"অভিমন্যু - অদম্য এক যোদ্ধা"
🔆 অস্ত্র হাতে উঠলে কেউ যোদ্ধা হয়ে যায় নাহ, শত্রু সংহার করলে কেউ বীর হয়ে যায় নাহ। বীর তো সে যে রণাঙ্গন থেকে পশ্চাৎপদ হওয়ার অপেক্ষা মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে। সেজন্য মহাভারতে বলা হয়েছে,
"ক্ষত্রিয়ের কখনো ভিক্ষা করা উচিত নয়। তার জন্য সনাতন কর্তব্য হলো, যুদ্ধে বিজয় লাভ করা বা যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করা। এটিই ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম। দীনতা বা ভীরুতা ক্ষত্রিয়ের জন্য প্রশংসনীয় নয়।" - মহাভারত ৫।৭৩।৩-৪
মহাভারতের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে বীরত্বের জয়গান, যোদ্ধার রণহুংকার, রণাঙ্গনের প্রতিধ্বনি। কিন্তু শুধুমাত্র বিজয় অর্জনই বীরত্বের প্রমাণ ছিল নাহ বরং বীরদর্পে রণাঙ্গনে আত্মত্যাগ করা প্রতিটি যোদ্ধা ছিল বীর। তবে সে বীরদের শ্রেষ্ঠত্ব
কে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন একজন। যার অদম্য স্পৃহা কুরুক্ষেত্রকে পরিণত করেছিলো বীরত্বের চারণভূমিতে। যার তীক্ষ্ণ বাণের সম্মুখে অসহায় হয়ে পড়েছিল গুরু দ্রোণের রণকৌশল, কর্ণের বীরত্বের দম্ভোক্তি কিংবা দুর্যোধনের অজেয় মনোভাব। নিরস্ত্র হয়েও যিনি যুদ্ধের ময়দানে অসহায়ত্বকে নয় বরং রথের চক্র উঁচিয়ে ধরে জানান দিয়েছিলেন, "ওহে অধর্মী কাপুরষ! তোমার আমার প্রাণ কেড়ে নিতে পারো, বীরত্বকে নয়। যুদ্ধই ক্ষত্রিয়েরই ধর্ম, মৃত্যু তার রাজটিকা"
🔆 সে অজেয় যোদ্ধা অর্জুন-সুভদ্রা পু্ত্র, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের শিষ্য অভিমন্যু। যার বীরত্ব ছাপিয়ে গিয়েছে পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য, অঙ্গরাজ কর্ণ ও অজেয় যোদ্ধা অর্জুনকেও। মৃত্যু নামক রাজটিকা যে বীরের বীরত্বকে প্রমাণ করে, সে রাজটিকা কপালে ধারণ করেছিলেন অভিমন্যু।
অভিমন্যু কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত অন্যান্য যোদ্ধাদের থেকে কনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু যুদ্ধকৌশল ও সাহসের ক্ষেত্রে সে ছিল অনন্য ও অতুলনীয়। অর্জুন পুত্র অভিমন্যু পিতার মতোই শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন। কনিষ্ঠ হলেও তিনি কৌরব পক্ষের জন্য হয়ে উঠেছিলেন বিভীষিকা। মৃত্যু দিনেও তার প্রলয় নিত্য এতই ভয়ংকর সুন্দর হয়ে উঠেছিল যে কৌরব পক্ষের ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ জীবন বাঁচাতে পলায়নপর হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
