"মহর্ষি চরক ও প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান"
➡️ সভ্যতার উষা লগ্নে মনুষ্য জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানস্বরুপ ঋষিগণ ধ্যানের মাধ্যমে প্রাপ্ত করেন পরমাত্মার অমৃত জ্ঞান। যা মনুষ্য জাতির কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও মুক্তি লাভের পথপ্রদর্শক হিসেবে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু প্রাচীন ঋষিগণ সেই অমৃত জ্ঞান প্রাপ্ত করে ক্ষান্ত হননি বরং ইহার উপর ভিত্তি করে নিজেদের প্রজ্ঞা ও পুরুষার্থের অনন্য উন্নতি সাধন করে নব নব জ্ঞান অর্জন করে তারা মানব কল্যাণে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ষড়দর্শন, আয়ুর্বেদ, নীতিশাস্ত্রসহ বহুল গ্রন্থ রচনা করে মানবসভ্যতাকে নিয়ে গিয়েছেন উন্নতির চরম উৎকর্ষে। যে অমর জ্ঞান প্রাচীন ভারতে রচিত হয়েও জ্ঞানের আলোকদ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছে আরব হয়ে সূদুর পাশ্চাত্যে। সেরুপ, এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ চরক সংহিতা। যা সুশ্রুত সংহিতার মতো চিকিৎসা বিজ্ঞানে রেখেছে অনন্য অবদান। যার জ্ঞান ইবনে সিনার চিকিৎসা শাস্ত্রে যেরুপ প্রভাব ফেলেছিল, তেমনি আরব হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো ইউরোপে।
মহর্ষি চরক প্রাচীন ভারতের একজন চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের কনিষ্ক রাজার চিকিৎসক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। সেময়কালে তিনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতির সর্বপ্রথম সংকলনগ্রন্থ রচনা করেন, যা চরক সংহিতা নামে সমধিক পরিচিত।
📜 বহির্বিশ্বে চরকসংহিতা:
চরক সংহিতার মূল ভাষা ছিল সংস্কৃত। কিন্তু পরবর্তীতে তা আরবি, গ্রিক, ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বিখ্যাত আরব্য চিকিৎসক ইবনে সিনা আরবিতে অনূদিত চড়ক সংহিতা এবং তৎকালীন সময়ের চিকিৎসা শাস্ত্রের আকরগ্রন্থ সুশ্রত সংহিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সুশ্রুতসংহিতা এবং চরকসংহিতা উভয় গ্রন্থই ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আব্বাস এর সময় আরবি ভাষায় অনুদিত হয় এবং এর মাধ্যমে ইউরোপে প্রচারিত হয়।
📜 চরক সংহিতার বিবিধ বিষয়:
মহর্ষি চরক সংকলিত চরক সংহিতা আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিদ্যা শাস্ত্রের আকর গ্রন্থ। এতে বিভিন্ন রোগের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসাগুলো সংকলন করেন চরক। চরক সংহিতায় ১২০টি অধ্যায় রয়েছে, যা আবার ৮ অংশে বিভক্ত।
১. সূত্র-স্থানম্ ২. শারীর-স্থানম্ ৩.ইন্দ্রীয়-স্থানম্
৪. কল্প - স্থানম্ ৫. সিদ্ধি - স্থানম্ ৬.বিমান-স্থানম্
৭. নিদান-স্থানম্ ৮.চিকিৎসা-স্থানম্
📜 খাদ্য এবং স্বাস্থ্য:
চরক সংহিতায় খাদ্য ও তার পুষ্টি সম্বন্ধীয় বিবিধ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। অগণিত রোগ, শারীরিক এবং মানসিক, তাদের মূলের জন্য রয়েছে তমস (মূর্খতা, অন্ধকার)। কারক সংহিতায় বলা হয়েছে,
ত্রুটির মাধ্যমে, কেউ পাঁচটি ক্ষতিকারক বস্তুতে লিপ্ত হয়, প্রকৃতির তাগিদকে দমন করে এবং এমন কাজগুলি সম্পাদন করে যা অত্যন্ত ফুসকুড়ি। অজ্ঞতার মানুষ তখন রোগের অবস্থার সাথে একাত্ম হয়ে যায়। জ্ঞানের মানুষ, তবে, জ্ঞান দ্বারা শুদ্ধ এই অবস্থাগুলি এড়িয়ে যায়। একজনের কখনই কোন খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়, শুধুমাত্র এটির প্রতি আকাঙ্ক্ষা থেকে কাজ করা বা অজ্ঞতার দ্বারা পরিচালিত। সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শুধুমাত্র উপকারী খাবার খেতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, শরীর খাদ্যের ফল। — কারক সংহিতা ,1.XXVIII.41-48
"স্বাদ ছয়। এগুলি মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তীক্ষ্ণ, তেতো ও তেজস্বল্প।সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে, তারা শরীরকে পুষ্ট করে। অনুপযুক্তভাবে ব্যবহার করা (অতিরিক্ত বা ঘাটতি), তারা সত্যই দোষেরউস্কানি দেয় । দোশা তিনটি : ভাত , পিত্ত এবং কফ । যখন তারা তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে তখন তারা শরীরের জন্য উপকারী। তবে, যখন তারা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে, সত্যই তারা শরীরকে বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত করে।" — চরক সংহিতা, 3.I.3-4
📜 প্রাচীন ফার্মেসি সম্পাদনা:
চরক সংহিতার অসংখ্য অধ্যায়ে বীজ, শিকড়, ফুল, ফল, কান্ড, সুগন্ধি পাতা, বিভিন্ন গাছের বাকল, গাছের রস, পাহাড়ের ভেষজ, পশুদের দুধ থেকে শুরু করে প্রাণীদের মলত্যাগের বর্জ্য পর্যন্ত শনাক্তকরণ ও শ্রেণীবিভাগ করার জন্য আলোচনা করা হয়েছে।
📜 যৌন স্বাস্থ্য:
চরক সংহিতায় যৌন রোগের পাশাপাশি যৌন কর্মহীনতা এবং পুরুষত্বের চিকিৎসার তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শরীর পরিষ্কার করার পদ্ধতি, যৌন স্বাস্থ্য-উন্নতিমূলক আচরণ, আচরণ এবং খাদ্যের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
📜 মেডিকেলের আদর্শ ছাত্র:
চরক সংহিতায় একজন চিকিৎসক হওয়ার জন্য আদর্শ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে।
"তার হতে হবে মৃদু স্বভাবের, স্বভাবগতভাবে মহৎ, তার কাজের ক্ষেত্রে কখনোই অহংকারমুক্ত, দৃঢ় স্মৃতিশক্তি, উদার মন, সত্যের প্রতি নিবেদিত, একাকীত্ব পছন্দ করে, চিন্তাশীল স্বভাবের, রাগমুক্ত, চমৎকার চরিত্রের, সহানুভূতিশীল, একজন অধ্যয়নের শৌখিন, তত্ত্ব এবং অনুশীলন উভয়ের প্রতি নিবেদিত, যিনি সমস্ত প্রাণীর মঙ্গল কামনা করেন।" - চরক সংহিতা ৩.VIII.6 (সংক্ষিপ্ত)
হে অমৃতের সন্তানগণ! মহর্ষি চরক ছিলেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানের রুপকার। তার রচিত চরক সংহিতা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে দিয়েছে নবরুপ। নিজ ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ সম্পর্কে আমরা সত্যি কতটুকু জানি ⁉️
#veda #article #charak