ষ নেওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধ প্রতিবাদ করা এক সাহসী চরিত্র।
সম্পূর্ণ বিবেচনা আমরা বিবেকবান ব্যক্তিদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করলাম।