মুক্তিযুদ্ধ ও হিন্দু ইতিহাস: ০৩


"শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা ও মাতৃভূমি"

➡️ প্রখ্যাত উদ্যোক্তা, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক, দানবীর


🖋️ বর্তমান সময়ে এরুপ সংশয় আবির্ভূত হয়ে থাকে ধর্ম নাকি দেশ। কিন্তু যারা এরুপ প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকে তারা ধর্মের স্বরুপ সম্পর্কে অবগত নয়। কারণ একজন মনুষ্যকে তার উৎকৃষ্টতার রুপরেখা প্রদান করে ধর্মই। সেই উৎকৃষ্টতার সর্বোত্তম গুণ দেশপ্রেম। দেশপ্রেম একজন সুনাগরিকের ধর্ম। যে ভূমিতে জন্ম ও বেড়ে উঠা সেই মাতৃভূমির প্রতি প্রত্যেকের রয়েছে এক দায়িত্ববোধ। সেজন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে, 

"বিশ্বস্বং মাতরমমোষাধীনাং ধ্রুবাং ভূমিং পৃথিবীং ধর্মণা ধৃতাম্। শিবাং স্যোনামনু চরেম বিশ্ব-হা"।।
-অথর্ববেদ ১২/১/১৭

অর্থাৎ, ওষুধি সমূহের মাতা, কল্যাণকারিণী ,
সুখদায়িনী, ধর্মকর্ত্তৃক ধৃতা এই স্থির ও বিস্তৃত
মাতৃভূমিকে সর্বস্ব অর্পণ করিয়া সর্বদা সেবা করিব।

বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। সেই মাতৃভূমির প্রতি রয়েছে দায়িত্ব এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রয়েছে ত্যাগের ইতিহাস। এ ভূমির স্বাধীনতার ইতিহাস সুদীর্ঘ।  বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম পাকিস্তানের দখলদারিত্বের শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে পুনরায় স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবময় ইতিহাস ভূমিপুত্রদের। 

সেই আত্মত্যাগকারী ভূমিপুত্রদের মধ্যে অন্যতম প্রখ্যাত উদ্যোক্তা, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক, দানবীর
"শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা"। যিনি স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে যেমন এ স্বদেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তেমনি এই গুণী ব্যক্তিকে আত্মবলিদান পর্যন্ত করতে হয়েছে। 

শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা ১৮৯৬ সালের ১৫ই নভেম্বর ঢাকা জেলার উপকণ্ঠ সাভারের কাছুর গ্রামে মাতুলালয়ে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা পোদ্দার এবং মাতার নাম কুমুদিনী দেবী। তার পৈতৃক নিবাস ছিল টাঙ্গাইল জেলার মীর্জাপুরে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি মীর্জাপুর বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা পৈতৃক সূত্রে ধনী ছিলেন না। তার পিতা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার মাতৃ বিয়োগ হয়। পরবর্তীতে তার পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। বিমাতার আশ্রয়ে বহু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ও অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে রণদা'র শৈশবকাল অতিবাহিত হয়।

সংগ্রাম: তিমি মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে যান।  সেখানে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে মুটের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হন। এরই মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করে কয়েকবার কারাবরণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সময় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স করে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) যান। সেখানে তিনি হাসপাতালে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোগীদের জীবন বাঁচালে তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত (১৯১৬) বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন প্রদান করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ সালে পঞ্চম জর্জের সাথে সাক্ষাতের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড সফর করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে রেলওয়ে বিভাগে টিকেট কালেক্টরের চাকরি নেন। পরবর্তীতে ১৯৩২ সালে তিনি রেলওয়ে বিভাগের টিকেট কালেক্টরের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন তিনি। উপার্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। চার বছরে ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৩৩ সালে দ্য বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি নামে নৌ-পরিবহন সংস্থা এবং নৌ-পরিবহন বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪২ - ১৯৪৩ সালে সরকারের খাদ্য-শস্য ক্রয়ের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৪৪ সালে নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন এবং জর্জ এন্ডারসনের কাছ থেকে 'জুট প্রেসিং বিজনেস' এবং 'গোডাউন ফর জুট স্টোরিং' ক্রয় করে নেন। এরপরে নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় ইংরেজদের মালিকানাধীন তিনটি পাওয়ার হাউস ক্রয় করেন। চামড়ার ব্যবসাও শুরু করেন এই সময়। 

অবদান: ব্যবসায় নিজ মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ধনকুবেরে পরিণত হন শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা। কিন্তু তিনি সেই অর্জিত অর্থ অকাতরে বিলিয়ে দেন আর্ত মানবতার সেবায়।  

📜 ১৯৩৮ সালে মির্জাপুরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট 'কুমুদিনী ডিস্পেনসারি' প্রতিষ্ঠা করেন,যা পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে কুমুদিনী হাসপাতাল নামে পূর্ণতা লাভ করে। 

📜 ১৯৪২ সালে তার প্রপিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামে 'ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ' স্থাপন করে ঐ অঞ্চলে নারীশিক্ষার সুযোগ করে দেন যা পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে ভারতেশ্বরী হোমস-এ রূপলাভ করে। 

📜 ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ স্থাপন করেন। 

📜 ১৯৪৭ সালে রণদাপ্রসাদ তার সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ গরীবদের উদ্দেশ্যে ব্যয় করার জন্য কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল নামে অলাভজনক প্রাইভেট কোম্পানী রেজিস্টার্ড করেন। 

📜 মীর্জাপুরে ডিগ্রী মহিলা কলেজ কুমুদিনী মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। 

📜 ১৯৪৩-৪৪ সালে সংঘটিত পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় রেডক্রস সোসাইটিকে এককালীন তিন লক্ষ টাকা দান করেন এবং ক্ষুধার্তদের জন্য চার মাসব্যাপী সারাদেশে দুইশত পঞ্চাশটি লঙ্গরখানা খোলা রাখেন। 

এছাড়াও তিনি টাঙ্গাইলে এস. কে. হাইস্কুল ভবন নির্মাণ এবং ঢাকার সমন্বিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) - এর প্রসূতি বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন দানবীর খুঁজে পাওয়া সত্যি দুষ্কর। তিনি তার অর্জিত সম্পদ ভোগবিলাসে ব্যয় না করে এই বাংলার মানুষের সেবায় নিবেদিত করেন। 

কিন্তু সেই অবদানের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকহানাদার বাহিনী শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ২৬ বছর বয়সী সন্তান ভবানীপ্রসাদ সাহা (রবি)-কে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু এক সপ্তাহ পর তারা বাড়ী ফিরে আসলেও পুনরায় ৭ মে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এবার আর তাদের ফেরা হয়নি। 

এই উদারচিন্তার মহৎপ্রাণ ব্যক্তির প্রতি যতই সম্মান প্রদর্শন করা হয় ততই কম হবে। মানবতাধর্মী কাজে সম্পৃক্ত থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার রণদাপ্রসাদ সাহাকে রায় বাহাদুর খেতাব প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মানবসেবায় অসামান্য অবদান রাখায় ও তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করেন।

শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমী নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সংগ্রাম। কিন্তু বর্তমানে কিছু স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এরুপ ধর্মীয় উসকানি প্রদানের উদ্দেশ্য এরুপ মন্তব্য উপস্থাপন ও প্রচার করে, সুমহান মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু জনগোষ্ঠীর কোনো অবদান নেই, এ দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর কোনো অবদান নেই। কিন্তু সত্যি কি হিন্দুরা এ ভূমির ভূমিপুত্র হিসেবে সর্বদা নির্লিপ্ত ছিলো? অবশ্যই না! বহু হিন্দু সংগঠক হিসেবে কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজ মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মনিয়োগ করেছে বা কখনো নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এ ভূমির কল্যাণে। শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা সেই আত্মত্যাগকারীদেরই একজন। 

⚠️ বিঃদ্রঃ উপরিউক্ত আর্টিকেল এর উদ্দেশ্য কোনো বিভেদ বা জাতিগত বিদ্বেষের প্রচার নয়। বরং বহুদিন ধরে প্রচলিত প্রোপাগাণ্ডার প্রত্যুত্তর। আমরা ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি, মহান মুক্তিযুদ্ধ সকল বাঙালি-অবাঙালি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ছিল।

⚡মুক্তিযুদ্ধ ও হিন্দু ইতিহাস: ০৩

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন