"আমিই সনাতনী, আমিই হিন্দু"
"আমিই সনাতনী, আমিই হিন্দু"
▪️সৃষ্টি প্রারম্ভ থেকে অন্ত অবধি যা সদা নবীন ও বিদ্যমান তা সনাতন। পরমাত্মার সে অপৌরুষেয় বাণী সমগ্র সনাতন। সেজন্য পরমাত্মার সৃষ্ট ধর্মও সনাতন। সনাতন ধর্মকে কদাপি ভৌগোলিক সীমারেখায় কিংবা সম্প্রদায়ের গন্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা যায় নাহ। কারণ, সনাতন ধর্ম বিশ্বজনীন, সর্বত্র অস্তিত্ববান এবং সকলের জন্য। কোনো মনুষ্য হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে কিংবা স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে কেউ সনাতন ধর্ম নিয়ে আসেনি বরং এই জগৎ যে নিয়মে সৃষ্ট ও পরিচালিত এবং ধ্বংস হবে তাকে সনাতন ধর্ম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
▪️সনাতন ধর্ম জ্ঞানের ধারণ ও বিকাশে সদা তৎপর। তবে এই সনাতন জ্ঞানের সর্বোত্তম বিকাশ ঘটেছে এই আর্যাবর্তে, যা ভারত হিসেবে সমধিক পরিচিত। অসুরের আক্রমণে যেমন যজ্ঞবেদী ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও সে যজ্ঞের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বিনষ্ট হয়ে যায় নাহ, তেমনি ম্লেচ্ছের আগ্রাসনে এই মহান পূণ্যভূমি বারংবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে নিঃশেষ হয়ে যায় নাহ। বরং সে আপন দীপ্তিতে পুনঃপুন জাগ্রত হয়ে জগতকে দিশা প্রদান করে।
▪️তবে ঐশ্বরিক সার্বজনীন পরিচয়ের পাশাপাশি লোকায়ত ধারায় ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন জাতিপরিচয়ের উন্মেষ ঘটে। তেমনি এক পরিচয়ের নাম"হিন্দু"। "হিন্দু জনগোষ্ঠী" এই শব্দযুগল এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার স্মারক বহন করে। কিন্তু এই শব্দের উৎপত্তি, প্রয়োগ ও ঐতিহাসিকতা ব্যাপক ও বিস্তৃত।
▪️ঐতিহাসিকদের মতে সংস্কৃত শব্দ সিন্ধু থেকে উদ্ভূত হয়েছে হিন্দু শব্দের। সিন্ধু নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছিলো বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতা। কিন্তু তৎকালীন সময়েও এই অঞ্চলের মানুষকে হিন্দু হিসেবে ডাকার প্রচলন শুরু হয়নি। গেবিন ফ্লাডের মতে, প্রাচীন পারস্যের (Persia) মানুষরা 'সিন্ধু' উচ্চারণ করতে পারত না—তারা ‘স’ ধ্বনিকে ‘হ’ উচ্চারণ করত। তাই ‘সিন্ধু’ → ‘হিন্দু’ হয়ে যায়। পারসিক শাসক দারায়ুস (Darius I) এর (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) শিলালিপিতে হিন্দু শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। যা হিন্দু শব্দের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে আরব, পারসিক ও আফগানরা উক্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রথম "হিন্দু" নামে অভিহিত করে। মধ্যযুগীয় ভারতের ঐতিহাসিক বিবরণীগুলি থেকে দেশীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার বর্ণনায় হিন্দু শব্দটির প্রয়োগের কথা জানা যায়। পরবর্তীকালের আরবি সাহিত্যেও আল-হিন্দ الهند শব্দটির মাধ্যমে সিন্ধু নদ অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে। সেজন্য, হিন্দু শব্দের প্রয়োগ ভৌগোলিক অর্থে করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, হিন্দু শব্দের উল্লেখ বৈদিক শাস্ত্রে পাওয়া যায় নাহ। শুধুমাত্র পারস্য কিংবা আরবে নয় বরং প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা পরিভাষায় হিন্দু শব্দের প্রয়োগ না-হয়ে ইন্দু শব্দের ব্যবহার হতো। ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ও ঔপনিবেশিকরা ভারতীয় ধর্মের অনুসারীদেরকে একত্রে (একক কোন ধর্মকে নয়) হিন্দাস হিসেবে নির্দেশ করতো। ফলে, বর্তমানে এসেও সিন্ধু নদীকে ল্যাটিন এবং পরবর্তীতে ইংরেজিতে Indus River এবং সিন্ধু সভ্যতাকে Indus civilization হিসেবে বোঝানো হয়ে থাকে। সে গ্রীকদের পরিভাষা থেকে ইংরেজ শাসন শুরু থেকে ভারতের নাম "India" হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। ঐতিহাসিকদের এই ধারণা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু এই অঞ্চলে বসবাসকারী ভূমিপুত্রদেরকে বলা হতো। সে যেরুপ দর্শন কিংবা মতবাদই অনুসরণ করুক না কেন সে হিন্দু হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এই বিশ্লেষণ থেকে আমাদের নিকট স্পষ্ট যে, হিন্দু শব্দের যথেষ্ট প্রাচীন কিন্তু নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হওয়ার ইতিহাস একদমই মধ্যযুগীয়।
▪️কিন্তু গ্রীক এবং পারস্যে প্রাচীন সময়ে হিন্দু শব্দের প্রয়োগ সিন্ধু শব্দের সঠিক উচ্চারণ না করার ব্যর্থতা থেকে হলেও পরবর্তী সময়ে হিন্দু শব্দটি ফার্সি এবং সকল তুর্কিক ভাষায় কালো অর্থে ব্যবহৃত হত৷ সুফি কবি হাফিজ সিরাজী তার বহুল প্রচলিত পঙ্ক্তিতে কালো নির্দেশে ব্যবহার করেছেন৷ মুগলাই হিঙ্দোস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মির্জা তার আত্মজীবনী তুজুক ই বাবরী তে কালো মানুষদের বোঝাতে হিন্দু শব্দটি ব্যবহার করেছেন৷ অর্থাৎ, মধ্যযুগে এই ভূমির মানুষদের হীন চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে হিন্দু শব্দ দ্বারা বিভক্ত করা হতো। যা দৃষ্টান্ত হিন্দুকুশ পর্বতমালার নামকরণ।
▪️তবে বাঁকে বাঁকে প্রবাহিত নদীর মতো হিন্দু শব্দ এক ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল। সংগ্রামের, ত্যাগের এবং টিকে থাকা এক ভৌগোলিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠার এক সংগ্রামী জাতির ইতিহাস বহন করে হিন্দু শব্দ।
🔅কিন্তু বর্তমান সময়ে এরুপ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে যে, আমরা সনাতনী নাকি হিন্দু। ইহা সত্যি অমূলক এক সংশয়। কারণ, আমিই সনাতনী, আমিই হিন্দু।
▪️আমাদের ধর্ম সনাতন। সেজন্য ধর্মশাস্ত্রে সনাতন ধর্মকে ধারণ করে জীবন অতিবাহিত করার মনুষ্যদের আর্য হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে এবং প্রাচীন কালে সনাতন ধর্মকে বৈদিক ধর্ম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সেজন্য, আমাদের সে শাস্ত্র বিধান অনুসারে আমরা সকলে সনাতনী। কিন্তু আমরা ভৌগোলিক অর্থে হিন্দু। অপর ভূমিপুত্রেরা তাদের সে ভৌগোলিক হিন্দু পরিচয় থেকে বিস্মৃত হয়েছে কিন্তু একমাত্র সনাতনীরাই এই সংগ্রামী চেতনার "হিন্দু" শব্দকে হৃদয়ে ধারণ করে সমগ্র বিশ্বে প্রভাব রেখে চলেছে প্রতিনিয়ত।
সেজন্য, আমি হিন্দু- এ আমার ভৌগোলিক পরিচয়
আমি আর্য- এ আমার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়
আমি সনাতনী - এ আমার শাস্ত্রের পরিচয়
"আমিই সনাতনী, আমিই হিন্দু" - এ পরিচয় আমার, আমাদের ইতিহাস, সংগ্রাম ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারক।
কথোপকথনে যোগ দিন