"কর্ণ - এক ঐতিহাসিক বিতর্কিত অধ্যায়"
"কর্ণ - এক ঐতিহাসিক বিতর্কিত অধ্যায়"
ইতিহাস সত্যি বিচিত্র ও রহস্যময়। স্রোতের আবহে নদীর জল যেমন সঙ্গে করে পলি বয়ে নিয়ে আসে, তেমনি সময়ের আবর্তে ইতিহাস নিয়ে আসে ঐতিহাসিক চরিত্র। যোদ্ধার অদম্য বীরত্ব, কবির অনবদ্য সৃষ্টি ও শাসকের কালজয়ী কৃতিত্ব কিংবা প্রেমের অমর কাব্য রচিত হয়ে খ্যাতির স্থান অর্জন করেছে যুগে যুগে। তবে ইতিহাসের খেরোখাতায় মূল চরিত্রের সঙ্গে কিছু এমন চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যা সে ইতিহাসের অনন্য দিকের উন্মোচন করে। উদাহরণস্বরূপ, বাল্মিকী রামায়ণে বিভীষণ এর চরিত্র। যা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে হওয়া সত্ত্বেও কবি কল্পনায় স্থান লাভ করেছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে, কিন্তু নৈতিকতা ও সত্যের পক্ষে তার অবস্থানের জন্য তিনি হতে পারতেন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তেমনি মহাভারতেও রয়েছে এমনি এক চরিত্র - যা রহস্য, বীরত্ব ও দানবীর হিসেবে অতুলনীয়। কিন্তু সে চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বে রয়েছে অন্ধকার এক দিক। যদিও আধুনিক নাট্য, কাব্য ও কবিকল্পনায় তাকে বীরোচিত হিসেবে পাঠকপ্রিয় চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তবে তিনি সে শ্রেষ্ঠত্বের সত্যি ধারক কি নাহ তা সত্যি সন্দেহপূর্ণ তার কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ থেকে। সে চরিত্র - অঙ্গরাজ কর্ণ, যিনি দানবীর হিসেবেও খ্যাত।
মহাভারতে কর্ণের প্রকৃত পরিচয় সত্যি বিস্ময়কর। সে বিষয়ে আমাদের সকলের ধারণা রয়েছে। সেজন্য, আমরা শব্দবাহুল্য দূর করার জন্য আলোচ্য বিষয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি।
কর্ণ অবশ্যই একজন দানবীর ছিলেন। বীরত্ব ও যোদ্ধা হিসেবেও তিনি অনন্য ছিলেন। কিন্তু সে-সকল অর্জন ও গুণাগুণ ম্লান হয়ে যায়, যখন তার অবস্থান হয়ে যায় ধর্মের বিপক্ষে ও অধর্মের পক্ষে। কর্ণ অবশ্যই অবহেলিত হিসেবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তার প্রতি বর্তমান সময়ের "ভিক্টিম গেম" খুব বেশি আরোপিত হয়নি তো⁉️কর্ণ সম্পর্কিত বহুল প্রচলিত সংশয় গুলো নিবারণ করা অত্যাবশ্যক। সে সংশয় সমূহ হলো:-
🗞️ কর্ণের গুরু
🗞️ কে শ্রেষ্ঠ - অর্জুন নাকি কর্ণ
🗞️ কর্ণের অপরাধ সমূহ কি ভিক্টিম হিসেবে দেখা উচিত ⁉️
🗞️ কর্ণের ব্যক্তি চলচ্চিত্র ও মহাভারতে কতটুকু ভিন্ন
উপরোক্ত ০৪টি সংশয় নিবারণের মাধ্যমে "কর্ণ - এক ঐতিহাসিক বিতর্কিত অধ্যায়" এর দীর্ঘসময় এর জটিলতা নিরসন সম্ভব।
🗞️ কর্ণের গুরু:-
কর্ণ ছিলেন সূতপুত্র। কিন্তু মহাভারতের যুগে সূতপুত্র শব্দের প্রয়োগ ঠিক কাদের উদ্দেশ্য প্রয়োগ করা হতো কিংবা সূতপুত্র কি অস্পৃশ্য ছিল ? নাহ! মনুসংহিতায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, "ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজব্যবস্থাতেও ক্ষত্রিয় পিতা ও ব্রাহ্মণী মাতার পুত্রকে সুত বলা হতো। তাঁদের কাজ রথ চালানো [ মনু০ ১০.৪৬-৪৭]। শাসক, যোদ্ধার রথচালক কি করে অস্পৃশ্য হতে পারে?
কর্ণের পালক পিতা কোনো সাধারণ রথচালক ছিলেন। হরিবংশ ১.৩১.৫৪-৫৯ ও মহাভারত বনপর্ব অধ্যায় ৩০৮ অনুসারে
"কর্ণের পালক পিতা অধিরথ ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধু ও রাজা অঙ্গের ছোট ভাই ছিলেন।"
এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ হতে এটা স্পষ্ট যে, কর্ণ যদিও পালক পিতার গৃহে ছিলেন কিন্তু তৎকালীন সময়েও সূতপুত্র কোনো অবাঞ্ছিত কোনো গোষ্ঠী ছিলো নাহ। বর্তমান সময়ের বিবিধ ব্যক্তি কর্ণকে অবহেলিত হিসেবে উপস্থাপন এর জন্য সবথেকে বেশি যে বিষয়টি তুলে ধরেন তা হলো, দ্রোণাচার্য কর্ণকে সূতপুত্র হওয়ায় কোনো অস্ত্র বিদ্যার জ্ঞান প্রদান করেননি। ফলস্বরূপ, ভগবান পরশুরাম এর নিকট প্রতারণা করে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করতে যান। কিন্তু মহাভারতের তথ্য মতে, এই ধারণা সম্পূর্ণভাবে ভুল ও মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
মহাভারতে বনপর্ব, অধ্যায়: ৩০৮, শান্তিপর্ব, অধ্যায়: ২, আদিপর্ব ১৩২ অনুসারে, কর্ণ শৈশবে কৌরব ও পান্ডবদের সঙ্গে কৃপাচার্যের নিকট অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন। কিন্তু কৃপাচার্যের নিকট জ্ঞান অর্জন এর পরে কৌরব ও পান্ডবগণ গুরু দ্রোণের নিকট অস্ত্র শিক্ষা প্রাপ্ত করতে যান। কর্ণ গুরু দ্রোণের নিকট একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হওয়ার অভিলাষে গমন করেন। কিন্তু তার এই স্বপ্ন ভঙ্গ হতে থাকে। কারণ, দক্ষতা ও জ্ঞানের দিক থেকে অর্জুন এর সমকক্ষ হয়ে উঠতে তিনি পারেননি। ফলশ্রুতিতে, তার এই ক্ষোভ তীব্রতা লাভ করে। কিন্তু এই ক্ষোভ শৈশব থেকেই বিদ্যমান ছিলো একটা এবং দুর্যোধন এর সহিত প্রায়শই পান্ডবদের অপমান করার চেষ্টা করতেন কর্ণ। (যা মহাভারতের শান্তি পর্ব ০২ বর্নিত রয়েছে)। অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব যখন সবার সামর্থ্যকে ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। এই হিংসা হতে, কর্ণ গোপনে গুরু দ্রোণের নিকট গিয়ে ব্রহ্মাস্ত্র প্রাপ্তির কামনা করিলেন। কিন্তু এই দিব্যাস্ত্র প্রাপ্তির উদ্দেশ্য ছিলো অর্জুনকে হত্যা করা। এই দুরভিসন্ধিমূলক চেষ্টা গুরু দ্রোণের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ে। তখন দ্রোণাচার্য কর্ণকে প্রত্যাখান করেন। উপায়ন্তর না দেখে কর্ণ অর্জুনকে পরাজিত করার তীব্র বাসনা নিয়ে গমন করেন ভগবান পরশুরাম এর নিকট।
"অর্জুন- পক্ষপাতী গুরু দ্রোণাচার্য কর্ণের সেই বাক্য শ্রবণে অর্জুনের প্রতি তাহার অত্যাচার বাসনা বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, কর্ণ! নিত্যব্রতধারী ব্রাহ্মণ বা তপস্বী ক্ষত্রিয় ইহারাই ব্রহ্মাস্ত্র জ্ঞাত হইতে পারে, অন্য কাহারও ইহাত অধিকার নাই।
মহাবীর কর্ণ দ্রোণ কর্তৃক এই রুপ প্রত্যাখ্যাত হইয়া তাঁহার যথোচিত সৎকার করিয়া মহেন্দ্র পর্ব্বতে পরশুরামের নিকট প্রস্থান করিলেন এবং তাঁহারে প্রণাম করিয়া আপনারে ভূগুকুলোন্তব ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচয় প্রদান পূর্ব্বক দণ্ডায়- মান রহিলেন। তখন পরশুরাম কর্ণকে স্বাগত প্রশ্ন ও নাম জিজ্ঞাসা করিয়া শিষয্যঙ্গে গ্রহণ করিলেন।" - মহাভারত শান্তি পর্ব ০২
অর্থাৎ, কর্ণ অর্জুনের সমকক্ষ গুণ অর্জন না করে
ব্রহ্মাস্ত্র প্রাপ্ত করতে চাইলেন। যার উদ্দেশ্য অর্জুনকে হত্যা করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা এবং সে উদ্দেশ্য প্রতারণাপূর্বক পরশুরাম এর নিকট দিব্যাস্ত্র অস্ত্র শিক্ষা প্রাপ্ত করেন। এই বিশ্লেষণ হতে ইহা স্পষ্ট যে, কর্ণ শিক্ষা হতে বঞ্চিত ছিলেন তা সূতপুত্র পরিচয়ের জন্য ইহা মিথ্যা তথ্য। বরং, তিনি কৌরব ও পান্ডবদের সঙ্গে অস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু নিজের উচ্চাভিলাষী মানসিকতার জন্য প্রতারণা করেন গুরু পরশুরাম এর সাথে।
▪️পর্ব : ০১
🔎Run with #veda #mahabharat #karna
মন্তব্যসমূহ