"অভিমন্যুর পরাক্রম দেখে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ এবং অন্যান্য যোদ্ধারা সকল দিকে দৃষ্টিপাতপূর্বক, শুষ্কমুখ নিয়ে, অস্থিরনয়ন এবং ঘর্মাক্ত দেহের সাথে রোমাঞ্চিতশরীর নিয়ে জীবন বাঁচানোর অভিপ্রায়ে নিহত পুত্র, পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু ও সম্বন্ধীদেরকে পরিত্যাগ করেই নিজ নিজ বাহন, হস্তী ও অশ্বগণকে দ্রুততার সাথে চালিয়ে সমরাঙ্গন হতে প্রস্থান করলেন।" - মহাভারত, দ্রোণপর্ব, অধ্যায় ৩৩, শ্লোক ১৫- ৪৫
🔆 যোদ্ধা হিসেবে অভিমন্যুর তুলনা সে নিজেই। কিন্তু অদম্য মনোভাব সে যোদ্ধাকে পরিণত করেছিলো অজেয় যোদ্ধা রুপে। সেজন্য, সেনাধ্যক্ষ গুরুদ্রোণ অভিমন্যু বধের অভিপ্রায়ে রচনা করেছিলেন রণাঙ্গনের দূর্ভেদ্য ব্যুহ চক্রব্যুহ। কিন্তু সে ব্যুহ হয়ে উঠে অমর কাব্য রচনার উৎকর্ষ ভূমি।
গুরু দ্রোণ কর্তৃক দূর্ভেদ্য ব্যুহে প্রবেশের শুরু থেকে শত্রু সংহারে উদ্যত থাকেন অভিমন্যু। যেন কুরুক্ষেত্র প্রলয়ঙ্কর নৃত্যে মেতে উঠেছে। মহাভারতের দ্রোণ পর্বের ৩৩তম অধ্যায়ে অভিমন্যুর অমর বিজয়গাথাঁ উল্লেখ রয়েছে। সে বর্ণনা অনুসারে,
"অভিমন্যু দ্রোণের সমক্ষেই ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করে শত্রুসংহার শুরু করেন। সাথে সাথে গজারোহী, অশ্বারোহী, রথী ও পদাতিক সৈন্য অস্ত্র উত্তোলনপূর্বক অভিমন্যুকে পরিবেষ্টন করেন। তাঁরা আসতে লাগলে বীর, শীঘ্রযোধী, মহাবল, দ্রুতাস্ত্রক্ষেপী ও মর্মজ্ঞ অভিমন্যু মর্মভেদী বাণদ্বারা তাঁদের বধ করতে থাকেন।"
"পতঙ্গ যেমন অগ্নির দিকে ধাবিত হয় ঠিক সেরূপ সৈন্যগণ অভিমন্যুর দিকে ধাবিত হতে লাগলেন। যাজ্ঞিকেরা যেরূপ কুশদ্বারা যজ্ঞের বেদি আবৃত করেন ঠিক সেরূপ অভিমন্যু শত্রুদের শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা সমরভূমি আবৃত করলেন'।"
"অভিমন্যু অস্ত্রের দ্বারা বিপক্ষীয় সৈন্যদলের হস্তাবাপ (চর্ম নির্মিত হস্তাবরণ), অঙ্গুলিত্র (চর্ম নির্মিত অঙ্গুলি রক্ষক), ধনুক, বাণ, তরবারি, ঢাল, অঙ্কুশ, অশ্বমুখরজ্জু, তোমর, পরশু, গদা, লৌহগোলক, ঋষ্টি, পট্টিশ, ভিন্দিপাল, পরিঘ, শক্তি, কম্পন, চাবুক, মহাশঙ্খ, কুন্ত, কচগ্রহ, মুদ্গর, ক্ষেপণী, পাশ, পরিঘতুল্য প্রস্তর, কেয়ূর ও অঙ্গদযুক্ত মনোহরচন্দনলিপ্ত সহস্র সহস্র বাহু ছেদন করতে লাগলেন। শত্রুগণের বহুতর মস্তকদ্বারা সমরভূমি আবৃত হলো।"
"সেইসব মস্তকের বর্ণন - নাসিকা, মুখ ও কেশপ্রান্ত সুন্দর ছিল। কোন ক্ষতচিহ্ন ছিল না। সুন্দর কুণ্ডল ছিল, ক্রোধে দন্ত দ্বারা ওষ্ঠ দংশন করছিল। গলা হতে প্রচুর রক্ত নির্গত হচ্ছিল।"
"অভিমন্যু পরক্ষণেই বাণদ্বারা যথাবিধানে সুসজ্জিত বহুতর রথকে খন্ড খন্ড করলেন। সেখানে উপবিষ্ট যোদ্ধাদের ও নিহত করলেন। পুনরায় সুরধার বাণসমূহদ্বারা বিপক্ষীয় হস্তিগণকে আরোহীগণের সাথে নিপতিত করলেন। তাঁদের পতাকা, অঙ্কুশ, তূণ, বর্ম, মধ্যবন্ধনরজ্জু, গ্রীবালঙ্কার, কম্বল, ঘন্টা, শুণ্ড, দন্তের অগ্র, ক্ষুর, মালা ও অনুচর প্রভৃতিকে ছেদন করলেন।"
