পাকিস্তানি বাহিনী ও হিন্দু নিধন - ০৩


""বুরুঙ্গা গণহত্যা"

বিশ্বাস, প্রতারণা, হত্যা এসবই যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে জীবন দিতে হয়েছে হাজারো মানুষদের। তবে হয়তো সে প্রতারণা নির্দিষ্টভাবে একটি জনগোষ্ঠীর উপর পরিচালিত হয়েছে বারংবার। হ্যাঁ! বাঙালি হিন্দু নিধনে বিশ্বাস, প্রতারণা, হত্যা যেন আপন সুতোয় বাঁধা। সে মুক্তিযুদ্ধের প্রতারণার আশ্রয়ে কখনো হিন্দু মারোয়ারীদের উপর গোলাহাট গণহত্যা হয়েছে, তো কখনো শান্তি কমিটির পিস কার্ড বিতরণের নামে হত্যা করা হয় নিরীহ বাঙালি হিন্দুদের। 

বুরুঙ্গা গ্রামটি বাংলাদেশের সিলেট জেলার ওসমানীনগরে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে মার্চ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সমগ্র বাংলায় নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৫শে মে দুপুরবেলা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আসার খবরে বুরুঙ্গা এবং তার আশপাশের গ্রামের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিকাল ৪ টায় তারা স্থানীয় চেয়ারম্যান ইনজাদ আলীর সাথে দেখা করে। সাক্ষাৎ শেষে, বুরুঙ্গা এবং তার আশপাশের গ্রামে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয় যে ২৬শে মে, বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হবে এবং 'পিস কার্ড' বিতরণ করা হবে। 

ইতোমধ্যে ভয়ার্ত মানুষেরা জীবন বাঁচানোর শেষ সুযোগ ভেবে এই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে। তীব্র ভয় স্বত্বেও, বুরুঙ্গা এবং তার আশপাশের গ্রামের লোকজন বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এসে সকাল ৮টা থেকে জমা হতে থাকে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক হাজারেরও অধিক মানুষ এসে সমবেত হয়। সকাল ৯টার দিকে, সহচর আব্দুল আহাদ চৌধুরী এবং ডঃ আব্দুল খালেক, ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্যালয় মাঠে এসে উপস্থিত হয়।

ইতোমধ্যে, অন্য হানাদারদের দল গ্রামের ঘরে ঘরে যায় এবং পুরুষদের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতে আদেশ দেয়। পরবর্তীতে সকাল ১০টার দিকে, তারা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে জনতাকে পৃথক পৃথকভাবে দলবদ্ধ করে।

সাধারণ হিন্দুদের অফিস কক্ষে একত্র করা হয় এবং বাকিদের পরিচয় যাচাই করে বেশীরভাগ লোককে ছেড়ে দেয়া হয়। 

কিন্তু সে হিন্দুদের গাছের সাথে বেঁধে ফেলা হয়। ফলস্বরূপ, হিন্দু ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। এরই মধ্যে, একজন বন্দী হিন্দু, শ্রীনিবাস চক্রবর্তী একটি জানালা খুলতে সমর্থ হন। প্রীতি রঞ্জন চৌধুরী, বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, রানু মালাকার, একজন হিন্দু যুবকসহ বন্দীদের সাথে ছিলেন, জানালা দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের উপর গুলি চালায়, কিন্তু তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

দুপুরের দিকে, বিদ্যালয় ভবন থেকে হিন্দুদের বাহিরে মাঠে নিয়ে আসা হয় এবং তাদের নব্বই জনকে তিনটি সারিতে দাঁড় করানো হয়। ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনের নির্দেশে তিনটি লাইট মেশিনগান থেকে তাদের বার্স্ট ফায়ার করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন তাদের মৃতদেহের উপর কেরোসিন ঢেলে দিয়ে তাতে আগুন জ্বেলে দেয়। রাম রঞ্জন ভট্টাচার্য, সিলেট জজ কোর্টের একজন নামকরা এবং প্রভাবশালী উকিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা আটক হন, অতঃপর তাকে যেতে দেয়া হয়। তিনি তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে, তাকে পিছন থেকে গুলি করা হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ মারা যান। হত্যাকাণ্ডের পর, আব্দুল আহাদ চৌধুরী এবং ডঃ আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে আট থেকে দশ জন দোসরের একটি দল গ্রামে লুটপাট চালায় এবং নারীদের উত্ত্যক্ত করে। পরের দিন, পাকিস্তানি হানাদাররা আবার বুরুঙ্গায় আসে। চেয়ারম্যান ইনজাদ আলীর সহযোগিতায় তারা কিছু শ্রমিক ভাড়া নেয় এবং বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে একটি গর্তে দগ্ধ এবং অর্ধদগ্ধ অবশিষ্ট হিন্দু মৃতদেহগুলোকে কবর দেয়। শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, জিতেন্দ্র বাইদ্যা এবং অধির মালাকার সহ খুব কম লোকই, অনেকগুলো বুলেটে আহত হবার পরও এই হত্যাকাণ্ডে বেঁচে যায়।

আনুমানিক ৭১ থেকে ৯৪ জনের সেদিন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলো। বেঁচে যাওয়া শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর মতে, ৯৪ জন লোককে হত্যা করা হয়েছিল।

স্বাধীনতা এসেছিলো কিন্তু লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। সে রক্তের স্রোতে ভেসে এসেছিলো স্বাধীনতা। কিন্তু সে আত্মত্যাগ কি আমরা ভুলে যাচ্ছি? 

বিঃদ্রঃ উপরিউক্ত আর্টিকেল এর উদ্দেশ্য কোনো বিভেদ বা জাতিগত বিদ্বেষের প্রচার নয়। বরং বহুদিন ধরে প্রচলিত প্রোপাগাণ্ডার প্রত্যুত্তর। আমরা ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি, মহান মুক্তিযুদ্ধ সকল বাঙালি-অবাঙালি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ছিল।

পাকিস্তানি বাহিনী ও হিন্দু নিধন - ০৩

✏️ Run With Veda 

#veda

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন