"যা ছিল সনাতনী সমাজে,
কিন্তু নেই সনাতন শাস্ত্রে"
সনাতন ধর্ম সদা সত্য ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রদান করে। বৈষম্য কিংবা কুসংস্কার এর স্থান নেই সনাতন ধর্মে। যুক্তিতর্কের মাধ্যমে যেকোনো সংশয় নিবারন করার পরম্পরা সনাতনের ঐতিহ্য। সেজন্য, একজন সনাতনী তাহার কর্তব্য অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
কিন্তু সময়ের আবর্তে বিভিন্ন সময়ে কিছু স্বার্থান্বেষী, অজ্ঞানী ব্যক্তিদের মূর্খতারূপ সিদ্ধান্তের কারণে কুসংস্কার সমাজে নিয়ে আসে দুর্দশা ও বৈষম্য। যা সাম্য ভিত্তিক সমাজে বৈষম্য, সুন্দর সমাজকে কুৎসিত এবং ধার্মিক সমাজে পাপাচারের প্রতিষ্ঠা করে থাকে। ধর্মের আড়ালে অধর্মকে মূল উপজীব্য করে তোলা হয়। ফলস্বরূপ, সমাজ হয়ে উঠে বসবাসের অযোগ্য। সেজন্য, সনাতনী সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করতে বারংবার মনিষীগণ আশ্রয় নিয়েছেন ধর্মশাস্ত্রের।
সতীদাহপ্রথা:
মধ্যযুগে প্রচলিত সতীদাহপ্রথা ছিল এক বর্বর প্রথা। সহমরণ এর মতো স্বইচ্ছা সিদ্ধান্তকে জোরপূর্বক বাধ্য করার মাধ্যমে সতীদাহ প্রথা চলতে থাকে শত শত বৎসর ধরে। রাজা রামমোহন রায় এই কুপ্রথা বিলুপ্তির জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করেন। ফলশ্রুতিতে, লর্ড বেন্টিংক আইন পাশের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথাকে অবৈধ ঘোষণা করেন।
কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে পতিহীনা নারীর প্রতি এমন নিষ্ঠুরতম আচরণের উল্লেখ নেই। বরং ইতিহাস গ্রন্থ
মহাভারত অনুযায়ী [১২।৪২।১০],
"যুদ্ধের পরে যেসব নারীর স্বামী বা পুত্র যুদ্ধে মারা গিয়েছিল তাদের সবাইকে দয়ালু কুরুবংশীয় রাজা যুধিষ্ঠির সম্মানের সাথে লালন-পালন করতেন।"
ব্যাখ্যা:- মহাভারতে সতীদাহপ্রথার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নাহ। মাতা কুন্তী, সত্যবতী, উত্তরা ইত্যাদি নারীদের স্বামীর মৃত্যুর পরেও কোনো সতীদাহপ্রথার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় নাহ।
জোরপূর্বক বিবাহ:
পূর্ব থেকে বর্তমান সময়ে নারীদের জোরপূর্বক বিবাহ দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। কিন্তু অভিভাবকগণ কন্যা সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে কিংবা প্রলোভনে এসে অসৎ ব্যক্তির সাথে কন্যার বিবাহ দেন। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে এরুপ উদ্যোগের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শাস্ত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে,
"ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।"
- অথর্ববেদ ১১/৫/১৮
অর্থাৎ, ঠিক যেমন যুবক ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদুষী কন্যাকে বিয়ে করবে ঠিক তেমনি একজন যুবতীও ব্রহ্মচর্য শেষ করে পছন্দমত বিদ্বান যুবককে স্বামী হিসেবে গ্রহন করবে।
"কামং আ মরণাত্তিষ্ঠেদ্গৃহে কন্যা র্তুমত্যপি ।
ন চৈবৈনাং প্রয়চ্চেত্তু গুণহীনায় কর্হি চিৎ"॥
- মনুস্মৃতি ৯/৮৯
অর্থাৎ, বরং কন্যা মৃত্যু পর্যন্ত বিবাহ না করিয়াই পিতৃগৃহে থাকিবে, তথাপি গুণহীন, অযোগ্য ও দুষ্ট পুরুষের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিবে না।
ব্যাখ্যা: নারীদের নিজ পতি চয়নের অধিকার মহাভারত কিংবা রামায়ণের সময় থেকে চলমান। ব্যক্তির বীরত্ব ও গুণাগুণ পরিক্ষা ব্যতীত কন্যা সম্প্রদান কখনো করা হতো নাহ। উদাহরণস্বরূপ, অর্জুন যখন অজ্ঞাতবাসে ছিলো তখন দ্রুপদের রাজসভায় নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিচয়ের ছিলেন, তবুও দ্রুপদ তাহার কন্যা দ্রৌপদীকে অর্জুনের সঙ্গে বিবাহের জন্য মনোনীত করেন। কারণ, গুণই এখানে বিবেচ্য।
যৌতুক প্রথা:
যৌতুক প্রথা বর্তমান সময়ে এসেও সমাজের কাটা হয়ে আছে। বিশ্লেষকেরা যৌতুক প্রথার উৎপত্তি ও বিস্তারের জন্য সনাতন ধর্মের দিকে অভিযোগের তীর ধরেন। কিন্তু এই কুপ্রথা কখনো সনাতন ধর্মের অংশ ছিল নাহ। কারণ মহর্ষি মনু স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যৌতুক নামক পাপ গ্রহণে অধোগামী হয়।
"স্ত্রীধনানি তু যে মোহাদুপজীবন্তি বান্ধবাঃ ।
নারী যানানি বস্ত্রং বা তে পাপা যান্ত্যধোগতিম্"॥
- মনুস্মৃতি ৩/৫২
অর্থাৎ, পতির যে বান্ধবেরা [পিতা-মাতা, ভগ্নি-ভ্রাতা আদি সম্বন্ধী] মোহবশত স্ত্রীধন, স্ত্রীদিগের অশ্বাদি যান বা বস্ত্র আদি গ্রহণ করে, তাহা উপভোগ করে জীবন নির্বাহ করে সেই পাপীরা নীচগতি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ তাদের পতন হয়।
ব্যাখ্যা: স্বামী কিংবা তাহার আত্মীয় স্বজন শুধুমাত্র কন্যাকে গ্রহণের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু কন্যার পিতার সম্পদ তাহার জন্য নির্ধারিত নয়৷ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম নিজ শৌর্য প্রদর্শন করে মিথিলার রাজকন্যা মাতা সীতাকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু এরুপ কুপ্রথার উল্লেখ বাল্মিকী রামায়ণে পাওয়া যায় নাহ।
বিধবাবিবাহ:
নারী স্বামী সঙ্গে সমগ্র জীবন অতিবাহিত করার স্বপ্ন দেখে। বেদে পরমাত্মা পতি-পত্নিকে একসঙ্গে যজ্ঞ ও কল্যাণের জন্য উপদেশ প্রদান করেছেন। কিন্তু সৃষ্টি অমোঘ নিয়মে পত্নীর সে সঙ্গী এই নশ্বর দেহত্যাগ করতে পারে। তখন, সে পত্নীর কি করণীয়? একদা এই বিধবাবিবাহ ছিল অসম্ভব। কিন্তু সতীদাহপ্রথা বিলুপ্তির পর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ পুনঃপ্রচলন করেন। তিনি তাহার প্রকাশিত গ্রন্থে এই সত্যকে তুলে ধরে ছিলেন যে, নারীর পতির মৃত্যুর পর পুনঃ বিবাহের অনুমতি শাস্ত্রে রয়েছে।
"নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।”
- পরাশর সংহিতা ৪/২৭
অর্থাৎ, পতি নিরুদ্দেশ হলে, মৃত হলে, সন্যাস গ্রহন করলে, ক্লীব হলে বা পতিত হলে। নারীদিগের এই পঞ্চপ্রকার আপৎকালে অন্য পতি গ্রহন করা উচিত।
ব্যাখ্যা: নারী সর্বমোট ০৫ অবস্থায় অন্য পতি গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজে দীর্ঘদিন নারীদের করা হয়েছিল পদাবনত। শুধুমাত্র শাস্ত্র বিমুখ হওয়াতে এরুপ কুপ্রথা দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিলো।
জাতিপ্রথা:
সমাজকে শ্রেণীতে বিভক্ত বৈষম্য সৃষ্টি করা যেন মানব সমাজের দীর্ঘ সময়ের চর্চা। কোনো স্থানে কালো-সাদা, কোথাও বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত, কোথাও জাতি প্রথা সমাজকে করেছে বৈষম্যমূলক ও ধ্বংসের সম্মুখীন। শুধুমাত্র কালো হওয়ার অপরাধে আফ্রিকার সমৃদ্ধ নগরী ধ্বংস করে পাশ্চাত্য সমাজ নির্মাণ করেছিলো দাসপ্রথার অনন্য নজির। যেখানে মানুষ প্রাণীর ন্যায় কারারুদ্ধ দাস। কিন্তু বিভিন্ন সময় ভারতবর্ষে বৈষম্য সৃষ্টিকারী জাতিপ্রথা বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু শাস্ত্র সে বৈষম্যকে কখনো সমর্থন করেনি। বরং, স্বার্থান্বেষী মহলের তত্ত্বাবধানে Meritocracy এর ভিত্তিতে সাম্যভিত্তিক বর্ণাশ্রম ধর্ম, বিকৃতি হয়ে জাতিপ্রথা।
প্রচারে : VEDA