"তারপর অশ্বারোহীদের পালা। শক্তি, ঋষ্টি ও প্রাসযোধী শিক্ষিত যোদ্ধারা যে অশ্বগুলোর উপরে আরোহণ করে ছিলেন, যে অশ্বগণ আরোহীগণকে সুন্দরভাবে বহন করতেন এবং যেই অশ্বসমূহ অত্যন্ত বেগবান ছিলো, সেই বিচিত্র ঘন্টাযুক্ত বনায়ু, কম্বোজ, বাহ্লিকদেশীয় এবং পার্বতীয় উত্তম উত্তম অশ্বকে আর সেগুলোর আরোহীগণকে সহ নীপতিত করে একাই অভিমন্যু অচিন্তনীয় অতিদুষ্কর কার্য করে শোভা পেতে থাকলেন।"
🔆 নিঃসঙ্গ যোদ্ধা একাই যেন কৌরবদের বিনাশ করে চলেছেন। এমন প্রলয়নৃত্যকে মহাভারতে মহাদেব এর অসুর বিনাশের সমতূল্য বলা হয়েছে।
"পূর্বকালে মহাতেজা মহাদেব যেমন ভয়ংকর অসুরসৈন্য আলোড়ন করে ছিলেন সেরূপ অভিমন্যু চতুরঙ্গ বিশাল কৌরবসৈন্যে আলোড়ন করলেন। অভিমন্যু যুদ্ধে বিপক্ষের অসহ্য কার্য যেমন শত্রুপক্ষের পদাতিক বিশাল সৈন্যকেও বিশ্লিষ্ট করলেন।"
🔆 এমন প্রলয়নৃত্য কৌরবদের হৃদয় কম্পিত হবে ইহা আশ্চর্য হওয়ার কি বা আছে এবং পলায়ন ব্যতীত কি উপায় থাকিতে পারে আর ⁉️
"অভিমন্যুর পরাক্রম দেখে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ এবং অন্যান্য যোদ্ধারা সকল দিকে দৃষ্টিপাতপূর্বক, শুষ্কমুখ নিয়ে, অস্থিরনয়ন এবং ঘর্মাক্ত দেহের সাথে রোমাঞ্চিতশরীর নিয়ে জীবন বাঁচানোর অভিপ্রায়ে নিহত পুত্র, পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু ও সম্বন্ধীদেরকে পরিত্যাগ করেই নিজ নিজ বাহন, হস্তী ও অশ্বগণকে দ্রুততার সাথে চালিয়ে সমরাঙ্গন হতে প্রস্থান করলেন।"
🔆 সে পলায়নকৃত সৈন্যদের দুর্দশা দেখে দুর্যোধন এর হৃদয় শান্ত থাকতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে, ক্রুদ্ধ দুর্যোধন অভিমন্যুর দিকে অগ্রসর হয়েছিল। ঠিক যেন, পিপীলিকা অগ্রসর হয় অগ্নির দিকে ভস্মীভূত হতে। কিন্তু সেনাধ্যক্ষ দ্রোণাচার্য রাজার হঠকারিতাকে থামিয়ে তাকে রক্ষার আদেশ দিয়েছিলেন।
"আপনারা রাজাকে রক্ষা করুন। বলবান অভিমন্যু আমাদের সমক্ষেই তাঁর লক্ষ্য দুর্যোধনকে বধ করতে সমর্থ। অতএব আপনারা দুর্যোধনের সাথে যান, ভয় করবেন না, সত্ত্বর দুর্যোধনকে রক্ষা করুন"
এমন পরাক্রম গুরু দ্রোণের হৃদয়ে সত্যি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। নচেৎ, এমন আদেশ কেন ⁉️ দুর্যোধন হয়তো সেদিনই অভিমন্যুর শিকার হয়ে যেতেন।
🔆 অভিমন্যুকে একা পরাস্ত করা অসম্ভব। অর্জুন পুত্র নয় যেন স্বয়ং গাণ্ডীব ধারী অর্জুন নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অভিমন্যুকে পরাস্ত করতে এবং দুর্যোধন এর প্রাণ রক্ষার্থে-
