ধর্ষণ প্রতিরোধে কি করণীয় ⁉️
"সূর্য উদয় কবে হবে, হবে বিনাশ অসুরের
পাপীরা কবে পাবে শাস্তি, বিচার হবে ধর্ষণের"
মনুষ্য আজ সভ্যতার চরম শিখরে। প্রাচীন বর্বর যুগ অতিবাহিত করে আজ আমরা সভ্য হিসেবে গড়ে উঠেছি। তবে আমরা সভ্যতাকে গ্রহণ করলেও বর্বরতাকে সম্পূর্ণরুপে পরিত্যাগ করতে পারিনি। বর্তমান সময়ে এসেও কিছু মানুষ রুপী অসুরেরা আমাদের চতুর্দিকে ব্যপ্ত হয়ে আছে। যাদের হাতে সংঘটিত হচ্ছে সভ্য যুগের অসভ্য, বর্বর কার্যক্রম। সেই বর্বরতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ধর্ষণ।
নারী সমাজের অলংকার, জ্ঞানের জৌতি, গৃহের আলো সে নারীর প্রতি এমন অসভ্য বর্বরোচিত কর্ম কদাপি গ্রহণযোগ্য হতে পারে নাহ। শাস্ত্রেও নারীর প্রতি অসম্মানজনক কিংবা বর্বরোচিত কর্মের শাস্তির বিধান কঠোর।
যেমন মহর্ষি মনু বলেছিলেন,
পরদারাভিমর্ধেষু প্রবৃত্তান্নৃন্মহীপতিঃ। উদ্বেজনকরৈর্দন্ডৈশ্চিহ্নয়িত্বা প্রবাসয়েৎ"
-মনুস্মৃতি- ৮/৩৫২
অর্থাৎ, যারা নারীদের ধর্ষণ করে বা উত্ত্যক্ত করে বা ব্যভিচারে প্ররোচিত করে, তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তা অন্যদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে এবং কেউ তা করতে আর সাহস না পায়।
কিন্তু উপর্যুক্ত শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সময়ে নারী ধর্ষণ আশংকাজনক ভাবে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ধর্ষণ একটি ক্রম বর্ধমান সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ১০ জন ধর্ষণের শিকার হন।[১] ২০২১ সালে গৃহীত এক হিসবে পাওয়া গেছে যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পূর্ববর্তী ৫ বছরে ৩০ হাজার ২৭২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২ জন৷ ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী৷ ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে৷ আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী৷ বাংলাদেশে গণ ধর্ষণের ঘটনাও অহরহ ঘটে থাকে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন আবশ্যিক ভাবেই উত্থাপিত হচ্ছে যে ধর্ষণ প্রতিরোধে আমাদের কি করণীয় ⁉️
সমস্যা সমাধান এর পূর্বে সমস্যার মূলে প্রবেশ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণ এর কারণ কি?
ধর্ষণের কারণ হিসেবে কিছু ব্যক্তি বিশেষ নারীর পোশাককে দায়ী করে থাকে, কিছু ব্যক্তি নারীর একা চলাফেরাকে দায়ী করতে আগ্রহী।
কিন্তু এই মত গুলো রীতিমতো অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। নারীর পোশাক কখনোই ধর্ষণের কারণ হতে পারে নাহ। কারণ যে ধর্ষক সে নারী ভদ্র পোশাক পরিহিত হলেও কুদৃষ্টিতে তাকায় এবং বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ভদ্র পোশাক কিংবা শালীন পোশাক পরিধান করার পরেও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিংবা শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রেও দেখা যায় পোশাক কিংবা আপেক্ষিক কোনো বিষয় দায়ী নয়।
অন্য একটি ধারণাও সঠিক নয়। নারী বিপরীত লিঙ্গের মানুষটির মতোই স্বাধীন। উদাহরণস্বরূপ, রাত্রে বেলা একজন স্বর্ণব্যবসায়ী ঘরের ফেরার সময় স্বর্ণালংকার নিয়ে ফেরার সময় সে যদি ডাকাতির শিকার হয় তবে কি এটা স্বর্ণ ব্যবসায়ীর দোষ হবে নাকি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে এরুপ বলা হবে। তেমনি রাস্তা নিরাপদ না করে নারী রাস্তায় একা বের হলে সে ধর্ষনের শিকার হয়েছে এটা অযৌক্তিক নয় কি?
তবে কি কারণ হতে পারে ধর্ষণের?
ইহার উত্তর বেশ জটিল তবে স্পষ্ট। তা হলো কামুকতা। মানুষের মধ্যে কাম একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এই কাম তখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে যখন তা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। কামের প্রভাবে মানুষ অসৎ, হীন কিংবা অপরাধ করে থাকে। সেজন্য শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে,
ত্রিবিধং নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ।
কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতৎ ত্রয়ং ত্যজেৎ ॥ ২১
এতৈর্বিমুক্তঃ কৌন্তেয় তমোদ্বারৈস্ত্রিভির্নরঃ।
আচরত্যাত্মনঃ শ্রেয়স্ততো যাতি পরাং গতিম্ ॥
- গীতা ১৭/২২
সরলার্থ : হে কৌন্তেয় (অর্জুন)। কাম, ক্রোধ ও লোভ-এই তিন প্রকার নরকের দ্বার এবং আত্মার নাশক, সেজন্য এই তিনটিকে ত্যাগ করবে। এই তিন প্রকার তামসিক দ্বার (অর্থাৎ কাম, ক্রোধ ও লোভ) থেকে মুক্ত মানুষ নিজের কল্যাণসাধন করে, তারপর পরমগতি লাভ করে।
নিজের মধ্যে অবস্থিত কামরুপ নরকের দ্বার আমরা কখনোই লক্ষ্য করি নাহ। কিন্তু এই কাম আমাদের পাপে প্রবৃত্ত করে থাকে। কাম যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে জীবনকে সঠিক মার্গ প্রদান করতে পারে।
কামক্রোধবিযুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্।
অভিতো ব্রহ্মনির্বাণং বর্ততে বিদিতাত্মনাম্ ॥
- গীতা ১৭/২৬
সরলার্থ : কাম-ক্রোধ থেকে মুক্ত, সংযতচিত্ত, পরমাত্মাদর্শী জ্ঞানী মানুষ সকল দিকেই ব্রহ্মনির্বাণে স্থিত আছেন।
কাম নিয়ন্ত্রণ করা মনোগত বিষয়। সঠিক শিক্ষা, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা কামকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু সকলেই সে কামকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাহ। সেজন্য, ধর্মশাস্ত্রে যেমন পথপ্রদর্শক রুপে নীতিবাক্য রয়েছে তেমনি সেই বাক্য অমান্যকারীদের জন্য দন্ডবিধান।
বাংলাদেশের বর্তমানে প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী ২০২০) এর ৯ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড রয়েছে এবং অত্র আইনের ৩০ ধারা মোতাবেক যেকোনো সহায়তাকারীর একই দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।
এরুপ কঠোর শাস্তির বিধান থাকলে ধর্ষণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা একটি সভ্য সমাজের জন্য অশনিসংকেত। এরুপ ক্ষেত্রে আমাদের কি করণীয় হতে পারে?
ধর্ষণ প্রতিরোধে আমাদের করণীয় হতে পারে। ০৩টি।
১. পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা
২. শাস্তিবিধান দ্রুত ও প্রকাশ্যে কার্যকর করা
৩. আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার বিষয়ে সচেতন হওয়া
🔅 পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা:
পরিবার সভ্যতার সূতিকাগার এবং সমাজ তার বাহক। সেজন্য একজন মানুষের উপর সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী অন্যতম প্রধান উপাদান পরিবার ও সমাজ।
🔅ধর্মীয় মূল্যবোধ তৈরি করা এবং ধর্মীয় সভায় নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও বিষাদ রোধ করা ও নারীর প্রতি এরুপ বক্তৃতা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া
🔅আপনার সন্তানকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা প্রদান করা।
🔅পর্ণ নিষিদ্ধ করা এবং অশ্লীলতা রোধে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা।
🔅 সামাজিক সংগঠনগুলো সদস্যদের মাঝে এই সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং যোগ ব্যায়াম এর মাধ্যমে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রোগ্রাম চালু করা।
🔅 শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
🔅 শাস্তিবিধান দ্রুত ও প্রকাশ্যে কার্যকর করা:
বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে নারীর প্রতি যে শাস্তির বিধান রয়েছে তা দ্রুত ও প্রকাশ্যে কার্যকর করা। কারণ শাস্তির ভয় মানুষকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করতে পারে। প্রকাশ্যে কঠোর শাস্তিবিধান করা হলে
কেউ এরুপ অপরাধ করতে চেষ্টাও করবে নাহ।
🔅 আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার বিষয়ে সচেতন হওয়া:
আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার দণ্ডবিধি আইনে বর্ণিত এমন একটি বিধান যা একজন মানুষকে তার দেহ ও সম্পত্তি রক্ষার্থে অপর কোনো ব্যক্তির প্রতি যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলপ্রয়োগ করে নিজেকে রক্ষার বিধান। দণ্ডবিধি আইনের ৯৬-১০৬ ধারায় আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। সেজন্য নারীরা নিজেকে রক্ষার্থে অবশ্যই নিজের কাছে আত্মরক্ষার্থে কিছু জিনিস সংগ্রহে রাখবেন। যেমন, পেপার স্প্রে, ইলেক্ট্রিক শক কিংবা এক্সপেন্ডিং স্টিক।
ধর্ষণ প্রতিরোধ শুধু রাষ্ট্র নয়, বরং আমাদের সকলের দায়িত্ব। সেজন্য, সামাজিক শিক্ষা যেমন প্রয়োজন তেমনি কঠোর শাস্তিবিধান কার্যকর করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে এতটুকু বলবো, নারী দেবীতুল্য। নিজের বোনকে যেমন নিরাপদ দেখতে চান তেমনি অপরের বোনের নিরাপত্তার বিষয় ততটাই সচেতন ও প্রস্তুত থাকুন। একটাই বাক্য ধারণ করুন, "বোন হোক তোমার আমার, তার সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব সবার"
✏️ VEDA
#veda