"ষোড়শ সংস্কার"
জীবন এক অন্তহীন চক্র এবং জন্ম ও মৃত্যু সে চক্রের সামান্য অংশমাত্র। কিন্তু এই জন্ম হতে মৃত্যু অবধি আমাদের জীবনপ্রণালি যদি সঠিক পথ ও কার্য অনুসরণ করে তবে এই চক্র হতে মুক্ত হওয়া সম্ভব। মোক্ষ অর্জনের পথে জীবনকে পরিচালনা করার পর্যায়ক্রমিক স্তর সমূহ ১৬টি ধাপে বিভক্ত, যা একত্রে ষোড়শ সংস্কার হিসেবে পরিচিত।
মহর্ষি মনু বেদবিহিত [যজুর্বেদ ৮।৩৩] এই ষোড়শ সংস্কারের গুরুত্ব মনুস্মৃতি ২।১৬ তে বর্ণনা করেছেন। যা আমাদের জীবন মার্গে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অনুসরণীয়। উত্তম পরিবার ও প্রজন্ম গঠনে ষোড়শ সংস্কারের পালন অপরিহার্য।
ষোড়শ সংস্কার: ১. গর্ভাধানঃ ২. পুংসবনঃ ৩. সীমান্তোন্নয়নঃ ৪. জাতকর্মঃ ৫. নামকরণঃ ৬. নিষ্ক্রমণঃ ৭. অন্নপ্রাশনঃ ৮. চূড়াকর্মঃ ৯. কর্ণবেধঃ
১০. উপনয়নঃ ১১. বেদারম্ভঃ ১২. সমাবর্তনঃ ১৩. বিবাহঃ ১৪. বানপ্রস্থঃ ১৫. সন্ন্যাসঃ ১৬. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ
🔆 গর্ভাধানঃ গর্ভাশয়ে বীর্যস্থাপন-স্থিরীকরণ যে ক্রিয়া দ্বারা হয় তাহাকে গর্ভাধান বলে। উত্তম স্ত্রী - পুরুষের থেকে উত্তম সন্তান উৎপন্ন হয়।
- অথর্ববেদ ৬।৮১।২
🔆 পুংসবনঃ স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছেন জানার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় মাসে সুস্থ সন্তান কামনায় যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যজ্ঞ করা হয় তাকে পুংসবন বলে। প্রসূতি মা ও সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই সংস্কার পালন করা হয়। - অথর্ববেদ ৩।২৩।৬
🔆 সীমান্তোন্নয়নঃ গর্ভধারিণী স্ত্রীর মন আনন্দিত হয় এবং শরীর আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে গর্ভমাস হতে চতুর্থ মাসে যে সংস্কার করতে হয় তাকে সীমন্তোন্নয়ন বলা হয়। -ঋগ্বেদ ২।৩২।৪
🔆 জাতকর্মঃ দীর্ঘ দশমাস গর্ভধারনের পর সন্তান প্রসবের সময় মন্ত্র জপ, মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক নাভিচ্ছেদন, শিশুর যত্ন বিষয়ক কর্মসমূহকে জাতকর্ম সংস্কার বলা হয়। - ঋগ্বেদ ৫।৭৮।৯
🔆 নামকরণঃ সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার ১১তম দিনে আত্মীয় পরিজন ও পরিবারের ব্যক্তিদের সঙ্গে করে সন্তানের নাম রাখার সংস্কারকে নামকরণ সংস্কার বলে। - যজুর্বেদ ৭/২৯
🔆 নিষ্ক্রমণঃ ভূমিষ্ঠ হওয়ার ০৪ মাস পর ঘরের বাইরে শুদ্ধ বায়ুপূর্ণ স্থানে সন্তানকে ভ্রমণ করানোর সংস্কারকে নিষ্ক্রমণ বলে। - অথর্ববেদ ৮।২।১৪
🔆 অন্নপ্রাশনঃ সন্তান জন্মলাভের পর অন্ন জাতীয় খাদ্যাদি হজম করার উপযুক্ত শক্তি লাভ করবে, তখন মুখে অন্ন দেওয়াই অন্নপ্রাশন সংস্কার। - অথর্ববেদ ৮।২।১৯
🔆 চূড়াকর্মঃ শিশুর ০১ থেকে ০৩ বছরের মধ্যে মস্তক মুণ্ডন অর্থাৎ মাথার চুল ফেলে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে চূড়াকর্ম সংস্কার। - অথর্ববেদ ৬।৬৮।৩