"অস্ত্রে সুশিক্ষিত, বলবান, হিতৈষী, বিজয়শোভী অথচ অভিমন্যুর ভয়ে ভীত যোদ্ধারা দুর্যোধনকে পরিবেষ্টিত করলেন। দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, কর্ণ, কৃতবর্মা, শকুনি, বৃহদ্বল, শল্য, ভূরিশ্রবা, শল, পৌরব ও বৃষসেন এঁরা একত্রে সুধার বাণবর্ষণ করতে থেকে অভিমন্যুকে আবৃত করতে ফেললেন। তাঁরা অভিমন্যুকে মোহিত করে মুখ হতে আকৃষ্ট গ্রাসের ন্যায় দুর্যোধনকে মুক্ত করলেন। কিন্তু অভিমন্যু তা সহ্য করলেন না। বিশাল শরজালদ্বারা অশ্ব ও সারথিদের সাথে সেই মহারথগণকে পলায়নপর করে সিংহনাদ করলেন। তা দেখে দ্রোণপ্রভৃতি অত্যন্তক্রুদ্ধ হয়ে অভিমন্যুকে পরিবেষ্টন করে নানাচিহ্নযুক্ত বাণ সমূহ নিক্ষেপ করলেন। অভিমন্যু সেই বাণ আকাশেই ছেদন করে, অপর বাণে তাঁদের ও বিদ্ধ করলেন। তীরের ন্যায় এক অভিমন্যুই বাণদ্বারা উদ্বেলিত সমুদ্রতুল্য সৈন্যগণকে ধারণ করলেন। সেই মহাসংগ্রামে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুঃসহ ৯টি বাণ দ্বারা অভিমন্যুকে বিদ্ধ করলেন। এছাড়া দুঃশাসন ১২ টি, কৃপ ৩ টি, দ্রোণ তীক্ষ্ণবিষ-সর্পতুল্য ১৭ টি, বিবিংশতি ৭০ টি, কৃতবর্মা ৭ টি, বৃহদ্বল ৮ টি, অশ্বত্থামা ৭ টি, ভূরিশ্রবা ৩ টি, শল্য ৬ টি, শকুনি ২ টি এবং দুর্যোধন ৩ টি বাণ দ্বারা অভিমন্যুকে তাড়ন করলেন। এদিকে চাপহস্ত ও প্রতাপশালী অভিমন্যু নৃত্যের ছলেই সেসব বিনষ্টপূর্বক তিন তিনটি বাণ দ্বারা প্রত্যেককেই বিদ্ধ করলেন। এদিকে অশ্মকদেশের রাজপুত্র গরুড় ও বায়ুর ন্যায় বেগবান বাক্যনুসারী ও সুশিক্ষিত অশ্বগণের গুণে বেগে আসতে লাগলে অত্যন্তক্রুদ্ধ অভিমন্যু ১০ টি বাণ দ্বারা তাঁকে বিদ্ধ করলেন। অতঃপর ঈষৎ হেসে ১০ টি বাণদ্বারা অশ্মকরাজপুত্রের সারথি, ৪ টি অশ্ব, ধ্বজ, বাহুযুগল, ধনু ও মস্তক ছেদন করে ভূতলে নিপতিত করলেন। বীর অশ্মকরাজপুত্রের বধ দেখে সমগ্র কৌরবসৈন্য পলায়ন উৎসুক হয়ে বিচলিত হলেন। অতঃপর কর্ণ, কৃপ, দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, শকুনি, শল, শল্য, ভূরিশ্রবা, ক্রাথ, সোমদত্ত, বিবিংশতি, বৃষসেন, সুষেণ, কুণ্ডভেদী, প্রতর্দ্দন, বৃন্দারক, ললিত্থ, প্রবাহু, দীর্ঘলোচন ও দুর্যোধন প্রভৃতি অত্যন্তক্রুদ্ধ হয়ে একত্রে বাণবর্ষণ করে অভিমন্যুকে আবৃত করলেন। - মহাভারত, দ্রোণপর্ব, অধ্যায় ৩৪, শ্লোক ২৬-২৮
🔆 কিন্তু সকল নক্ষত্র যেমন শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও যেমন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, তেমনি সকল যোদ্ধা একদিন রণাঙ্গনে অমরত্ব স্বরুপ মৃত্যুকে প্রাপ্ত করে বিজয়মাল্য গলায় বরণ করে নেয়। কুরুক্ষেত্রের সে নক্ষত্রকেও বীরত্বের জয়গান গেয়ে ত্যাগ করতে হয়েছে এই নশ্বর দেহ। কিন্তু সে অমরগাথাঁ যে রচনা করেছিলেন তা অতুলনীয়। একজন কনিষ্ঠ যোদ্ধাকে পরাস্ত করতে কর্ণ, কৃপ, দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, শকুনি, শল, শল্য, ভূরিশ্রবা, ক্রাথ, সোমদত্ত, বিবিংশতি, বৃষসেন, সুষেণ, কুণ্ডভেদী, প্রতর্দ্দন, বৃন্দারক, ললিত্থ, প্রবাহু, দীর্ঘলোচন ও দুর্যোধনসহ সমগ্র কৌরব সৈন্যদের লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু তবুও ভয়ঙ্কর সিংহের সম্মুখে যেমন শিকার অসহায়, তেমনি অভিমন্যুর নিকট কৌরব যোদ্ধারা ছিলেন অসহায়।
