"অতিথি সেবাই, উত্তম সেবা"


"অতিথি সেবাই, উত্তম সেবা"

▪️অতিথি আপ্যায়ন প্রাচীন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এক শ্রদ্ধা ও ভাবাত্মকপূর্ণ কর্ম। অতিথিকে আগুন্তকঃ হিসেবে নয় বরং দেব মনোভাবে সমাদর করা বৈদিক সমাজের এক অনন্য নিদর্শন। সেজন্য, ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় বৈদিক  দর্শনের প্রতীক হিসেবে সমধিক পরিচিত বাক্য "অতিথিদেবো ভব" ( সংস্কৃত : अतिथिदेवो भव ), যার অর্থ "অতিথিদেবো ভগবানের সমতুল্য" । এই পরম্পরায় অতিথি প্রতি শ্রদ্ধার সাথে আচরণ করা হয়। এই নীতির কারণে  সর্বজনীনভাবে ব্যবহৃত "নমস্তে" শব্দের ব্যবহার হয় যার অর্থ তোমার মধ্যে বিদ্যমান দেবত্বের প্রতি আমি প্রণাম করি ।

এই মনোভাবর উৎপত্তি তৈত্তিরীয় উপনিষদ , শিক্ষাবল্লী ১/১১/২ থেকে অনুপ্রাণিত। যেখানে বলা হয়েছে, 

"মাতৃদেভো ভব, বন্ধুদেভো ভব, পিতৃদেভো ভব, পুত্রদেভো ভব, আচার্যদেভো ভব, অতিথিদেভো ভব"

অর্থাৎ, এমন হও যার কাছে মা ঈশ্বর, এমন হও যার কাছে বন্ধু ঈশ্বর, এমন হও যার কাছে পিতা ঈশ্বর, এমন হও যার কাছে সন্তান ঈশ্বর, এমন হও যার কাছে শিক্ষক ঈশ্বর, এবং এমন হও যার কাছে অতিথি ঈশ্বর।

▪️অতিথি কে ⁉️ মনুসংহিতা ৩/১০২ বলা হয়েছে, 
যার স্থিতি অনিত্য অর্থাৎ, তিনি পরগৃহে এক তিথি ভিন্ন অন্য তিথি বা অপর দিন অবস্থান করেন না তিনি অতিথি। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যিনি পূর্ন বিদ্ধান, পরোপকারী জিতেন্দ্রিয়,ধার্মিক, সত্যবাদী ছল-কপট রহিত,নিত্য ভ্রমনকারী মনুষ্য তাদের অতিথি বলা হয়। 

▪️অতিথি সৎকার: 

সনাতন ধর্মে সে বিদ্বান অতিথিকে সেবা করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কার্য। যা পঞ্চ মহাযজ্ঞের অন্যতম প্রধান যজ্ঞ অতিথি যজ্ঞ হিসেবে সমাদৃত। সেজন্য, বেদে বলা হয়েছে কদাপি অতিথি কে ভোজন করার পূর্বে গৃহকর্তা ভোজন করিবে নাহ। অথর্ববেদে বলা হয়েছে, 

" ইষ্টং চ বা এষ পূর্তং চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।। 
পয়শ্চ বা এষ রসং চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।। 
ঊর্জাং চ বা এষ স্ফাতিং চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।। 
প্রজাং চ বা এষ পশুংশ্চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।। 
কীর্তিং চ বা এষ যশশ্চগৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।। 
শ্রিয়ং চ বা এষ সংবিদং চ গৃহাণামশ্নাতি যঃ পূর্বোহতিথেরশ্নাতি।। 
এষ বা অতিথির্যচ্ছ্রোত্রিয়স্তস্মাৎ পূর্বো নাশ্নীয়াৎ।।
অশিতাবত্যতিথাবশ্নীয়াদ্ যজ্ঞস্য সাত্মত্বায় যজ্ঞস্যাবিচ্ছেদায় তদ্ ব্রতম"।।-অথর্ববেদ ৯/৬/৩/১-৮

অর্থাৎ, যে গৃহস্থ অতিথির পূর্বে ভোজন করেন তিনি গৃহের ইষ্টসুখ, পূর্ণতা, দুগ্ধ, রস, পরাক্রম, বৃদ্ধি, সন,পশু, কীর্তি, যশ, শ্রী এবং জ্ঞান ভোজন করেন। যিনি বেদজ্ঞানী, তিনিই অতিথি। সুতরাং অতিথির পূর্বে ভোজন করিবে না। অতিথির ভোজনের পর তিনি ভোজন করিবেন। শুভ কর্মময় জীবনের জন্য এবং তাহা নিরন্তর চালাইবার জন্য ইহাই নিয়ম। 

