আমরা ধর্মচর্চা কেন করবো?
✨ধর্ম কি এবং ধর্মের অর্থ :-
ধর্ম' শব্দের বিবিধ এবং ব্যাপক অর্থ। ধর্ম শব্দের সব থেকে ব্যাপক অর্থ, ব্যাকরণগত মূল ধাতু 'ধৃ' এর উপর আশ্রিত। 'ধৃ' অর্থ ধারণ করা। 'ধৃ' ধাতু দ্বারা নির্মিত হওয়ায় ধর্ম শব্দের অর্থ ধারণকারী। গুণ ও লক্ষণ ধারণ করা ধর্মের অভিপ্রায়। মহাভারতে ঋষি ব্যাসদেব বলিয়াছেন -
ধারণাদ্ ধর্মমিত্যাহুধর্মেণ বিধৃতা প্রজাঃ।
যঃ স্বাদ্ ধারণসংযুক্তঃ স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।। (মহা০-শান্তিপর্ব-১০৯/১১)
অর্থাৎ ধর্ম সব-কিছুকেই ধারণ করে এইজন্য ধর্মের নাম "ধর্ম", অধগতি প্রাপ্তি থেকে বাঁচায় এবং জীবন রক্ষা করে। ধর্মই সকল প্রজাকে ধারণ করে আছে; অতঃ যা দ্বারা ধারণ ও পোষণ সিদ্ধ হয়, তাহাই ধর্ম ; এরূপ ধর্মবেত্তাদের নিশ্চয়।
সূত্রার্থঃ- (যতঃ) যা দ্বারা (অভ্যুদয়) এই সংসারের [বিশ্বের] উন্নতি এবং (নিঃশ্রেয়স) মোক্ষ (সিদ্ধিঃ) সিদ্ধি হয় (স ধর্মঃ) তাকে ধর্ম বলা হয়।
অর্থাৎ যা দ্বারা বিশ্বের উন্নতির সহির শান্তি এবং উত্তম আনন্দ প্রাপ্তি হয় তাহাই ধর্ম।
আসুন এবার জানি কেন আসলে আমরা ধর্ম চর্চা করবো
সনাতন ধর্মে ধর্মচর্চা কেন করা উচিত, তা বোঝার জন্য এর গভীর দর্শন, উদ্দেশ্য ও ফলাফল বিবেচনা করা দরকার।
১. ধর্মের মূল উদ্দেশ্য:
সনাতন ধর্মে ধর্ম (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) চারটি পুরুষার্থের (জীবনের লক্ষ্য) মধ্যে প্রথম ও প্রধান। ধর্মচর্চা মূলত জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষা ও আত্মার উন্নতির জন্য করা হয়।
২. ধর্মচর্চার কারণ:
ক. আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি:
প্রতিদিনের পূজা-পাঠ, জপ, ধ্যান ও যোগ চর্চার মাধ্যমে মন ও আত্মাকে শুদ্ধ করা যায়।
অহংকার, লোভ, হিংসা, কামনা ইত্যাদি দূর করে শান্তি লাভ করা যায়।
ভগবানের নাম স্মরণ ও উপাসনার মাধ্যমে তাঁর কৃপা পাওয়া যায়।
খ. পুনর্জন্ম ও কর্মফল:
সনাতন ধর্ম অনুসারে, প্রতিটি কাজের ফল (কর্মফল) অবধারিত। সৎকর্ম করলে শুভ ফল ও দুষ্কর্ম করলে কষ্ট ভোগ করতে হয়।
তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আমরা কর্ম করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। অর্থাৎ আমরা বর্তমানে যে কর্ম করবো তাহার ফল পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত হবো।
ধার্মিক জীবনযাপন করলে পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায় (মোক্ষ লাভ)।
এরুপ তত্ত্বের উল্লেখ যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় করেছেন,
"যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ। নস সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্" ॥ ২৩
"তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ। জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কতুমিহাহসি" || ২৪
গীতা = [১৬/২৩-২৪]=
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া কর্মে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না, তাহার শান্তি-সুখও হয় না, মোক্ষলাভও হয় না। অতএব কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ, সুতরাং তুমি শাস্ত্রোক্ত ব্যবস্থা জানিয়া যথাধিকার কর্ম করিতে প্রবৃত্ত হও।
সুতরাং, যে ব্যাক্তি শাস্ত্র জ্ঞান তথা সনাতন চর্চা ব্যাতিত কর্মে লিপ্ত হয় সেই ব্যাক্তি কখনো মোক্ষলাভ করতে পারে না
গ. জীবন পরিচালনায় ধর্মীয় অনুশাসন:
ধর্ম আমাদের ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, শুদ্ধ-অশুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়।
ধর্মীয় বিধি-নিষেধ (যেমন অহিংসা, সত্যবাদিতা, ব্রহ্মচর্য, সংযম ইত্যাদি) মানবজীবনকে সুশৃঙ্খল করে।
ঘ. পার্থিব ও অপার্থিব কল্যাণ:
ধর্মচর্চার মাধ্যমে মানসিক শান্তি ও সুখ লাভ করা যায়।
এটি পরিবার ও সমাজে শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে।
ঈশ্বরের কৃপায় পার্থিব জীবনে উন্নতি ও মৃত্যুর পর শুভ গতি (স্বর্গ, মোক্ষ) লাভ হয়।
৩. ধর্মচর্চার মাধ্যম:
সনাতন ধর্মে বিভিন্ন পন্থায় ধর্মচর্চা করা হয়, যেমন—
জ্ঞানযোগ – শাস্ত্র অধ্যয়ন ও উপলব্ধির মাধ্যমে ঈশ্বরকে জানা।
ভক্তিযোগ – ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে তাঁর নিকট পৌঁছানো।
কর্মযোগ – সৎকর্ম ও নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা।
রাজযোগ – ধ্যান ও যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করা।
সনাতন ধর্ম চর্চার ফলে জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়। এটি কেবল পার্থিব কল্যাণই নয়, বরং মৃত্যুর পরও শুভফল বয়ে আনে।
Run with #veda