🔆 কর্ণবেধঃ শিশুর জন্মের তৃতীয় বা পঞ্চম বর্ষে নাক ও কান ছিদ্র করাকে কর্ণবেধ বলা হয়। বর্তমান সময়ে বিলুপ্ত হলেও কিছু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংস্কার অতীব গুরুত্বপূর্ণ। - অথর্ববেদ ৬।১৪১।২
🔆 উপনয়নঃ জ্ঞান অর্জন সকলের অধিকার। সে জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে সত্যান্বেষীকে যেতে হবে উপর্যুক্ত গুরুর নিকট। যে সংস্কার দ্বারা শিষ্যকে গুরুর সাহচর্যে শিক্ষাগ্রহণ করে বিদ্বান ব্যক্তিতে পরিণত হতে নিয়ে যাওয়া হয় তার নাম “উপনয়ন”। উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমে যজ্ঞোপবীত ধারণ করে শিষ্যের ২য় জন্ম ঘটে যা দ্বিজত্ব হিসেবে পরিচিত।
- অথর্ববেদ ১১।৫।৩
🔆 বেদারম্ভঃ গায়ত্রী মন্ত্র থেকে শুরু করে চারবেদ অধ্যয়নের জন্য যে নিয়ম-ধারণ করতে হয়, তাকে বেদারম্ভ সংস্কার বলে। - অথর্ববেদ ১১।৫।২৪
🔆 সমাবর্তনঃ শাস্ত্র অধ্যয়ন ও গুরুকুলে শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর গুরুগৃহ থেকে গৃহে ফিরে গৃহস্থাশ্রম গ্রহণের জন্য সমাবর্তন সংস্কার পালন করা হয়। বর্তমান সময়ের শিক্ষাঙ্গনে এই সমাবর্তন লক্ষ্য করা যায়। - ঋগ্বেদ ৩।৮।৪
🔆 বিবাহঃ মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিবাহ সংস্কার। ব্রহ্মচর্য পালন এর পর
সমাবর্তনের মাধ্যমে গৃহাশ্রমের জন্য শুভ গুণ কর্ম ও স্বভাবের দিক দিয়ে সকলদিক দিয়ে তুল্য ও প্রীতিযুক্ত হয়ে স্ত্রী পুরুষের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনই বিবাহ সংস্কার। - অথর্ববেদ ১১।৫।১৮
🔆 বানপ্রস্থঃ বিবাহের মাধ্যমে যুগল ধার্মিক জীবন অতিবাহিত করে এবং নিজ দায়িত্ব পালন করার পর মহাত্মাগণের সহিত যোগাভ্যাস, শাস্ত্র আলোচনা ও পরমাত্মার সাক্ষাৎ লাভের প্রযত্ন করাকে বানপ্রস্থ সংস্কার বলে। যার অপর নাম গৃহাশ্রমসংস্কার। - ঋগ্বেদ ১০।১৪৬।৫
🔆 সন্ন্যাসঃ জীবনের সকল দায়িত্ব পালন শেষে মোহত্যাগ করে জীবনকে মোক্ষ অর্জনের উদ্দেশ্য চূড়ান্তভাবে পরিচালিত করার উদ্দেশ্য পরিভ্রমণ করা সন্ন্যাস সংস্কার। - ঋগ্বেদ ৯।১১৩।৪
🔆 অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ মৃত্যুই এই জীবদেহের অন্তিম পরিণতি। সকল প্রাণীকে এই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এই মৃত্যুর পরে এই নশ্বর দেহের দাহকার্য সম্পাদন করা অর্থাৎ অন্তিম সংস্কারকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বলে। মানবজীবনের মৃত্যুই একটি সমাপ্তি এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ সর্বশেষ সংস্কার। এর পরবর্তী সময়ে আর কোনো কার্যক্রম অবশিষ্ট থাকে, কোনো কর্মও তাকে প্রভাবিত করতে পারে নাহ। - যজুর্বেদ ৪০।১৫
ষোড়শ সংস্কার আমাদের মানবজীবন এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। যা আমাদের জীবনকে সাধারণ থেকে অসাধারণ, সামান্য থেকে অসামান্য করে তোলে। সেজন্য, বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে সকলে নিজ জীবনকে ষোড়শ সংস্কারের মাধ্যমে উত্তম করে তুলি।
🔎Run with #veda