মহর্ষি মনু অতিথিকে সমাদার বিষয়ে বলেছেন, 

"সংপ্রাপ্তায় ত্বথিতয়ে প্রদদ্যাদাসনোদকে।
অন্নঞ্চৈব যথাশক্তি সৎকৃত্য বিধিপূর্বকম্॥"
- মনুস্মৃতি ৩/৯৯

অর্থাৎ, গৃহে স্বয়ং সমাগত অতিথিকে গৃহস্থ বসবার জন্য আসন্ন, হাত-পা ধোওয়ার জল এবং নিজের সামর্থ্য অনুসারে প্রস্তুত ব্যঞ্জনাদিসমন্বিত অন্ন বিধিপূর্বক দান করবেন।

"নবৈ স্বয়ং তদশ্লীয়াদতিথিং যন্ন ভোজয়েৎ।
ধন্যং যশস্যমায়ুষ্যং স্বর্গ্যঞ্চাতিথিপূজনম্॥"
- মনুস্মৃতি ৩/১০৬
 অর্থাৎ, যেসব উৎকৃষ্ট দ্রব্য অভ্যাগত অতিথিকে ভোজন করানো হবে না, এমন খাদ্য গৃহস্থ স্বয়ং কখনই ভোজন করবেন না। অতিথি সেবার দ্বারা সৌভাগ্য, যশ, আয়ু এবং সুখ লাভের কারণ হয়।

নিজ সামর্থ্য যদি স্বল্প হয়, তবুও অতিথি সৎকার থেকে বিরত থাকা অনুচিত। বরং, নিজের সেই স্বল্প সামর্থ্য দ্বারা অতিথির সেবা করা ধর্মকার্য। 

"তৃণানি ভূমিরুদকং বাক্ চতুর্থী চ সূনৃতা।
এতান্যপি সতাং গেহে নোচ্ছিদ্যন্তে কদাচন॥"
- মনুস্মৃতি ৩/১০১
অর্থাৎ, অতিথিসেবা গৃহস্থের নিত্য-অনুষ্ঠেয় কর্ম হলেও, যাঁরা দরিদ্র এবং শিলোঞ্জনের দ্বারা জীবন যাপন করেন, তাঁদের পক্ষে হয়তো অর্থব্যয়সাধ্য অন্নদানের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তবুও কোনও না কোনও ভাবে অতিথিসেবা করা যায়। যেমন-) বসবার জন্য কুশকাশাদি তৃণের আসন, বিশ্রামের জন্য ভূমি বা স্থান, হাত-মুখ ধোওয়ার জন্য বা পানের জন্য জল, এবং চতুর্থতঃ হিত ও মিষ্ট কথা-এগুলি কখনও ধার্মিক ব্যক্তিদের গৃহে লোপ পায় না অর্থাৎ এগুলির অভাব হয় না।

▪️অতিথিকে সেবা করার মধ্যে যেমন প্রগতি রয়েছে। তেমনি অতিথির প্রতি অনাদর করার জন্য অধঃপতন হয়ে থাকে। এরূপ বিষয়ে উপদেশ দিয়ে কঠোপনিষদে যমের গৃহে নচিকেতার আলংকারিক বর্ণনা দিয়ে ঋষি বলেছে, 

"আশা প্রতীক্ষে সঙ্গতং সূনৃতাং চ ইষ্টাপূর্তে পুত্রপশূংশ্চ সর্বান্। এতদ্ বৃঙ্ক্তে পুরুষস্যাল্পমেধসো য়স্যানশ্নন্ বসতি বসতি ব্রাহ্মণো গৃহে।।" - কঠ ১/১/৮ 

অর্থাৎ, যে পুরুষের গৃহে ব্রহ্মজিজ্ঞাসু বিদ্বান অতিথি অনাহারে বাস করে, সেই অল্পবুদ্ধি পুরুষের আশা ও প্রতীক্ষা, সৎসঙ্গের ফল, প্রিয়বাক্য প্রয়োগের ফল, যজ্ঞাদি শ্রৌত কর্মের ফল এবং সামাজিক কর্মের ফল, পুত্র ও গৃহপালিত পশু - এই সবকিছু অসৎকারকৃত অতিথি নষ্ট করে দেয়। 

সেজন্য হে আর্যপুত্র! সকলে সর্বদা নিজ গৃহে বিদ্বান অতিথিকে সেবা করার প্রয়াস করি। সে ব্রহ্মজ্ঞানী মহাত্মা থেকে জ্ঞান লাভের প্রয়াস করি। নিজ সামর্থ্য দ্বারা জিতেন্দ্রিয় অতিথির সমাদর করি। এটাই ধর্মকার্য, অবশ্য পালনীয় অতিথি যজ্ঞ।

🔎Run with #veda

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

🔸সনাতন ধর্ম ও নারী 💐

সনাতন ধর্মে কি গোমূত্র পানের উল্লেখ রয়েছে ⁉️

▪️একাদশী" কি শাস্ত্র সম্মত ❓