🔆 কিন্তু গুরু দ্রোণ এই পরাক্রমশালীর ইতি টেনে ধরতে বদ্ধপরিকর। ফলস্বরূপ তিনি সকল কৌরব যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে উপায় জানালেন যে,
"বিশেষসন্ধানপূর্বক বাণ দ্বারা অভিমন্যুর ধনু, গুণ ও ঘোড়ার লাগাম ছেদন করা যেতে পারে এবং ঘোড়াগুলোকে ও পিছনের সারথি দুজনকে হত্যা করা সম্ভব। অতএব কর্ণ! যদি পারো, তাহলে তুমি তাই করো। তারপর তুমি অভিমন্যুকে পিছন দিক থেকে প্রহার করতে থাকো। অভিমন্যু যদি ধনুযুক্ত থাকে তাহলে আমারা কোনোভাবেই তাকে হত্যা করতে পারব না। তাই তাকে রথবিহীন এবং ধনুশূন্য করো।’’
🔆 যেমন পরিকল্পনা সে অনুসারে বাস্তবায়ন হয়েছিলো। কর্ণ পশ্চাদ্ থেকে বান নিক্ষেপ করে ধনু ছেদন করলেন এবং গুরু দ্রোণ ও কৃপাচার্য রথের অশ্ব ও দুই সারথিকে হত্যা করলেন। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও ক্ষত্রিয় ধর্ম রক্ষার্থেই খড়গ হস্তে এগিয়ে যান। কিন্তু কৌরবপক্ষীয় তীব্র বাণ বর্ষণ করে অভিমন্যু বিদ্ধ হন। এই আহত শরীরেও যেন তেজ অফুরন্ত। নিশস্ত্র কোনো শব্দ তাহার নেই, করুণার আশা নেই হৃদয়ে, সাহসের সাথে ক্রুদ্ধ হয়ে মাটি হতে রথচক্র উত্তোলন করে রুদ্ররুপে অগ্রবর্তী হন দ্রোণ অভিমুখে। কৌরব যোদ্ধারা তীব্র বাণ বর্ষণ করে রথচক্র বিনষ্ট করেন। তবুও অদম্য মহারথী অভিমন্যু। গদা হস্তে এগিয়ে যান অশ্বথামার দিকে, এমন রুদ্র রুপে ভীত অশ্বথামা রথ ত্যাগ করে পলায়ন করেন কিন্তু ততক্ষণে অভিমন্যু অশ্বথামার রথের অশ্ব ও সারথিদের হত্যা করেন। সেই একই গদার আঘাতে সুবলপুত্রকে ও তার অনুচর এবং ১০টি হাতি হত্যা করেন। উপায়ন্তর না দেখে দুঃশাসন পুত্র গদা হস্তে অভিমন্যুকে রোধ করতে এগিয়ে আসেন। তীব্র গদাযুদ্ধে বারবার উঠে দাঁড়ান অভিমন্যু কিন্তু ক্লান্ত ও আহত শরীরের সীমাবদ্ধতা তাকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। ফলে, দুঃশাসন পুত্র অভিমন্যুর মস্তকে তীব্র এক আঘাত করতে সমর্থ হন। সে আঘাতে ধরায় লুটিয়ে পড়েন অজেয়, অমর যোদ্ধা অভিমন্যু।
▪️অভিমন্যু সে যুদ্ধে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের পূর্বে যে বীরত্বের জয়গান গেয়ে গিয়েছেন তা বীরদের অনুপ্রেরণা। মৃত্যুকে ভয় নয় বরং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রু সংহার করাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। এই চেতনা জাগ্রত করে আমাদের নিকটে। সেজন্য, মহাভারতে অভিমন্যু এক অজেয় বীর। যে জয় করেছে শুধু শত্রুকে নয় বরং মৃত্যুও তার নিকট তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে।
তথ্যসূত্র: মহাভারত (হরিদাসসিদ্ধান্তবাগীশ) দ্রোণপর্ব, ৩২-৪৩ অধ্যায়।
🔎Run with #veda